(বাঁ দিকে) জয়ের হুঙ্কার কার্লোস আলকারাজ়ের। হেরে মাথা নিচু নোভাক জোকোভিচের। (ডান দিকে)। ইউএস ওপেনের সেমিফাইনালে। ছবি: রয়টার্স।
২৩ মিনিট! আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে পুরুষদের সিঙ্গলসের প্রথম সেমিফাইনালের প্রথম ২৩ মিনিটের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল, কোনও অবাছাই খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে খেলতে নেমেছেন কার্লোস আলকারাজ়। ২৩ মিনিটের মাথায় প্রথম বার ডাউন দ্য লাইন রিটার্নে বোঝা গেল, প্রতিপক্ষের নাম নোভাক জোকোভিচ। ২৪ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক। কিন্তু আগের ২৩ মিনিট বুঝিয়ে দিয়েছিল, খেলার ফল কী হতে চলেছে। হলও তাই। আরও এক বার গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে ওঠার আগেই বিদায় নিলেন পুরুষদের সর্বাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক। চলতি বছর গ্র্যান্ড স্ল্যামে ট্রফিহীন থাকলেন জোকোভিচ। বিশ্বের প্রথম টেনিস খেলোয়াড় হিসাবে বছরের চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যামেরই সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হল সার্বিয়ার তারকাকে। স্ট্রেট সেটে (৬-৪, ৭-৬, ৬-২) তাঁকে হারিয়ে ফাইনালে জায়গা করে নিলেন আলকারাজ়।
হার্ড কোর্টে প্রথম বার জোকোভিচকে হারালেন আলকারাজ়। ম্যাচ জিততে আড়াই ঘণ্টাও লাগল না তাঁর। চলতি ইউএস ওপেনে স্বপ্নের ফর্মে রয়েছেন আলকারাজ়। ছ’টি ম্যাচে একটিও সেট না খুইয়ে ফাইনালে উঠেছেন তিনি।
আর্থার অ্যাশ স্টেডিয়ামে নামার আগে টানেল দিয়ে যখন জোকোভিচ বার হচ্ছেন তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হল, কেরিয়ারে গ্র্যান্ড স্ল্যামের ৫৩তম সেমিফাইনালে নামার আগে কী মনে হচ্ছে? ৫৩তম সেমিফাইনাল! বিশ্বের সব টেনিস খেলোয়াড়ের কাছে যা স্বপ্ন, তা বাস্তবে করে দেখিয়েছেন জোকোভিচ। প্রশ্ন শুনে নোভাক বললেন, “রোজ রোজ তো আর বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে খেলার সুযোগ হয় না। লড়াই করব।” এই উত্তর জোকোভিচের কাছে অপ্রত্যাশিত। একটু বিনয়ী। স্বভাবসিদ্ধ ঘোষণা নেই। উল্টো দিকে আলকারাজ় নামার আগে বললেন, “ফাইনালে উঠতেই হবে। এটা বদলার ম্যাচ।” সত্যি তো, এর আগে এক বারও হার্ড কোর্টে জোকোভিচকে হারাতে পারেননি তিনি। মুখোমুখি সাক্ষাতে ৩-৫ পিছিয়ে রয়েছেন। শেষ দু’বারের সাক্ষাতে হেরেছেন। তিনি তো বদলার কথা বলবেনই। শুধু বললেন না, করেও দেখালেন।
‘রিসিভ!’ টস জিতে এটাই বলেন আলকারাজ়। তিনি নিজে সার্ভিস করতে চাননি। তাঁর পরিকল্পনা ছিল প্রথম গেমেই জোকোভিচকে ধাক্কা দেওয়া। জোকোভিচও হয়তো ভাবেননি আলকারাজ় নিজে সার্ভিস করবেন না। প্রথম গেমের প্রথম সার্ভিস করতে গিয়েই থামতে হল নোভাককে। প্রথম সেট চলাকালীন সেই ছবি তিন বার দেখা গেল। টেনিস সার্কিটে সার্ভিসের জন্য পরিচিত জোকোভিচ। সেই তিনিই কিনা থমকাচ্ছেন। তার ফয়দা তুললেন আলকারাজ়। প্রথম গেমেই জোকোভিচের সার্ভিস ভাঙলেন তিনি। এই ধরনের খেলায় একটি ভুল পার্থক্য গড়ে দেয়। দিলও তাই। পরের ন’টি গেমে দুই খেলোয়াড় নিজেদের সার্ভিস ধরে রাখলেও জোকোভিচকে সেটে হারতে হল।
আলকারাজ়ের খেলা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, তিনি আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই ভাবছেন না। ঘণ্টায় ২২৮ কিলোমিটার গতিবেগে সার্ভিস করলেন। তার জবাব জোকোভিচের কাছেও ছিল না। তিনি জোকোভিচকে ভুল করতে বাধ্য করলেন। আলকারাজ়কে দেখে জোকোভিচও গায়ের জোরে শট খেলার চেষ্টা করলেন। তাতেই নিয়ন্ত্রণ হারালেন তিনি। চতুর্থ গেম থেকে পুরনো জোকোভিচের কিছু ঝলক দেখা যাচ্ছিল। তাঁর কয়েকটি ক্রস কোর্ট ও ডাউন দ্য লাইন রিটার্ন তাঁকে পয়েন্ট দিল। পাশাপাশি কয়েকটি সহজ রিটার্নে আনফোর্সড এরর করলেন তিনি। ডবল ফল্টও হল। জোকোভিচকে তাতাতে মাঝেমধ্যেই চিৎকার করছিলেন দর্শকেরা। কিন্তু জোকোভিচ এর উল্টো দৃশ্য দেখতেই অভ্যস্ত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁকে বিদ্রুপ শুনতে হয়। দর্শকদের বিদ্রুপে তাঁর খেলার ধার বাড়ে। এই ম্যাচে উল্টোটা হল। দর্শকদের সমর্থন জোকোভিচের সঙ্গে থাকায় আলকারাজ়কে দেখে মনে হল পুরনো জোকোভিচ। যিনি প্রতিপক্ষের পাশাপাশি দর্শকদের বিরুদ্ধেও খেলেন। প্রথম সেট জিতে আলকারাজ়ের হুঙ্কার সেটাই বুঝিয়ে দিল।
তবে জোকোভিচ যে লড়াই না করে হার মানবেন না তা দ্বিতীয় সেটের শুরুতেই দেখা গেল। দ্বিতীয় গেমে আলকারাজ়ের সার্ভিস ভাঙলেন তিনি। এর আগে ৭৪টি সার্ভিস গেমের মধ্যে ৭৩টি জিতেছিলেন স্প্যানিশ তারকা। অবশেষে জোকোভিচের কাছে তাঁকে সার্ভিস খোয়াতে হল। প্রথম থেকেই এই ম্যাচে আলকারাজ়কে তাঁর ড্রপ শট ভোগাচ্ছিল। যে ড্রপ শট তিনি ঘুমের মধ্যেও মারতে পারবেন, তা থেকে পয়েন্ট পাচ্ছিলেন না। সেই ড্রপ শটের খেসারত দিয়ে সার্ভিস খোয়াতে হল তাঁকে। দ্রুত নিজের ভুল শুধরে নিলেন আলকারাজ়। ড্রপ শট থেকে সরে পাওয়ার টেনিসে মন দিলেন। কেন মাত্র ২২ বছরে তিনি পাঁচটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন তা বুঝিয়ে দিলেন রাফায়েল নাদালের ‘শিষ্য’। ০-৩ পিছিয়ে থেকে ৩-৩ করলেন তিনি। আরও এক বার জোকোভিচের সার্ভিস ভাঙলেন। এক বার ভুল শট খেললে নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন আলকারাজ়। নিজেকে বোঝাচ্ছিলেন। তার পর সেই ভুল শুধরে ফিরছিলেন। ঠিক যেমনটা করেন জোকোভিচ। বলা ভাল করতেন। এই ম্যাচে জোকোভিচের সেই রূপ দু’-এক বার ছাড়া দেখা গেল না।
প্রথম গেম থেকে খুব একটা লম্বা র্যালি খেলছিলেন না দুই তারকা। দ্রুত পয়েন্ট তোলার চেষ্টা করছিলেন। দ্বিতীয় সেটের নবম গেমে ২৭ শটের র্যালি হল। জোকোভিচকে শুধু আলকারাজ়ের বিরুদ্ধেই খেলতে হচ্ছিল না, তাঁর লড়াই ছিল নিজের শরীরের বিরুদ্ধেও। ২২ বছরের আলকারাজ়ের দমের বিরুদ্ধে ৩৮ বছরের জোকোভিচ কত ক্ষণ দম ধরে রাখতে পারবেন তার পরীক্ষা ছিল। প্রথম সেট থেকেই বার বার নিজের ঘাড় ও ডান কাঁধ ঝাঁকাচ্ছিলেন জোকোভিচ। তাঁর ব্যাক হ্যান্ড দেখে ধারাভাষ্যকারেরা বলছিলেন, কোথাও একটু সমস্যা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, জোকোভিচ পুরো জোর দিতে পারছেন না।
