শাসকদের সাহায্যে বাগান ফের শাসকদেরই হাতে

সুব্রত ভট্টাচার্য কী শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের কাছেই? একুশে জুলাই ধর্মতলায় তৃণমূলের শহিদ দিবসের সভায় বক্তৃতা করেছিলেন রাজ্যের সফলতম ফুটবলার-কোচদের অন্যতম সুব্রত। এক বছর আগে তাঁরই হাতে ক্রীড়ারত্ন তুলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রবিবারের মোহনবাগান নির্বাচনে সেই সুব্রত এবং তাঁর তৈরি প্যানেলকে হারাতে নিজের দলকে কার্যত পুরোই নামিয়ে দিয়েছিলেন মমতা।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৫ ০২:৪২
Share:

উত্তেজিত সুব্রতকে থামাচ্ছেন সত্যজিৎ। রবিবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

সুব্রত ভট্টাচার্য কী শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের কাছেই?

Advertisement

একুশে জুলাই ধর্মতলায় তৃণমূলের শহিদ দিবসের সভায় বক্তৃতা করেছিলেন রাজ্যের সফলতম ফুটবলার-কোচদের অন্যতম সুব্রত। এক বছর আগে তাঁরই হাতে ক্রীড়ারত্ন তুলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রবিবারের মোহনবাগান নির্বাচনে সেই সুব্রত এবং তাঁর তৈরি প্যানেলকে হারাতে নিজের দলকে কার্যত পুরোই নামিয়ে দিয়েছিলেন মমতা।

নির্বাচনের আগে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বাগানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দরবার করেছিলেন বিরোধীগোষ্ঠীর ফুটবল সচিব পদে দাঁড়ানো সুব্রত। চেয়েছিলেন মমতার সাহায্য। একান্ত সভা সেরে বেরিয়ে ‘বাগানের বাবলু’ সে দিন দাবি করেছিলেন, মমতা তাঁকে কথা দিয়েছেন সাহায্য করবেন।

Advertisement

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ঘটল উল্টোটাই!

সুব্রত নয়, তৃণমূল সুপ্রিমোর সমর্থন পেলেন তাঁর দুই প্রাক্তন সাংসদ টুটু বসু-সৃঞ্জয় বসুদের নেতৃত্বাধীন মোহনবাগান শাসকগোষ্ঠী। কারণ, সুব্রতর পর মমতার আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলেন যে তাঁর দলের পদত্যাগী সাংসদও। তাই ফুটবল-সচিব পদে আর বসা হল না সুব্রত ভট্টাচার্যের। সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে তিনি হারলেন ১৭০১ ভোটে। সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায় পেয়েছেন ৩৩১২ ভোট। আর সুব্রত পেলেন ১৬১১ ভোট। ৩৭১৩ ভোট পেয়ে সচিব পদ ফের দখলে রাখলেন অঞ্জন মিত্র। তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বলরাম চৌধুরী পেয়েছেন ১২৮৯ ভোট। সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু নির্বাচিত হয়েছেন ৩৭৭২ ভোট পেয়ে। অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত পেয়েছেন ৩৫৪৪ ভোট।

ভোটের আগে বিরোধীগোষ্ঠীর হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে পড়া তৃণমূলের বিধানসভার চিফ হুইপ থেকে বিধায়ক, মেয়র পারিষদ থেকে বিধানগরের কাউন্সিলর— সবাইকে নানা ভাবে নির্দেশ পাঠিয়ে নাম প্রত্যাহারে বাধ্য করেছিল তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। আর নির্বাচনের দিন দেখা গেল পাড়ায় পাড়ায় তৃণমূলের বহু দলীয় অফিস থেকে বাগানের শাসকগোষ্ঠীর ভোটারদের পাঠানো হচ্ছে ভোট দিতে। বিলোনো হচ্ছে প্যানেল। মন্ত্রী, মেয়র, বিধায়করা ভোট দিলেন শাসকদের ভোট-ক্যাম্পে চা-জল খেয়ে। তাদের সঙ্গে গলাগলি করে। আর শাসকদের শিবির হয়েছিল কোথায়? ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে! যেখানে খেলা-মেলা হলেও ময়দানের কোনও ক্লাব বা সংস্থার নির্বাচনে কখনও কোনও পক্ষের হয়ে যা ব্যবহার হয়নি। আগে ময়দানের বহু নির্বাচনে রাজ্যের শাসকদল জড়িয়েছে। তবে সেটা কেউ ব্যক্তিগত ক্ষমতা দেখিয়ে বা কেউ আড়াল থেকে। কিন্তু এ ভাবে একটা রাজনৈতিক দল ও তাদের প্রশাসন কখনও প্রকট ভাবে সাহায্য করেনি ময়দানের কোনও ক্লাবের ভোটে লড়া একটি অংশকে। সেটা কতটা প্রবল ভাবে হয়েছে তা ভোট দিয়ে বেরোনোর সময় প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পরিষদ অতীন ঘোষ। যিনি বাগান নির্বাচনে বিরোধী গোষ্ঠীর প্যানেলে প্রার্থী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত দলের চাপে সরেও দঁড়িয়েছিলেন। ‘‘খুব খারাপ লাগছে ব্যালটে নাম থাকলেও ভোটে অংশ নিতে পারলাম না বলে। মেয়রের চাপে আমাকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করা হয়েছে,’’ ভোট দিয়ে বেরিয়ে বলছিলেন ক্লাবে শাসকদের বিরুদ্ধে এই সে দিনও সবচেয়ে সরব মুখের তৃণমূল নেতা। আর মুখে কুলুপ এঁটে বেরিয়ে গেলেন সল্টলেকের আর এক তৃণমূল কাউন্সিলর, শেষবেলায় দলের চাপে নাম তুলে নেওয়া বাণীব্রত বন্ধ্যোপাধ্যায়। অথচ ভোট যুদ্ধে থেকে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর ছোট ভাই।

বিরোধী গোষ্ঠী থেকে দলের নেতাদের সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলেও শাসকগোষ্ঠীর নির্বাচনী সভায় কিন্তু প্রতিদিন দেখা গিয়েছে তৃণমূল নেতাদের ভিড়। হাওড়ার মেয়র, সেখানকার একাধিক মন্ত্রী-বিধায়ক, উত্তর কলকাতার দুই বিধায়ক এবং কাউন্সিলর টুটু-দেবাশিসদের পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটার পাঠিয়েছেন ফোনে ডেকে ডেকে।

রাজ্যের শাসকদলের ধাক্কায় ভোটের আগেই সব দিক অনেক পিছিয়ে ছিলেন বিরোধীরা। তাদের সংগঠনও তেমন ছিল না। অনেকেই ইচ্ছে থাকলেও প্রকাশ্যে আসতে চাননি ভয়ে। তবুও মোহনবাগানের ঘরের ছেলে হিসেবে এবং ক্লাবকে সাফল্য এনে দেওয়ার জন্য সুব্রত ভেবেছিলেন ভোটে জিতবেন ব্যক্তিগত ক্যারিসমায়। রাত সোয়া ন’টায় যখন শাসকদলের তাসা-ব্যান্ড পার্টির বিশাল উৎসবের মধ্যে সুব্রত স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল বিধ্বস্ত এক প্রতিবাদী ট্র্যাজিক চরিত্র। যিনি সঙ্গীহীন, একা।

শাসকগোষ্ঠীর কর্তারা স্বীকার করে নিয়েছেন তাদের লড়াইটা বিরোধী গোষ্ঠীর কুড়ি জনের প্যানেলের সঙ্গে ছিল না। ছিল একজনের বিরুদ্ধেই—সুব্রত ভট্টাচার্য। শাসকদের ভোট সংগঠনে যিনি ছিলেন ‘ক্যাপ্টেন’ সেই অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত বলছিলেন, ‘‘বাবলুদা আমাদের ক্লাবে সব সময়ই ফ্যাক্টর। ও দাঁড়িয়েছিল বলেই আমাদের সব শক্তি দিয়ে নামতে হয়েছিল। ও না দাঁড়ালে কোনও লড়াই-ই হত না।’’ গত দু’দশক মোহনবাগান ক্লাব পরিচালনায় বহু চর্চিত ‘চারমূর্তি’র (টুটু-অঞ্জন-সৃঞ্জয়-দেবাশিস) অন্যতম মগজাস্ত্র যে সঠিক সেটা প্রমাণিত ভোটের বিচারেই। হেরে যাওয়া বিরোধীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন কিন্তু সুব্রতই।

তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠে গেল সুব্রত কী সঠিক প্যানেলে দাঁড়িয়েছিলেন? নিজে নিয়মিত মাঠে গেলেও সুব্রতর শিবিরে যাঁরা ভোট-যুদ্ধে নেমেছিলেন তাদের বেশির ভাগের সঙ্গে বাগান তাঁবুর সম্পর্ক-ই নেই। অনেকেই নিয়মিত মাঠে আসেন না। সেটা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে শাসকগোষ্ঠী। সচিব অঞ্জন মিত্র অসুস্থতার জন্য ভোট যুদ্ধে নামেনইনি। টুটু বসু বেশিরভাগ সময় ছিলেন বিদেশে। দুই নেতার অবর্তমানে পুরো ভোটপর্ব সামলেছেন দেবাশিস। আদালত থেকে ভোটার আনা, বিরোধীদের নানা ভাবে দুমড়ে দেওয়ার অঙ্কের প্রয়োগ—সবই করেছেন। সব সময় তাঁর সঙ্গী হয়েছেন সৃঞ্জয়। টুটু-অঞ্জনদের ছবি সামনে রেখে ‘আমরা করব জয়’ শ্লোগান তুলে ফের বাগানের ক্ষমতায় শাসকদের ফিরিয়ে এনেছেন দেবাশিস-সৃঞ্জয়ের সাংগঠনিক দক্ষতা। সেটা কতটা? ভোট জিততে হাজার হাজার কর্মীর সঙ্গে নিজেদের পরিবারের সদস্যকেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন প্যানেল হাতে ভোট কেন্দ্রের সামনে। তাঁদের সৌজন্যেই শৈলেন মান্না, চুনী গোস্বামীর পর ফের ফুটবল সচিব পদে এলেন এক ফুটবলার-- সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বহু বছর পর।

সত্যজিতের পরম্পরা রক্ষার দিনে বাগান সদস্যদের কাছে ব্রাত্য রয়ে গেলেন আর এক ঘরের ছেলে।

সুব্রতর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন