প্রশ্ন: বাড়িতে কে কে আছেন?
উত্তর: আমার ছোট পরিবার। মা, বাবা আর ভাই। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছেন স্বামী ও আমার মেয়ে কৃত্তিকা।
প্রশ্ন: স্বামীর সঙ্গে পরিচয় কী ভাবে হল? বিয়ে কোন সালে?
উত্তর: দীপকের (দাস) সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বারাসত স্টেডিয়ামে। আগে বন্ধু ছিলাম। তারপর প্রেম হয়। বিয়ে ২০১৪ সালে। তবে ও এখনও আমার খুব ভাল বন্ধু। আমার জরায়ুতে একটা টিউমার হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর যখন আবার দৌড়তে বেরোই, ও আমার সঙ্গে বেরোত।
প্রশ্ন: দীপক খেলেন?
উত্তর: হ্যাঁ, তবে শুধু আমার সঙ্গে (হাসি)! না, ও তেমন খেলে না! তবে আমার সঙ্গে অনেক সময় মাঠে যায়, প্রশিক্ষণে যায়। ওর ব্যবসা আছে।
প্রশ্ন: খেলা শুরু কী ভাবে?
উত্তর: আমি ক্লাস টু থেকেই অ্যাথলেটিক্সে আগ্রহ ছিল। বাড়িতে ভাই ফুটবল খেলত। আমারও খুব ইচ্ছে করত ফুটবল খেলতে। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি বাবাকে ফুটবল খেলার ইচ্ছের কথাটা জানালাম। বাবা কোনও কিছুতে বাধা দেয়নি। উল্টো বাবা শুনে বলেছিলেন যে, তোমার যেটা ইচ্ছে করে, তুমি করবে। তারপর থেকে আমার খেলা শুরু হয়।
প্রশ্ন: সেখান থেকে রেফারিংয়ে কী ভাবে এলেন?
উত্তর: আমি যখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি, কলকাতায় এসেছিলাম কলকাতা লিগ খেলতে। খেলা শেষ হওয়ার পর আমি শিলিগুড়িতে ফিরে গিয়ে উত্তরবঙ্গ উৎসবে শিলিগুড়ি মহকুমার তরফ থেকে ফুটবল খেলি। ২০১১ সাল হবে। আমার গোলে দল কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমি ফাইনাল এবং ফাইনাল জেতে। আমি প্লেয়ার অফ দ্যা টুর্নামেন্টের পুরস্কারও পেয়েছিলাম। সেই সময় ক্যালকাটা রেফারিজ় অ্যাসোসিয়েশনের (সিআরএ) তৎকালীন সচিব উদয়ন হালদার জানান যে, কয়েকটা মেয়ে রেফারি লাগবে। তখন আমার স্যার ওঁকে আমার কথা বলেন। স্যারই আমাকে ডেকে আমার ইচ্ছে জানতে চান। তখন আমি বাড়ি থেকে অনুমতি নিয়ে রেফারির হওয়ার জন্য এক বছরের কোর্সে ভর্তি হই।
প্রশ্ন: এখনও পর্যন্ত আপনার খেলানো সব থেকে বড় ম্যাচ কোনটা?
উত্তর: ২০১৩ সালে কলকাতার মাঠে ইস্টবেঙ্গল-রেলওয়ে এফসিম্যাচ। এরপর মোহনবাগানকেও খেলিয়েছি।
প্রশ্ন: তারপর কী হল? কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলেন এতগুলো বছর?
উত্তর: আসলে আমার জরায়ুতে টিউমার হয়েছিল। চিকিৎসক বলেছিলেন, অস্ত্রোপচারের জন্য হাতে এক বছর সময় রয়েছে। এর মধ্যে সন্তান হয়ে গেলে ভাল হয়। অস্ত্রোপচারের পর সন্তানধারণে সমস্যা হতে পারে। তাই মাঝে একটা ব্রেক নিই আমি। ২০১৫ সালে মেয়ে হয়। ২০১৬ সালে থেকে মাঠে ফেরার প্রস্তুতি শুরু করি।
প্রশ্ন: অস্ত্রোপচারের পর মাঠে ফেরার লড়াইটা কেমন ছিল?
উত্তর: চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের সাত মাস পরে অনুশীলন করার অনুমতি দিয়েছিলেন। তবে আমি সাত মাস অপেক্ষা করতে পারিনি। ছ’মাস পরই দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছিলাম। তাতে সমস্যাও হয়েছিল। পরে অবশ্য আরও দু’মাস রেস্ট করতে হয়েছিল। আমার কিন্তু ২০১৬ সাল থেকেই আবার মাঠে ফেরার লড়াইটা শুরু হয় গিয়েছিল। আমি আগেই পুরো বিষয়টি অ্যাপ্লিকেশন করে সিআরএ-কে জানিয়ে ছিলাম। তারপর অ্যাসোসিয়েশনের ফিটনেস টেস্ট দিই। সেটা পাস করার পর আবার রেফারিংয়ের সুযোগ পাই।
প্রশ্ন: তারপর?
উত্তর: গত বছর জাতীয় মহিলা ফুটবলের অনেকগুলো প্রতিযোগিতা আমি খেলিয়েছিলাম। ২০১৮ সালেই ন্যাশনাল রেফারি হই। কলকাতা লিগেও রেফারি প্যানেলে ছিলাম।
প্রশ্ন: খেলা নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে কোনও সমস্যা হয়নি?
উত্তর: বিয়ের পর কোনও সমস্যা হয়নি ঠিকই, তবে মেয়ে জন্মানোর পর একটু সমস্যা হয়েছিল। মেয়ে হওয়ার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে খেলায় আপত্তি উঠেছিল। আসলে মেয়েটা কার কাছে থাকবে, সেই নিয়ে একটি সমস্যা হয়েছিল। তবে আমি না খেলে থাকতে পারব না। দীপক আর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলি। মা বলেন যে, মেয়ে শিলিগুড়িতে থাকবে। তারপর থেকে মেয়ে ওখানেই আছে। কিন্তু এখন আমি সত্যিই বুঝতে পারি যে, শ্বশুরবাড়ির সমস্যা ছিল না। সত্যিই তো, কৃত্তিকা তখন আরও ছোট! ওকে দেখভালের দায়িত্ব তো আমারই!
প্রশ্ন: মেয়ে বোঝে যে, মা কী করে?
উত্তর: হ্যাঁ, ও জানে যে, ওর মা খেলে। আমার খেলা টিভিতে শুরু হলেই ও নাকি টিভির সামনে দৌড়দৌড়ি শুরু করে দেয়।
প্রশ্ন: ও কি খেলতে চায়?
উত্তর: মনে হয়, খেলতে চায়। তবে আমি বা দীপক ওর উপর কিছু চাপিয়ে দেব না। ওর যদি মনে হয় যে খেলবে, খেলবে। তবে হ্যাঁ, আমি চাইব, আগে পড়াশোনাটা শেষ করুক। পড়াশোনা করা থাকলে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। আসলে কী বলুন তো, খেলা অনেকটা ভাগ্য। যদি ক্লিক না করে, তাহলে কিছু করার সুযোগ থাকে না। পড়াশোনা করা থাকলে কিছু না কিছু করতে পারবে।
প্রশ্ন: আপনার কেরিয়ার হয়তো অনেক মেয়েরই স্বপ্ন। আপনারও কি এটাই স্বপ্ন ছিল?
উত্তর: খেলা ভাল লাগে। তবে চেয়েছিলাম আরও পড়তে, উকিল হতে। এখনও চাই।
প্রশ্ন: পড়ার সুযোগ পেলে পড়বেন?
উত্তর: একদম! যদি পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ পাই, আমি সেটা করব। ওকালতি পড়ব, খুব ইচ্ছে আমার।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে কোনও ম্যাচ খেলাচ্ছেন?
উত্তর: গত শনিবার পুণের মাঠে ইন্ডিয়া ইউথ গেমসে অনুর্ধ্ব ২১ মহিলাদের ফাইনাল ম্যাচ খেলিয়েছি। তামিলনাড়ু আর মণিপুর খেলল। মণিপুর জয়ী।
প্রশ্ন: এখনও পর্যন্ত জীবন নিয়ে কোনও ক্ষোভ?
উত্তর: হ্যাঁ, তা একটা আছে। আমি খুবই সফল ভাবে বড় দলের ম্যাচ খেলিয়েছি। তা সত্ত্বেও প্রিমিয়ার লিগের কোনও ম্যাচ দেওয়া হয়নি। শুধু মাত্র চতুর্থ এবং পঞ্চম ডিভিশনের ম্যাচ দেওয়া হয়। আমার বিশ্বাস, আমি কিন্তু সব রকমের ম্যাচই ভাল ভাবে খেলাতে পারি। তবে বুঝতে পারি না যে, কেন আমাকে ম্যাচ দেওয়া
হচ্ছে না।
প্রশ্ন: এর কোনও কারণ আছে বলে আপনার মনে হয়?
উত্তর: হতে পারে, মাঝে প্রায় আড়াই তিন বছর রেফারিংয়ে ছিলাম না। সে কারণে হতে পারে।
প্রশ্ন: ফেরার পর বড় ম্যাচ...
উত্তর: (প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়ে ) জিটিএ চেয়ারম্যান কাপের ফাইনাল আমার জীবনে একটা মাইলস্টোন। আমার মনে হয়, সেদিনের ওই ইস্টবেঙ্গল-মহামেডানের ম্যাচটা একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। ওটা খেলানোর আমার কনফিডেন্স অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, যেন লড়ার ছন্দ ফিরে পেয়েছি।
প্রশ্ন: মাঠে কোনও দিন কোনও বিতর্ক হয়ছিল?
উত্তর: হ্যাঁ, তা একবার হয়েছে। তবে সে সব মনে না রাখাই ভাল। ও সব পুরনো কথা।
প্রশ্ন: আচ্ছা, যে দল ম্যাচ হেরে যায়, তাঁদের সমর্থকদের কাছে আপনারা, মানে রেফারিরা সব সময়ই ভুল। শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। এ সব সামাল দেন কী ভাবে?
উত্তর: দেখুন, দোষ তো আর ওদের নয়। ফুটবল খেলাটা শুধুমাত্র খেলা নয়, সমর্থকদের কাছে ওটা একটা আবেগ। কিছু করার থাকে না। আসলে নিয়ম মেনে আমাদের অনেক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সব নিয়ম তো আর সমর্থকেরা জানেন না। তাই অনেক সময় তাঁরা রিঅ্যাক্ট করেন।