অসহায় আত্মসমর্পণের পরে শেষ দেখছেন আফ্রিদি-ওয়াকার

ডাগ আউট থেকে যেন কোনও রকমে শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে মাঠের মধ্যে নিয়ে গেলেন। খেলা শেষে বিপক্ষের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রথাটা আর ভুলবেন কী করে?

Advertisement

রাজীব ঘোষ

মোহালি শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৬ ০৪:৩৬
Share:

৪৮ বলে ৮০। মোহালির নায়ক গাপ্টিল।–রয়টার্স

ডাগ আউট থেকে যেন কোনও রকমে শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে মাঠের মধ্যে নিয়ে গেলেন। খেলা শেষে বিপক্ষের ক্রিকেটারদের সঙ্গে হাত মেলানোর প্রথাটা আর ভুলবেন কী করে?

Advertisement

কিউয়ি ক্রিকেটারদের অভিনন্দন জানালেও একবারও নিজের দলের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেল না পাক অধিনায়ক শাহিদ আফ্রিদিকে।

মুখ খুললেন টিভি ক্যামেরার সামনে। আর তাতেই উগড়ে দিলেন যাবতীয় ক্ষোভ। এমনকী এও বলে দিলেন, ‘‘অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচটাই হয়তো আমার শেষ ম্যাচ।’’

Advertisement

কপালের প্রতিটি ভাঁজ বিরক্তিতে ভরপুর। হবে নাই বা কেন? ১৮১-র টার্গেট তাড়া করতে নেমে ছ’ওভারে ৬৬-১ তোলার পরও যে ভাবে নিউজিল্যান্ডের কাছে ২২ রানে হারতে হল। আউট হয়ে ডাগ আউটে ফিরে যে ভাবে বাউন্ডারিহীন শেষ পাঁচ ওভারে ব্যাটসম্যানদের আত্মসমর্পন দেখতে হল তাঁকে, তার পর আর এই দলের মায়া কাটানো বোধহয় খুব একটা কঠিন নয়। নিউজিল্যান্ড ১৮০ তোলার পর অনিল কুম্বলে টুইট করেন, ‘‘এ বার প্রথম ছ’ওভারেই বোঝা যাবে ম্যাচে কী হতে চলেছে।’’ ছ’ওভারে বোঝা তা বোঝা গেলেও শেষে ঘটল সম্পুর্ণ উল্টো।

আফ্রিদির যখন এই হাল, তখন আইএস বিন্দ্রা স্টেডিয়ামের কনফারেন্স রুমে বোমা ফাটাচ্ছেন তাঁদের কোচ ওয়াকার ইউনিস। ‘‘এত দিন ধরে তো অনেকেই ব্যাটিং অর্ডারে উপরে ওঠার জন্য লাফালাফি করছিল। আজ তারা সুযোগ পেয়ে কী করল দেখলেন তো?’’ বলছিলেন ওয়াকার।

উমর আকমল নাকি দু’দিন আগেই ইমরান খানের কাছে নালিশ করেছিলেন, তাঁকে ব্যাটিং অর্ডারে উপরে পাঠানো হয় না বলে তিনি রান পান না। সেই আকমল এ দিন চার নম্বরে নেমে একটাও চার বা ছয় না মেরে ২৬ বলে ২৪ করার পর তাঁদের কোচ পাল্টা বোমা ফাটান, ‘‘বুঝে দেখুন, কাদের নিয়ে ঘর করছি। যে প্ল্যাটফর্মে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল শার্জিল খান, তার পর এই ম্যাচে হারা তো অপরাধ। শেষ পাঁচ ওভারে তো বাউন্ডারি নেই-ই। শেষ দশ ওভারেই বা আমাদের ক’টা বাউন্ডারি হয়েছে গুনে দেখুন। দুটো চার, একটা ছয়।’’

খাতায় কলমে এখনও পুরোপুরি ছিটকে না গেলেও এই হারে যে বিশ্বকাপ থেকে পাকিস্তানের বিদায় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই ওয়াকারের। নিজের কোচিং অ্যাসাইনমেন্ট নিয়েও যে ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, তা তাঁর কথাতেই স্পষ্ট। বললেন, ‘‘দেশে ফিরে বোর্ডকে গিয়ে বলব সমস্যার কথা। তারা যদি আমার সঙ্গে একমত না হন, তা হলে ভেবে দেখতে হবে।’’

ব্যাটসম্যানদের এই নির্লজ্জ আত্মসমর্পণে যিনি এ দিন পার পেয়ে গেলেন, তিনি অবশ্যই মহম্মদ আমের। কয়েক দিন আগে পর্যন্ত যিনি নায়কের আসনে বসে ছিলেন। মঙ্গলবার মোহালির আমেরকে দেখে মনে পড়ে গেল বিশ্বকাপ শুরুর আগে রোহিত শর্মার বলা কথাগুলো। ‘‘কী আপনারা আমের আমের করছেন? কী এমন আহামরি বোলার ও?’’ কথাগুলো যে ভুল বলেননি সে দিন রোহিত, তা এ দিন শেষ ওভারে তাঁর ১৬ রান দেওয়া দেখেই বোঝা গেল। সব মিলিয়ে চার ওভারে ৪১। কোনও উইকেট নেই। বরং দুই ‘বৃদ্ধ’ সামি ও আফ্রিদি দু’টো করে উইকেট নিয়ে কোনও রকমে বিপক্ষর দুশোয় পৌঁছনো আটকান। তাও মার্টিন গাপ্টিলের ৮০-র ইনিংস আটকাতে পারেননি।

নিউজিল্যান্ড শেষ চারে, দুটো ম্যাচ জিতলে ভারতও

শুধু পাক ওপেনার শার্জিল খানের ব্যাটের ঝড় নয়, আফ্রিদিরা এ দিন পেয়েছিলেন গ্যালারিভরা সমর্থনও। যখন তাঁর ব্যাটে গোলাগুলি চালাচ্ছেন শার্জিল, তখন প্রায় ভর্তি গ্যালারিতে আওয়াজ উঠল ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, পাকিস্তান জিতেগা।’ হাজারো ওয়াটের গমগমে সাউন্ড সিস্টেমে ঘোষক যখন চেঁচিয়ে উঠলেন ‘জিতেগা ভাই জিতেগা...’ তখনও আওয়াজটা যেন দশগুন বেড়ে গেল, ‘পা-কি-স্তা-ন জি-তে-গা’। গ্যালারিতে ভর্তি পাকিস্তানি পতাকা দেখে প্রেস বক্সে বিস্মিত হতে দেখা গেল ওয়াঘার ও পার থেকে আসা সাংবাদিকদেরও। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কাশ্মীর থেকেও আফ্রিদিদের জন্য গলা ফাটাতে এসেছিল এক দল তরুণ। খেলার আগে টিভিতে সে কথা আফ্রিদি নিজেই বলাতে মিডিয়ার একাংশ এতে বিতর্কের গন্ধ পেলেও আফ্রিদির মন্তব্য নিয়ে কেউ কোনও অভিযোগ করেননি।

মঙ্গলবার বিকেলে মাঠে নামার মুহূর্ত থেকে আফ্রিদির সতীর্থদের তাতিয়ে তোলার চেষ্টার দৃশ্যটা ছিল দেখার মতো। খেলা শুরু হতে বাকিটা করে দিল মোহালির গ্যালারি। সেই গ্যালারি ম্যাচ শেষে এতটাই থমথমে, যা সাধারণত ভারত হারলে দেখা যায়। আগের দিনই সুদূর শিকাগো থেকে আসা পাকিস্তানের আর এক সমর্থক ‘চাচা’ মহম্মদ বশির আফসোস করছিলেন ‘মুলুক’ থেকে আসা কোনও ‘রিস্তেদার’-এর দেখা পাচ্ছেন না। নিশ্চয়ই তাঁর আফসোস মিটল এ দিন। কিন্তু পাকিস্তানের আফসোস মিটল কই। এই মোহালিতেই ২০১১ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ভারতের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয়েছিল পাকিস্তানকে। এ বারও সেই মোহালিতেই মোটামুটি ভাগ্য ঠিক হয়ে গেল আফ্রিদিদের।

ম্যাচের আগে পাক শিবিরে গিয়ে ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলে আসেন ওয়াসিম আক্রম। বুঝিয়ে আসেন পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, টেনশন করলেই সর্বনাশ।

শুরুতে সেই টেনশনটা অদৃশ্য ছিল পাকিস্তানি ওপেনারদের ব্যাট থেকে। বিশেষ করে শার্জিলের। অ্যাকশনে ভরপুর, ভয়ডরহীন ইনিংস। শুরুতেই আসা স্পিনার স্যান্টনারকে পরপর দুটো বাউন্ডারি দিয়ে যার শুরু। বোলারদের ব্যর্থতা শার্জিল ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন সব মিলিয়ে ন’টা চার ও একটা ছয় হাঁকিয়ে। কিন্তু তিনি ফিরে যাওয়ার পর সেই যে ভাঁটা পড়ল পাক ইনিংসে, সেই ভাঁটাই সর্বনাশের দিকে টেনে নিয়ে গেল তাদের। ১৮১-র টার্গেট সামনে রেখে সাড়ে পাঁচ ওভারে ৬৫ তুলে শার্জিল ফিরে যাওয়ার পর পাকিস্তান একশোয় পৌঁছয় ১২.৫ ওভারে!

বাকিটা তো ইতিহাস। লজ্জার ইতিহাস।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউজিল্যান্ড ১৮০-৫ (গাপ্টিল ৮০, সামি ২-২৩), পাকিস্তান ১৫৮-৫ (শার্জিল ৪৭, মিলনে ২-২৬)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন