চর্চা: চলতি টেস্ট সিরিজে ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানদের কাছে ক্রমে আতঙ্ক হয়ে উঠছেন যশপ্রীত বুমরা। (ডান দিকে) আক্রান্ত: বুমরাদের শর্ট বলে এই ভাবেই বিব্রত ইংল্যান্ড। ফাইল চিত্র
ডেভিড বেকহ্যামের ফ্রি-কিকের অনুকরণে তাঁর জন্যও তৈরি হয়েছিল স্লোগান ‘বেন্ড ইট লাইক অ্যান্ডারসন’। ইংল্যান্ডের সমর্থক গোষ্ঠী ‘বার্মি আর্মি’ সব চেয়ে বেশি গান লিখেছে তাঁকে নিয়ে। চলতি সিরিজের প্রথম দু’টি টেস্টে ইংল্যান্ডের সুইং সম্রাট সেই গানের গলাকে আরও সুরেলা করে তুলেছিলেন।
ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টের পরে দেখেশুনে যদিও মনে হচ্ছে, সিরিজের প্রধান স্লোগান পাল্টে গিয়েছে। ‘বেন্ড ইট লাইক অ্যান্ডারসন’ থেকে শিরোনামে এখন ‘বুম বুম বুমরা’। যদি প্রশ্ন করা হয়, এই মুহূর্তে ভারত বনাম ইংল্যান্ড সিরিজের সব চেয়ে আলোচিত জোরে বোলারের নাম কী, তা হলে উত্তর জেমস অ্যান্ডারসন হবে না। উত্তর হবে যশপ্রীত বুমরা।
চোট সারিয়ে ফিরে মাত্র একটি টেস্ট খেলার পরে বুমরাকে নিয়ে রুটদের দেশে যা তোলপাড় চলছে, তা কখনও কোনও ভারতীয় বোলারকে নিয়ে হয়নি। এমনকি, কপিল দেবকে নিয়ে নয়, চন্দ্রশেখরকে নিয়েও নয়।
বিস্ময়কর শোনাতে পারে। কারণ, তিন টেস্টে ১৭ উইকেট নিয়ে অ্যান্ডারসনই এখনও দু’দল মিলিয়ে সর্বোচ্চ উইকেটসংগ্রাহক। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইশান্ত শর্মা ছয় উইকেটে পিছিয়ে। তাঁর শিকার সংখ্যা ১১। বুমরা শুধু ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্ট খেলেছেন। তাঁর সংগ্রহে সাত উইকেট। এর মধ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে রয়েছে ৮৫ রানে পাঁচ উইকেট। কিন্তু উইকেট সংখ্যার বিচারে নয়, প্রভাবের দিক থেকে তিনি সকলকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। ট্রেন্ট ব্রিজে তাঁর দুরন্ত গতি এবং ভয়ঙ্কর বাউন্স দেখার পরে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট মহলে রীতিমতো ভূকম্পন ঘটিয়ে দিতে পেরেছেন বুমরা। কখনও কোনও ভারতীয় পেসারের গতি এবং বাউন্সকে ঘিরে কোনও বিদেশি দলের চারপাশে এমন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হতে দেখা যায়নি। সাধারণত এ রকম প্রশ্ন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্যই বরাবর বরাদ্দ থেকেছে যে, বিদেশে গিয়ে এক্সপ্রেস গতির বোলারদের খেলার সাহস ও দক্ষতা তাঁদের আছে কি না।
কী করছেন বুমরা যে, ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানদের তাঁদের সামনে দিশেহারা দেখাচ্ছে? ক্রিজের কোণ থেকে দুর্বোধ্য অ্যাকশনে এমন জায়গায় বল রাখেন তিনি যে, ডান হাতি ব্যাটসম্যানের জন্য সাক্ষাৎ মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয় সেই বলগুলি। তাঁর গতির ধরনকে বলা হচ্ছে ‘স্লিপারি পেস’। অর্থাৎ বল পিচে পড়ে পিছলে যাওয়ার মতো দ্রুতগতিতে শরীরের দিকে চলে আসে। ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার গতিবেগে চকিতে অফকাট করে পাঁজরের দিকে তাঁর গোলা ধেয়ে আসতে পারে। আবার শেষ মুহূর্তে বাইরের দিকে চলে যেতে পারে অথবা সোজা বেরিয়ে যেতে পারে। ব্যাটসম্যানেরা এই কারণে দ্বিধায় ভোগেন, বুমরার অফস্টাম্পের উপরে পড়া বলগুলো খেলবেন না ছাড়বেন। বড় ব্যাটসম্যানেরা অনেক সময়ে বোলারের হাত দেখে আগে থেকেই বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন, কী ধরনের বল আসতে পারে। কিন্তু আড়ষ্ট থাকা হাত নিয়ে বুমরার বোলিং অ্যাকশনই এমন খটমট যে, তাঁর হাতে লুকিয়ে থাকা বল দেখা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
‘লগান’-এর সেই ‘কাচরা’-র মতোই ইংল্যান্ডকে একই সঙ্গে আতঙ্ক এবং প্রহেলিকার মধ্যে রেখেছেন বুমরা। টেনিস বলে খেলতে খেলতে এই অ্যাকশন পেয়েছিলেন তিনি। সাবেকি ক্রিকেটের যুগ হলে নিশ্চয়ই কোনও কপিবুক কোচ তাঁর অ্যাকশন পাল্টে দিতেন। কিন্তু টি-টোয়েন্টির আমলে মাত্র কয়েক বছরেই আইপিএলের হাত ধরে অবিশ্বাস্য উত্থান ঘটে তাঁর। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ওপেন ক্যাম্প থেকে এই রত্ন তুলে আনেন প্রাক্তন কোচ জন রাইট। তার পর মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে লাসিথ মালিঙ্গার মধ্যে আদর্শ ‘গুরু’ পেয়ে যান তিনি। বোমাবর্ষণের মতো এক্সপ্রেস গতির বাউন্সার এবং ইয়র্কার নিক্ষেপের জন্য যাঁর নামকরণ হয়েছে ‘বুম বুম বুমরা’।
ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যান জো রুট পর্যন্ত বুমরা-রহস্যের কুলকিনারা খুঁজে পাননি ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে। পরিসংখ্যান বলছে, তৃতীয় টেস্টে রুটকে ৩৩টি বল করেছেন বুমরা। তার মধ্যে ১২টিতে হয় তিনি খোঁচা দিয়েছেন নয়তো পরাস্ত হয়েছেন। ইংল্যান্ডের উপরের দিককার ব্যাটিং নিয়ে এমনিতেই বিস্তর কথা উঠে গিয়েছে। অ্যালেস্টেয়ার কুক রান পাচ্ছেন না। অন্য ওপেনার কিটন জেনিংস রান পাচ্ছেন না। রুট মোটেও বিরাট কোহালির মতো ফর্মে নেই। অতীত ইতিহাস অনুযায়ী, সাউদাম্পটনে আরও বেশি গতি এবং বাউন্স থাকতে পারে। যদি সে রকমই পিচ থাকে, ফর্মে না থাকা ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ের জন্য চতুর্থ টেস্টে বুমরা বিভীষিকা আরওই বাড়তে পারে।
ভারতীয় দলের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী ট্রেন্ট ব্রিজে জেতার পরে স্বীকার করে যান, ‘‘বুমরার না থাকাটা আমাদের ভুগিয়েছে। এখন তো দেখাই যাচ্ছে আমরা কেন ওকে ফিরে পেতে এত উদগ্রীব ছিলাম।’’ শাস্ত্রীর ব্যাখ্যা, ‘‘অন্য রকম অ্যাকশনের জন্য ওকে খেলা আরও কঠিন। এক্সপ্রেস গতি রয়েছে। সঙ্গে ভয়ঙ্কর বাউন্স। যেটা যে কোনও ব্যাটসম্যানকে নাড়িয়ে দিতে পারে।’’
দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ থেকে বুমরাকে টেস্টে খেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শাস্ত্রী-কোহালিরা। শুরু থেকেই সিদ্ধান্ত সুপারহিট। মাত্র দু’টি সিরিজেই বুমরা এখন সকলকে ছাপিয়ে টেস্টেও ব্রহ্মাস্ত্র! নিশ্চিত থাকা যায়, লন্ডনে ছুটি কাটানোর ফাঁকে শাস্ত্রী তাঁর বোলিং কোচ বি অরুণকে নিয়ে আরও ভাল করে ভিডিয়ো বিশ্লেষণ করেছেন ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ের। কী ভাবে ক্রিস ওকসকে মাথা বাঁচানোর জন্য ব্যাট এগিয়ে দিতে হয়েছে, সেই দৃশ্যের উপরে ‘পজ’ বাটন টিপে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে দিয়ে থাকলেও অবাক হওয়ার নেই যে— এই বলটাই করে যাও।
অনেকে অবাক হয়ে যাচ্ছেন দেখেন যে, খুব বড় রান-আপও নয় বুমরার। এক্সপ্রেস গতিটা আনেন একেবারে শেষ মুহূর্তের ঝটকায়। হাইজাম্পারের মতো ছুটে এসে কানের পাশ দিয়ে ডান হাতকে ঘুরিয়ে বল ছাড়েন। অপ্রত্যাশিত ভাবে দু’টো হাতই তখন শক্ত হয়ে থাকে। যেটা কোনও কোচই কখনও কোনও ছাত্রকে শেখাবেন বলে মনে হয় না। সুনীল গাওস্কর এক বার বলেছিলেন, ‘‘বুমরার বলটা কী আসবে সেটা বোঝার আগেই ওর অ্যাকশন দেখে ধাঁধায় পড়ে যায় ব্যাটসম্যানরা। ওর অ্যাকশনের সঙ্গে ধাতস্থ হতেই অনেক সময় লাগবে।’’ ভাগ্যিস কেউ বুমরার অ্যাকশন পাল্টাতে যাননি।
গাওস্কর তাঁর ক্রিকেট জীবনে জেফ থমসনকে খেলেছেন। বিশ্বের সর্বকালের সব চেয়ে দ্রতগতিসম্পন্ন বোলার ধরা হয় ‘থমো’কে। অস্বাভাবিক অ্যাকশন তাঁর বোলিংয়ে যেমন অতিরিক্ত গতি এনে দিত, তেমনই ব্যাটসম্যানদের জন্য তৈরি করত বিভ্রান্তি। বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসে রহস্যময় অ্যাকশন নিয়ে অনেক স্পিনার এসেছেন। ভারতেরই ছিলেন চন্দ্রশেখর। জোরে বোলারদের মধ্যে শুধু তিন-চার জনকেই পাওয়া যাবে, যাঁরা দুর্বোধ্য অ্যাকশন নিয়ে খেলেছেন। জেফ ‘বিদ্যুৎ’ থমসন অবশ্যই তাঁদের এক জন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কলিন ক্রফ্ট এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মাইক প্রোক্টরের অ্যাকশনও অস্বাভাবিক ধরনের ছিল। এবং, অবশ্যই
লাসিথ মালিঙ্গা।
এক-এক সময় মনে হচ্ছে, বুমরা-রহস্য ভেদ করার জন্য জো রুটদের না ২২১বি বেকার স্ট্রিটে ছুটতে হয়। যদি সেখানে এখনও খুঁজে পাওয়া যায় কোনও
শার্লক হোমসকে!