লিগ জয়ের মুহূর্ত। ছবি: উৎপল সরকার
আর্মান্দো কোলাসোকে কেউ কখনও নাচতে দেখেছেন?
মঙ্গলবার যুবভারতীতে লাল-হলুদের গোয়ান কোচ কিন্তু নাচলেন! খুদে ফুটবলারদের সঙ্গে। দু’হাত তুলে।
শান্ত আর্মান্দোকে এ ভাবে উত্তেজিত হয়ে রেফারির সঙ্গে তর্ক করতে দেখা গিয়েছে কখনও? বা হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে? আকাশের দিকে দু’হাত তুলে?
গোয়া আর্মান্দোকে উপুড় করে সাফল্য দিয়েছে। ডেম্পোর হয়ে রেকর্ড সংখ্যক পাঁচ বার আই লিগ জয় আছে ইতিহাসের পাতায়। ফেড কাপ, ডুরান্ড, বছরের পর বছর গোয়া লিগ তা-ও তো জিতেছেন বহু বার। অধরা তো কিছুই ছিল না।
তবু তুলনায় জৌলুসহীন একটা কলকাতা লিগ জেতার পর কেন তাঁর এই বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়া?
“আমার জীবনের অন্যতম সেরা সাফল্য বলতে পারেন এই লিগ জয়। কারণ আমি যে কাজটা শুরু করলাম এ বার সেটা অন্য কোচেরা ফলো করবে। এক ঝাঁক জুনিয়র ফুটবলার খেলিয়ে সাফল্য পেয়েছি। ডুডু-র্যান্টি কম্বিনেশন দারুণ ভাবে কাজ করতে শুরু করেছে। এটাই তো আমি চাইছিলাম,” বলার সময় চেনা যায় না সেই আর্মান্দোকে। যিনি আই লিগে রেকর্ড করেও ‘ফুটবলাররাই সব’ বলতে বলতে আবেগ চেপে রেখে ঢুকে যেতেন ডেম্পো ড্রেসিংরুমে। সবার অন্তরালে। কত বার এই দৃশ্য দেখেছি।
মনে হচ্ছিল, তা হলে একটাই কারণ হতে পারে এমন আবেগের। সেই অর্থে এটাই আর্মান্দোর প্রথম কলকাতা ফুটবল-দর্শন। সে জন্যই দর্শকদের আবেগের বিস্ফোরণ এ ভাবে বোধহয় ছুঁয়ে গেল তাঁকে। করে দিয়েছে বোহেমিয়ান। গত বার কলকাতা লিগ জিতেও যে উৎসব-স্পর্শ তিনি পাননি। ডার্বি হারের চোনা লেগে গিয়েছিল তাতে। চাঁদের কলঙ্কের মতোই। কলকাতা ডার্বিকে গুরুত্ব না দিয়ে চলে গিয়েছিলেন গোয়ায়। জুনিয়র তত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়েছিল লিগ জিতেও। সে জন্যই বোধহয় এ দিন তাঁকে বলতে শোনা গেল, “এ বারের ডার্বি জয়টা লিগ জয়ের দরজা খুলে দিয়েছিল। বলতে পারেন ওটাই খেতাব জয়ের টার্নিং পয়েন্ট। সিনিয়ররা ডার্বি ম্যাচটা জিতিয়েছিল, জুনিয়ররা কাজটা শেষ করল।” বোঝাই যাচ্ছিল জুনিয়র তত্ব্ প্রতিষ্ঠিত করে লিগ জয়ের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করার তৃপ্তিতে মশগুল হয়ে আছেন তিনি।
বিশ্বকর্ম পুজোর আগের দিন। বঙ্গের সেরা উৎসবের বোধন আসন্ন। তার মধ্যেই সূর্য ডুবন্ত বিকেলে ফ্লাড লাইটের মধ্যে ছিটকে আসা রোদের টুকরো। মঙ্গলবার অদ্ভুত মোহময়ী দেখাচ্ছিল যুবভারতীকে। গ্যালারিতে জ্বলতে থাকা হাজার-হাজার কাগজের মশাল যেন এক-একটা তারা। ম্যাচের পর সে দিকে তাকিয়ে ছিলেন আর্মান্দো। অনেকক্ষণ। দেখছিলেন গ্যালারির উৎসব। রং মাখা লাল-হলুদ অসংখ্য মুখ। ব্যান্ডের সঙ্গে যাঁরা নাচছেন। গোয়ায় গগনচুম্বী সাফল্যের পরও যা দেখেননি কখনও।
পুরো ম্যাচে অদ্ভুত একটা চাপ যেন তাড়া করে বেরাচ্ছিল আর্মান্দোকে। উল্টো দিকের রিজার্ভ বেঞ্চে সুব্রত ভট্টাচার্য যখন হাতে গোনা তিন-চার বার উঠেছেন নির্দেশ দিতে, তখন পুরো নব্বই মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন লাল-হলুদের গোয়ান কোচ। ভুল করলেই প্রহ্লাদ, অবিনাশদের ডেকে মৃদু বকেছেন। রেফারি ভুল সিদ্ধান্ত দিলে তর্ক করেছেন। গোল নষ্ট করলে জলের বোতলে লাথি মেরেছেন। বোঝাই যাচ্ছিল, কলকাতা লিগকে মুখে যত দুচ্ছাই করুন, খেতাব জেতার জন্য মানসিক ভাবে আর্মান্দো কতটা মরিয়া। তাঁর কথা শুনে মনে হচ্ছিল, দু’টো জিনিস প্রমাণ করতে তিনি নেমেছিলেন। এক) ঘরোয়া লিগে জুনিয়র তত্ত্ব চালু করতে গিয়ে যে ভাবে সমালোচিত হয়েছেন, তার জবাব দেওয়া। দুই) মাঠের বাইরের তীব্র চাপেও যে ট্রফি জেতা যায় সেটা প্রমাণ করা। “মাঠে নামার আগে প্রহ্লাদ-অবিনাশদের বলেছিলাম, নিজেদের প্রমাণ করার সেরা মঞ্চ এটা। যদি পারো, তা হলে পরের টুর্নামেন্টে সুযোগ পাবে। না হলে দরজা বন্ধ এ বারের জন্য। ওরা প্রমাণ করে দিয়েছে,” বলার সময় অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি খেলে যায় মুখে।
ড্রেসিংরুমে আর্মান্দোর গোপন প্রার্থনাস্থল। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
প্রথম একাদশ-সহ দলের কুড়ি ফুটবলার আইএসএলে খেলতে গিয়েছেন। রিজার্ভ বেঞ্চ মিলিয়ে গত বারের লিগ চ্যাম্পিয়ন টিমের জনা পাঁচেক ফুটবলার আঠারো জনের টিমে। বলা যায়, বিদেশি বাদ দিয়ে এটা লাল-হলুদের তিন নম্বর টিম। সেই দল নিয়ে তীব্র চাপের মুখে টালিগঞ্জ অগ্রগামীর মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে দেওয়া। ডার্বির পর জুনিয়র দল নিয়ে টানা পাঁচটা ম্যাচ জেতা। “গত চার বারের চেয়ে এ বারের লিগ জয় অনেক কঠিন ছিল,” বলছিলেন টিমের অন্যতম সিনিয়র ফুটবলার সৌমিক দে।
এ রকম ‘দুর্বল’ টিম নিয়েও লিগ জয়ের রসায়ন কী? “একটাই রসায়ন। ছেলেদের বলেছিলাম মনের আনন্দে খেলো। কোনও চাপ নিও না,” প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই বলে দিলেন আর্মান্দো। সঙ্গে যোগ করলেন, “দেখুন সুখবিন্দরকে। কেউ চিনত? ও তো ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। প্রহ্লাদ, অবিনাশরা প্রথম খেলছে এ রকম কঠিন ম্যাচ। ওদের দেখে যে কী ভাল লাগছে। আইএফএ-র উচিত ঘরোয়া লিগে তিন জন করে অনূর্ধ্ব কুড়ি ফুটবলার খেলানো বাধ্যতামূলক করা।” এ ভাবেই সাংবাদিক সম্মলনে আর্মান্দো কত বার যে গাইলেন ‘তারুণ্যের জয়গান’।
টালিগঞ্জ যখন ১-১ করল তখন কি একটু কেঁপে গিয়েছিলেন? “একেবারেই না। আমি জানতাম ওরা পারবে,” বলতে বলতেই প্রায় উঠে পড়লেন আর্মান্দো।
আজ বুধবারই চলে যাচ্ছেন গোয়ায়। এক মাস ছুটি দিয়ে দিয়েছেন ডুডু-র্যান্টি-সহ পুরো দলকে। ফিরে এসে ফেড কাপের প্রস্তুতি শুরু করবেন। এক মাস ছুটি? এক সাংবাদিকের প্রশ্নে কটাক্ষ ঝরে পড়ে তাঁর মুখে। “আমি তো হোম সিক। আপনারাই তো লেখেন!” তার পর যোগ করেন, “এই যাচ্ছি আর হয়তো আসব না!” কোথাও কি অভিমানের বাষ্প থেকে যায় তাঁর গলায়?
ইতিহাস ছোঁয়ার আগের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে যে অভিমানের গতিমুখ পাল্টে-পাল্টে যায়। সামনে কখনও সাংবাদিক। কখনও সমর্থক। যে সমর্থকরা কোনও কোনও ম্যাচের খারাপ রেজাল্টের পর আওয়াজ তুলেছিলেন ‘আর্মান্দো হটাও মর্গ্যান লাও’, তাঁদের উদ্দেশে আপনার আজ মেসেজ কী? পুলিশ তো ম্যাচের পর তাঁদের উপর লাঠিও চালাল।
পরিচিত এক অশ্লীল গালাগালি দিয়ে আর্মান্দো বললেন, “ওরা এখনও হয়তো বলবে, ........আর্মান্দো। রাবিশ!”
মাঠের আর্মান্দোর মতো এ-ও তো এক অচেনা আর্মান্দো।
অভিমানী আর্মান্দো।
তখন
১৯৭০ মহম্মদ হুসেন
১৯৭১ স্বরাজ ঘোষ
১৯৭২ পিকে
১৯৭৩ পিকে
১৯৭৪ পিকে
১৯৭৫ পিকে
এখন
২০১০ ট্রেভর মর্গ্যান
২০১১ ট্রেভর মর্গ্যান
২০১২ ট্রেভর মর্গ্যান
২০১৩ আর্মান্দো কোলাসো
২০১৪ আর্মান্দো কোলাসো