খেলা শেষে কোর্ট ছাড়ছেন নোভাক জোকোভিচ। ছবি: রয়টার্স।
দ্বিতীয় সেট গড়াল টাইব্রেকারে। চলতি বছর টাইব্রেকারে জোকোভিচের জয়ের (৮) থেকে হার (১২) বেশি। আলকারাজ় সেটা জানতেন। টাইব্রেকারে তিনি এমন এক একটি শট খেললেন যাকে বুলেটের গতির সঙ্গে তুলনা করা যায়। জোকোভিচ হিমশিম খাচ্ছিলেন। চাপ বাড়ছিল। সেটা বোঝা গেল তাঁর প্রথম পয়েন্ট পাওয়ার পর। দর্শকদের হাততালি শুরু হওয়ার পর জোকোভিচ কানে আঙুল দিয়ে বোঝালেন, তিনি শুনতে পাচ্ছেন না। তাতে চিৎকার আরও বাড়ল। নোভাককে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, দর্শকদের এই সমর্থন তাঁর শেষ সম্বল। তবে দর্শকদের পাশে পেয়েও সেট জিততে পারলেন না জোকোভিচ। টাইব্রেকারে বাজিমাত করলেন আলকারাজ়। ২২ বছরের তারকার খেলা দেখে জিমি কোনর্স, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভাদের কপালেও ভাঁজ পড়ছিল। যে আত্মবিশ্বাস তাঁর প্রতিটি শটে দেখা যাচ্ছিল, তা দেখেই হয়তো অবাক হচ্ছিলেন টেনিসের সেরারা।
দ্বিতীয় সেটের পর মেডিক্যাল বিরতি নেন জোকোভিচ। ফিজিয়ো কোর্টেই তাঁর ঘাড় মালিশ করে দিচ্ছিলেন। আলকারাজ় তখন তৈরি পরের সেটে নামার জন্য। গ্র্যান্ড স্ল্যামে এর আগে ৫২টি ম্যাচে প্রথম দুই সেটে জিতেছেন আলকারাজ়। ৫২ বারই সেই ম্যাচ গিয়েছে তাঁর দখলে। ফলে জোকোভিচ যে পরের তিন সেট জিতে ম্যাচ জিতবেন সেই আশা খুব একটা ছিল না। প্রশ্ন ছিল, জোকোভিচ এই ম্যাচ কত দূর টেনে নিয়ে যেতে পারবেন? স্ট্রেট সেটে হারতে হবে? নাকি অন্তত একটা সেট জিতবেন? পরের কয়েকটি গেমেই তা স্পষ্ট হয়ে গেল।
সেমিফাইনালের মাঝে মেডিক্যাল বিরতির সময় ফিজিয়োর সঙ্গে নোভাক জোকোভিচ। ছবি: রয়টার্স।
চতুর্থ গেমে আবার জোকোভিচের সার্ভিস ভাঙলেন আলকারাজ়। ডবল ফল্ট করে সার্ভিস খোয়ালেন ২৪ গ্র্যান্ড স্ল্যামের মালিক। তাঁকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, আর পারছেন না টানতে। শরীর দিচ্ছে না। শটে জোর জিতে পারছেন না। কোর্ট কভার করতে সমস্যা হচ্ছে। এখন পুরুষদের টেনিসে প্রথম ২০ খেলোয়াড়ের মধ্যে দ্বিতীয় বয়স্কতম খেলোয়াড় জোকোভিচের থেকে ৯ বছরের ছোট। বয়স যে গত বড় ‘শত্রু’ তা এই ম্যাচে আরও এক বার বুঝলেন জোকোভিচ। আগে খেলা যত গড়াত তত ধার বাড়ত তাঁর। এখন সেটা হচ্ছে না। তৃতীয় সেটে তো বলের কাছেও পৌঁছতে পারছিলেন না জোকোভিচ। হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন। জোকোভিচকে দাঁড় করিয়ে স্ট্রেট সেটে জিতে ফাইনালে উঠলেন আলকারাজ়। বোঝা গেল, সময় হয়ে এসেছে জোকোভিচের। আর বেশি দিন হয়তো কোর্টে দেখা যাবে না টেনিসের ফ্যাব ফোর-এর শেষ তারকাকে।