একটা টেস্ট ম্যাচ যে ভাবে তার রং পাল্টায়, যে ভাবে সে চতুর্থ দিনে শেষ হয়ে যাওয়ার প্রভূত ইঙ্গিত দিয়ে অপ্রত্যাশিত চমকে চলে যায় পঞ্চম দিনের অন্তিম সেশনে, সুপ্রিম কোর্টে ভারতীয় বোর্ড বনাম লোঢা কমিশন যুদ্ধকে ঠিক যেন তেমনই দেখাচ্ছে। সোমবার দুপুর দু’টোর আগে পর্যন্ত বোর্ডের যে পর্যদুস্ত দশা ছিল, তা বোধহয় ভারত সফররত কেন উইলিয়ামসনের টিমের চেয়েও খারাপ। ফলো অন খেয়ে আট উইকেট চলে গিয়েছে। হার এবং হারই একমাত্র ভবিতব্য। এবং শেষ দু’টো উইকেটও যাবে, পড়বে যে কোনও সময়।
কিন্তু পড়ল না।
সোজাসুজি বললে, সোমবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতে অপ্রত্যাশিত ‘লাইফলাইন’ পেয়ে গেল অনুরাগ ঠাকুরের ভারতীয় বোর্ড। প্রেসিডেন্ট অনুরাগ ঠাকুর-সহ অন্যান্য বোর্ড শীর্ষকর্তাকে হটানোর যে আবেদন তুলেছিল লোঢা কমিশন, তার রায় মুলতুবি রেখে দিল সুপ্রিম কোর্ট। অনুরাগদের সরিয়ে দেওয়াকে ‘চরম পদক্ষেপ’ হিসেবে উদ্ধৃত করে, বোর্ডকে লোঢা সংস্কার আমদানির বাড়তি সময় দিয়ে। আদালত-কক্ষে বোর্ড আইনজীবী এ দিন আবেদন করেন যে, দেশের সমস্ত রাজ্য ক্রিকেট-সংস্থাকে লোঢা সংস্কার মানতে বাধ্য করতে বোর্ডের আরও কিছুটা সময় লাগবে। সেই সময়টুকু বোর্ডকে দেওয়া হোক। সুপ্রিম কোর্ট তা নিয়ে আপত্তি তোলেনি। কিন্তু সঙ্গে জানতে চেয়েছে, কত দিন? লোঢা সংস্কার আনতে কত দিন লাগবে বোর্ডের। ভারতীয় বোর্ডকে যা এ বার জানাতে হবে।
যে পট পরিবর্তন নাটকীয় তো বটেই, কিছুটা অপ্রত্যাশিতও। দেশবাসী ধরে রেখেছিল, আজই আসছে। গত অষ্টাশি বছরে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড যা কখনও দেখেনি, সোমবার তা দেখবে। সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায়ে ধুলিসাৎ হয়ে যাবে এত দিনের বোর্ড মসনদ। প্রেসিডেন্ট অনুরাগ ঠাকুর, সচিব অজয় শিরকে-সহ বর্তমান বোর্ড শীর্ষকর্তাদের হটিয়ে দেওয়া হবে। অভূতপূর্ব ভাবে নিয়ে আসা হবে অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের প্যানেল। যারা লোঢা কমিশনের সঙ্গে বসে সংস্কার আনবে দেশের ক্রিকেট প্রশাসনে। তৈরি হবে ক্রিকেট-প্রশাসনের নতুন রূপরেখা। গঠন হবে নতুন ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু তা হল না। অনুরাগদের বিদায় যেখানে সোমবার দুপুরের পর নিশ্চিত বলে মনে করা হচ্ছিল, তাঁরা আজকের পর কিছুটা সময় পেয়ে গেলেন। কিন্তু তাই বলে চিরমুক্তি মোটেও হল না।
বিচারপতি টিএস ঠাকুরের কাছে বোর্ডকে বলতে হবে, কত দিনের মধ্যে তারা লোঢা সংস্কার সম্পন্ন করতে পারবে। রায় হয়তো আজ আসেনি, কিন্তু যা খবর চলতি সপ্তাহেই আসতে পারে যে কোনও দিন। পিটিশনার আদিত্য বর্মার মতো কেউ কেউ নয়াদিল্লি থেকে ফোনে বললেন যে, মঙ্গলবার বোর্ডের রিভিউ পিটিশন নিয়ে সিদ্ধান্তের পরেই রায় বেরোতে পারে। এবং সেই রায়ে বর্তমান বোর্ড শীর্ষকর্তাদের ‘গিলোটিনে’ যাওয়ার আশঙ্কা এখনও আছে। কিন্তু এটাও ঠিক, বোর্ড শেষ দু’উইকেট নিয়ে নাটকীয় ভাবে টেস্ট ম্যাচকে পঞ্চম দিনে নিয়ে যেতে পেরেছে। কিছুটা হলেও নরম করতে পেরেছে আদালতকে।
আদালতে এ দিনও বিচারপতিদের শাসনের চাবুক হজম করতে হয়েছে বোর্ডকে। অনুরাগ ঠাকুর এবং রত্নাকর শেঠির হলফনামা নিয়ে একপ্রস্থ হয়েছে। বিচারপতিরা বলে দেন যে, ঠাকুরের হলফনামায় দেখা যাচ্ছে তিনি স্বীকার করেছেন যে, আইসিসি চেয়ারম্যান শশাঙ্ক মনোহরের কাছ থেকে তিনি একটা চিঠি চেয়েছিলেন। কিন্তু শেঠি আবার নিজের হলফনামায় তা অস্বীকার করেছেন। দু’টোয় তো কোনও মিলই নেই। শুধু তাই নয়, বোর্ডকে ‘উদ্ধত’ এবং ‘বাধাপ্রদানকারী’ হিসেবেও চিহ্নিত করে আদালত। দেশের প্রধান বিচারপতি টিএস ঠাকুরকে বলতে শোনা যায়, ‘‘লোঢা সংস্কার নিয়ে আপনারা প্রত্যেক পদে বাধা সৃষ্টি করছেন।’’ অনুরাগদের সরানোর দাবি— এ দিনও তুলেছিলেন লোঢা কমিশন আইনজীবী। কিন্তু তার পরেও অনুরাগদের বোর্ড মসনদ থেকে হটানোর প্রশ্নে দেশের প্রধান বিচারপতি কমিশন আইনজীবীকে বলেছেন যে, সেটা চরম পদক্ষেপ হয়ে যাবে। বরং আর কোনও উপায় আছে কি না, তা দেখতে বলা হয়।
‘কাঙ্খিত’ সময় পাওয়া এবং আদালতের মৃদু নরম মনোভাব দেখে দেশের ক্রিকেট কর্তাদের কেউ কেউ দেখা গেল স্বস্তিতে। এঁদের আশা, বিচারপতিরা হয়তো সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন বলেই চরমপন্থী কোনও রায় দেননি। এ দিনের শুনানির পর বোর্ড প্রেসিডেন্ট অনুরাগ ঠাকুর বলে দেন, ‘‘আমাদের যে আরও কিছুটা সময় লাগবে, সেটা তো সত্যি। আর আমরা যে সংস্কারে ইচ্ছুক নই, এমন নয়। আমাদের দায়িত্ব ছিল, সমস্ত রাজ্য সংস্থাকে ডেকে এটা বলা। সেটা আমরা করেছি। কিন্তু তিন-চতুর্থাংশ গরিষ্ঠতা লাগবে সংস্কার পাশ করানোর জন্য। সেটা না পেলে কী করব?’’
ঘটনা হল, সোমবারের পর এ সব ‘কী করব’, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন’ প্রভৃতি মন্তব্যের জায়গা বোধহয় খুব কমই আছে। বাড়তি সময় পেয়ে বোর্ড কর্তাদের উল্লসিত হওয়ার বিশেষ কারণও নেই। কারণ— এই মুক্তিতে শর্তাবলী প্রযোজ্য। বোর্ড আইনজীবী এ দিন আদালতে দাঁড়িয়ে বলে এসেছেন যে, লোঢা সংস্কার নিয়োগের সময়সীমা জানাবে বোর্ড। সঙ্গে এটাও জানাবে, লোঢা সংস্কারের কোন কোন বিষয়গুলো মানতে অসুবিধে হচ্ছে এবং কোথায় হচ্ছে। এবং বাস্তব হল, এর পর যদি নতুন টালবাহানা উপস্থিত হয়, কী ঘটবে বলা যায় না।
সোমবারের সুপ্রিম কোর্ট তাই বোর্ডের কাছে নতুন জীবন ঠিকই, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ কখনও নয়। আদতে সংক্ষিপ্ত, শর্তসাপেক্ষ এই জীবন!