রাসেলের ক্যারিবীয় ব্যাটে ইডেনে কাব্যিক পঁচিশে বৈশাখ

পাঁচটা বলের ছোট্ট পরিসর। যার পরতে পরতে পাঁচ অঙ্কের নাটক! শনিবারের ইডেন যে পাঁচটা বলের সঙ্গে আবেগের পাঁচ রকম সমুদ্র মন্থন সেরে জয়ের মুক্ত মুঠোয় পুরে চওড়া হাসি-সহ ঘর মুখো হল। শেষ ওভারে জর্জ বেইলি বলটা যখন অনুরীত সিংহের হাতে তুলে দিলেন, নাইট রাইডার্স ডাগআউটে জয়ের অঙ্কটা তখন ছ’বলে আট রানের। টি-টোয়েন্টির দুনিয়ায় যে পরিস্থিতি থেকে হার-জিতের নানা নজির মিলবে।

Advertisement

মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৫ ০৩:৩৯
Share:

পঞ্জাবের ম্যাড ম্যাক্সের জবাব নাইটদের রাসেল। ১৯ বলে হাফসেঞ্চুরি।

পাঁচটা বলের ছোট্ট পরিসর। যার পরতে পরতে পাঁচ অঙ্কের নাটক!

Advertisement

শনিবারের ইডেন যে পাঁচটা বলের সঙ্গে আবেগের পাঁচ রকম সমুদ্র মন্থন সেরে জয়ের মুক্ত মুঠোয় পুরে চওড়া হাসি-সহ ঘর মুখো হল।
শেষ ওভারে জর্জ বেইলি বলটা যখন অনুরীত সিংহের হাতে তুলে দিলেন, নাইট রাইডার্স ডাগআউটে জয়ের অঙ্কটা তখন ছ’বলে আট রানের। টি-টোয়েন্টির দুনিয়ায় যে পরিস্থিতি থেকে হার-জিতের নানা নজির মিলবে। কিন্তু রোমাঞ্চে এ দিনের ইডেনকে হারাতে পারবে কমই। তা সে ইউসুফ পাঠান-আন্দ্রে রাসেল যতই কালবৈশাখী তুলুন।
অনুরীতের প্রথম বলটা ব্র্যাড হগ লেগে সরে সোজা ঠেলে দিলে বোলারের হাতে লেগে বেরোল। এল এক। স্ট্রাইকিং এন্ডে পৌঁছলেন পীযূষ চাওলা। আরও উত্তাল হল মেক্সিকান ঢেউয়ে মত্ত গ্যালারি! পরের বল ব্লক হোল-এ। চাওলা কোনওমতে ঠেকালেন। রান নিতে ছুটেছেন হগ। কিন্তু চাওলা তাঁকে ফেরত পাঠানোর আগেই নির্ভুল নিশানায় অনুরীত উল্টো দিকে উইকেট ভেঙে দিয়েছেন। হগ আউট! এবং মাঠে প্রায় পিন পড়া নীরবতা। বি ব্লকের উপরের কর্পোরেট বক্সে ততক্ষণে সাদা রংয়ের একটা কী যেন জপমালার মতো বুকে চেপে ফ্যাকাশে মুখে প্রার্থনা শুরু করেছেন নাইট-মালকিন জুহি চাওলা। ও দিকে পঞ্জাবের সিংহরা জয়ের গন্ধে অনুরীতকে ঘিরে ধরে হুঙ্কার দিচ্ছে।

সেই উচ্ছাসেই কি মনঃসংযোগে সামান্য ফাটল ধরল প্রাক্তন নাইটের? পরের বল ফুলিয়ে ফুলটস এবং ফ্রন্ট ফুটে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটের উপর দিয়ে সেটা স্ট্যান্ডে পাঠালেন পীযূষ। স্কোর টাই। পরের কয়েক সেকেন্ড কান পাতা দায়! সঙ্গে নাইট সমর্থকদের সোনালি-বেগুনি পতাকার আস্ফালন। ইডেন যেন যশ চোপড়ার ছবির সর্ষে খেত! তিন বলে এক রান। ও তো হবেই!

Advertisement

কিন্তু খেলাটা যে ক্রিকেট! পরের বলেই চমক। যে বলটা ছেড়ে দিলে ওয়াইড অবধারিত, সেটাই তাড়া করে ঋদ্ধিমান সাহার হাতে জমা পড়ে হাঁটা শুরু করলেন পীযূষ। দুই বলে চাই এক। হাতে এক উইকেট। ম্যাচ কি তা হলে সুপার ওভারে? নারিন অবশ্য প্রথম বলেই সিঙ্গলসে উত্তর দিয়ে দিলেন।

এক দিক থেকে রবীন্দ্রজয়ন্তীর সন্ধ্যায় নারিনের হাতে উইনিং স্ট্রোক বেশ কাব্যিক হল। অ্যাকশন নিয়ে জটিলতার অবসানে ত্রিনিদাদের ছেলে যে চাপ মুক্ত, ৪-১৯ নিয়ে সেটা বুঝিয়ে দিলেন। ইনিংস বিরতিতে বলেও গেলেন, “খুব কঠিন সময়ে পাশে থাকার জন্য টিম ও সমর্থকদের ধন্যবাদ।” গতকাল তিনি নেচে শিরোনামে। এ দিন প্রতিপক্ষকে নাচিয়ে। শনিবারের নাইট বোলিংকে গত দুই ম্যাচের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে ঠিক দারুণ বলা যাচ্ছে না। তারই মধ্যে উজ্জ্বল বিচ্ছুরণ, নারিনের ফর্মে ফেরা। যে দুসরাটায় মুরলী বিজয় বোল্ড বা যে কুইকারটা ঋদ্ধির ব্যাটের তলা দিয়ে ঢুকে বোকা বানাল, সবই নারিনের বাড়ন্ত আত্মবিশ্বাসের ছোট ছোট গল্প। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্বের আগে গৌতম গম্ভীরের কাছেও যা গুমোট কাটিয়ে সন্ধ্যার ঝিরঝিরে হাওয়ার মতোই স্বস্তির।

আর দিনের শেষে পুরস্কার মঞ্চে নাইট অধিনায়কের ঠোঁটের ফাঁকে যে বিরল চিলতে হাসি, তার কারণ পাঠান-রাসেল জুটি। দু’জনের ৫৩ রানের পার্টনারশিপটাই ঘরের মাঠে লিগের শেষ ম্যাচে জয় নিশ্চিত করল। বোলিংয়ের সময় দু’ওভারে ৩৫ দিয়ে সহজ কাজ কঠিন করেছিল নাইটরা। ব্যাট হাতে পাঠান-রাসেল কঠিন কাজটা সহজও করলেন দু’ওভারেই। ৪০ তুলে। ইউসুফের ১৯ বলে ২৯-এ তিন ছক্কা, একটা চার। জামাইকান রাসেল বল হাতে চার ওভারে পঞ্চাশ দেওয়া পুষিয়ে দিলেন ২১ বলে ৫১ করে। পাঁচটা চার, চারটে ছয়! ক্যালিপসো ছন্দে ইডেন মাতানো রাসেল অবশ্য টিম এফর্টেরই জয়গান করে গেলেন। অন্য দিকে, গম্ভীর বললেন, “জয়টা অনেকটা জেল থেকে মুক্তির মতো! ওরা ১৮০ তোলায় মনে হয়েছিল ২০ রান বেশি দিয়ে ফেললাম। কিন্তু অবিশ্বাস্য খেলল ইউসুফ আর রাসেল। এই চাপের ম্যাচ জেতাটা সামনের দিনে কাজে দেবে।”

গম্ভীরকে অবশ্য প্রবল দুশ্চিন্তায় রাখতে বাধ্য নাইট ফিল্ডিং। শুরুতে যে পাঁচটা ক্যাচ পড়ল সেগুলো দুঃস্বপ্ন হয়ে শাহরুখ খানের ঘুম কাড়লে অবাক হওয়ার নেই। এমনই বিস্ময়কর ব্যাপারটা যে, এক দর্শক টুইটই করে বসলেন, “এটা মিলার আর ম্যাক্সওয়েলকে ক্রিজের বাইরে রাখার নাইট চক্রান্ত নয় তো!”

কিঙ্গস ইলেভেন এই যে ১৮৩-৫ তুলে দ্বিতীয় সেরা স্কোরটা করল। এই যে ২২ বলে ৪৩ করে ম্যাক্সওয়েল ফর্মে ফিরলেন, সবেই বড় অবদান নাইট ফিল্ডিং আর বোলিংয়ের। দিনের শেষে পঞ্জাবের বিরুদ্ধে পাঁচে পাঁচটা হল ঠিকই। কিন্তু টস করতে এসে ক্যাপ্টেন বেইলি ‘‘পেস্ট আর নুইসেন্স” হয়ে নাইটদের জ্বালিয়ে মারার যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেটা রক্ষায় কিছুটা হলেও পঞ্জাব সফল। ফাস্ট বয় বনাম লাস্ট বয় লড়াই তাই অনেকটাই গত বারের ফাইনালের স্মৃতি ফেরাল। সে বারও মিচেল জনসনকে ছয় মেরে জিতিয়ে ছিলেন পীযূষ। এ বারও তাঁর ছক্কাটাই ফারাক গড়ল।

বাঙালির সবচেয়ে বড় বার্ষিক আবেগের উদ্‌যাপন ছিল এ দিন। শুধু ইডেনের ডিস্ক জকির সংগ্রহে রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল না। তিনি যা বাজালেন তাকে মাঠে বলা হল ‘রবীন্দ্র-ভাংড়া’। জিতে অবশ্য অন্য ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ পালন করল ইডেন! তিনে তিন করে এক নম্বরের সিংহাসনে দাপটে বসে পড়ে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

কিঙ্গস ইলেভেন: ১৮৩-৫
কেকেআর: ১৮৪-৯ (১৯.৫ ওভার)

ছবি: উৎপল সরকার, শঙ্কর নাগ দাস, বিসিসিআই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন