যুদ্ধের আগে। শনিবার প্র্যাকটিসে দুই কোচ মলিনা এবং জিকো। -শঙ্কর নাগ দাস ও উৎপল সরকার
কলকাতার ক্যাপ্টেন বোরহাকে ছাড়ব না। ওর টিমকে মারবই!
কথাগুলো বলেই এক বার চোখ টিপলেন। তার পর হো হো করে ফেটে পড়লেন অট্টহাসিতে।
শনিবার দুপুর আড়াইটে। বাইপাসের ধারে অভিজাত হোটেলে আনন্দবাজারের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন এফসি গোয়ার মিডিও জোফ্রে ম্যাতিউ। আড্ডার ফাঁকে আচমকা এটা বলতে শোনা গেল তাঁকে।
আইএসএলের শুরু থেকেই টুর্নামেন্টের অন্যতম মুখ জোফ্রে। গত তিন বছরে খুব কাছ থেকে দেখেছেন কলকাতা-গোয়া ম্যাচের সব রক্তাক্ত অধ্যায়। গ্রেগরি-ফিকরুর ‘হেডবাট’, পিরেস-হাবাস হাতাহাতি, বলজিৎ-গ্রেগরির মাথা ঠুকে রক্তস্নাত হওয়া, পছন্দসই মাঠ না পেয়ে আইএসএলের কাছে এটিকের বিরুদ্ধে জিকোর নালিশ, আইএসএল ফাইনালে উঠে হাবাসের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো ‘এক সে বড়কর এক’ সব ঘটনা।
রবিবার রবীন্দ্র সরোবরে আইএসএল থ্রি-র সেই বহুচর্চিত এটিকে বনাম এফসি গোয়া ম্যাচেও কি তা হলে জোফ্রে নতুন ‘নিউজ মেকার’ হতে চলেছেন? এ বার ইয়ার্কির মেজাজ থেকে গম্ভীর মোডে ঢুকে পড়েন জোফ্রে। বলেন, ‘‘কলকাতার সবাই আমার বন্ধু। এ বার মনে হয় না সে রকম কিছু হবে।’’ এটিকে ক্যাপ্টেন বোরহার প্রতিক্রিয়া আরও নির্বিষ। ‘‘ওদের প্লেয়ারদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুব ভাল। কোনও টেনশন নেই।’’
যে ম্যাচ ঘটনার ঘনঘটা হয়ে থাকে আইএসএলে। সেই হাইভোল্টেজ ম্যাচের আগে এ রকম নিশ্চিন্ত পরিবেশ হল কী ভাবে? নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এটিকের এক সদস্য হোটেলে বললেন যে, এটিকে কোচের নামটাই তো পাল্টে গিয়েছে! হাবাস থাকলে এক রকম, না থাকলে আর এক। এটা ঠিক, গত কয়েক বছরে কলকাতার পূর্বতন কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের সঙ্গে জিকোর সম্পর্ক ছিল সাপে-নেউলে। মুখোমুখি হওয়া তো দূরঅস্ত। একজন সাংবাদিক সম্মেলন করে এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অন্য জন দেখা দিতেন। কিন্তু শনিবার লক্ষ্মীপুজোর সকালে যে সম্পূর্ণ অন্য ছবি। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে মলিনার সঙ্গে পোজ দিলেন গোয়া কোচ জিকো। অভিভূত আটলেটিকো কোচ জোসে মলিনার প্রতিক্রিয়া, ‘‘আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াটাই একটা বিশেষ মুহূর্ত।’’ জিকোরও পাল্টা জবাব, ‘‘আপনিও একজন দারুণ ব্যক্তিত্ব।’’
এ যদি হয় গোয়া-কলকাতা তিক্ত সম্পর্কে বরফ গলার মাঠের বাইরের গল্প। মাঠের মধ্যের গল্পটা কিন্তু অন্য। একে, গোয়ার টানা তিন ম্যাচ হেরে লিগ টেবলের লাস্ট বয় হয়ে যাওয়া। তার উপর লিও মউরার মতো পাসার আর বিক্রমজিৎ বা প্রণয়ের মতো ভারতীয় স্ন্যাচার— কেউ নেই। গত কয়েক বছর যাঁরা অফুরান সার্ভিস দিয়েছিলেন। সব শেষে সেই আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের নয়া টিম এফসি পুণে সিটির বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তের গোলে সম্মানের যুদ্ধে হার। জিকো তাই একটু মনমরা। তবে রসবোধটা অটুট। সাংবাদিক সম্মেলনে মাইক্রোফোন গড়বড় করতেই বলে বসলেন, ‘‘আমাদের টিমের মতোই অবস্থা দেখছি!’’
কলকাতা সেখানে পাঁচ পয়েন্ট নিয়ে চতুর্থ স্থানে। সঙ্গে গোয়ার বিরুদ্ধে না হারার রেকর্ড। জিকোকে সে কথা মনে করিয়ে দিতেই ভিতরের সেই প্রতিশোধের ছাইচাপা আগুনটা হঠাৎ যেন জেগে ওঠে। গোয়া কোচ বলে দেন, ‘‘কাল জিতলেই কিন্তু কলকাতার ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলব। আর আইএসএলে কে ফার্স্ট আর কে ফোর্থ তা বিচার্য নয়। মোদ্দা কথা হল শেষ চারে লিগ শেষ করতে হবে। তার পর প্লে অফে ট্রফি শিকারে ঝাঁপানো।’’ সঙ্গে এটাও শুনিয়ে দিলেন, ‘‘আমাদের সবাই ফিট।’’
যদিও অসুস্থ বোধ করায় এ দিন লুসিও অনুশীলনে যাননি। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি কলকাতাকে নিয়ে হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে বুঝেছেন মলিনার টিমের ইউএসপি অ্যাটাকিং ফুটবল। আর সেটা মাথায় রেখে বলছেন, ‘‘কলকাতার অ্যাটাক বেশ ভাল! ওটা ভোঁতা করতে আমাদের ডিফেন্সকে সেরা পারফরম্যান্স করতে হবে। মিডল থার্ডে জোনাল মার্কিংটাই আমাদের ‘ফিলোজফি’।’’
গোয়ার এই মরিয়া ভাবটাকেই আবার ভয় আটলেটিকো কোচ মলিনার। চোটের জন্য নেই মার্কি পস্টিগা, তিরি এবং নাতো। চিন্তিত এটিকে কোচ তাই বলে বসেন, ‘‘গোয়া পয়েন্টের জন্য মরিয়া হবেই। আমাদের কাজটা তাই আরও কঠিন। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হলে চলবে না।’’
রবিন সিংহ, ত্রিনদাদ গনসালভেজদের সামলাতে তাই এ দিন তড়িঘড়ি নাম নথিবদ্ধ করানো হল লা লিগা ও বুন্দেশলিগায় খেলে আসা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর একদা সতীর্থ পর্তুগিজ স্টপার হেনরিক সেরেনোকে। সাংবাদিক সম্মেলনে এটিকে কোচেরও ইঙ্গিত স্টপারে অর্ণবের সঙ্গে সেরেনোকে নামিয়ে দেওয়ার। লিগ টেবলে আহত বাঘ গোয়াকে কব্জা করতে কলকাতার স্প্যানিশ কোচের অস্ত্র — জাভি লারা, হিউম, দ্যুতির ত্রিভূজ। আর তা দিয়েই গোয়ার বিরুদ্ধে অপরাজিত থাকার রেকর্ড অক্ষুণ্ণ রাখতে চান মলিনা।
নিউজ মেকার নয়। ঘরের মাঠে কলকাতা কোচের মোক্ষ যে তিন পয়েন্ট!