Cricket Bat Crisis

কমেছে জোগান, দাম বাড়ছে হু-হু করে, বিশ্ব জুড়ে লিগ ক্রিকেটের রমরমার বাজারে ক্রিকেটারের অস্ত্র ক্রিকেট ব্যাটের শিল্পই এখন বিপন্ন!

ব্যাট তৈরির কারখানার মালিকেরা বলছেন, উইলো কাঠ আসতে সময় লাগছে। ফলে ব্যাট বানাতেও সময় লাগছে। কিন্তু আসল সমস্যা ব্যাটের দাম। প্রতিদিন যা বেড়েই চলেছে।

Advertisement

দেবার্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৯
Share:

কাশ্মীরের একটি ব্যাট তৈরির কারখানা। পিছনে রাখা কাঠ থেকে এ ভাবেই তৈরি হয় একের পর এক ব্য়াট। ছবি: রয়টার্স।

দু’বছর আগের কথা। আইপিএলের ম্যাচের আগে অনুশীলনের সময় রোহিত শর্মার হাতে এল নতুন কয়েকটি ব্যাট। তখনও স্টিকার লাগানো হয়নি। একটার পর একটা ব্যাট নিয়ে ‘নকিং’ করলেন রোহিত। তার পরে একটি ব্যাট হাতে তুলে সতীর্থ তিলক বর্মাকে বললেন, “ইয়ে ঠিক হ্যায়। ইস সে লম্বা মারুঙ্গা” (এটাই ঠিক আছে। এটা দিয়েই বড় শট মারব)।’’ যোদ্ধাদের পছন্দসই অস্ত্র খুঁজে নেওয়ার মতো।

Advertisement

কিন্তু সেই অস্ত্রই এখন বিপন্ন। বিশ্ব জুড়ে এখন লিগ ক্রিকেটের রমরমা। টেলিভিশন খুললেই পৃথিবীর কোনও না কোনও লিগ। ‘দ্য হান্ড্রেড’ বা দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট লিগের মতো বিদেশি লিগ হতে পারে। তামিলনাড়ু, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বঙ্গের মতো রাজ্য লিগও হতে পারে। সব লিগেরই অবশ্য ভিত্তি আইপিএল। লিগ ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বাচ্চাদের মধ্যে ক্রিকেট খেলার আগ্রহ। কলকাতা ময়দান, বিবেকানন্দ পার্ক বা সেন্ট্রাল পার্কে গেলেই দেখা যায়, পিঠে কিটব্যাগ নিয়ে স্বপ্নের পিছনে ছুটছে ৮ থেকে ১২ বছরের কিশোর-কিশোরীরা।

লিগ ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে ক্রিকেট ব্যাটের চাহিদা। সেই তুলনায় জোগান বাড়ছে না! এমসিসি-র ‘ডিরেক্টর অফ ক্রিকেট অপারেশন্‌স’ রব লিঞ্চ কিছু দিন আগে বলেছেন, “ব্যাট নিয়ে সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখনই সমাধান করতে না পারলে ভবিষ্যতে বিপদ আছে।” যদিও তেমন মনে করছেন না কলকাতার পরিচিত ক্রিকেট সরঞ্জামের বিপণির কর্ণধার সোমরূপ দাশগুপ্ত। তাঁর কথায়, “সমস্যা অন্যত্র। ব্যাটের জোগান কমছে না। কিন্তু ব্যাটের বরাত দিলে তা পেতে সময় লাগছে। আগে দেড় থেকে দু’সপ্তাহে কারখানা থেকে ব্যাট এসে যেত। এখন মাস পেরিয়ে যাচ্ছে।”

Advertisement

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারেরা ‘ইংলিশ উইলো’ ব্যবহার করেন। ভারতে ‘কাশ্মীরি উইলো’ও ব্যবহৃত হয়। তবে তার বেশিটাই প্রাথমিক স্তরে। ক্রিকেটে হাতেখড়ির পরে শিশুরা মূলত কাশ্মীরি উইলো দিয়েই খেলা শুরু করে। কয়েক বছর পর তারা ইংলিশ উইলোয় চলে যায়। প্রধান কারণ ব্যাটের ওজন। ইংলিশ উইলো সবচেয়ে হালকা। কাঠের মানও সবচেয়ে ভাল।

ইংল্যান্ডের এক ব্যাট তৈরির কারখানায় কাঠের মান যাচাই করা হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স।

বিশ্বে যত ইংলিশ উইলোর ব্যাট পাওয়া যায়, তার ৭৫ শতাংশই আসে ‘জেএস রাইট অ্যান্ড সন্স’-এর কারখানা থেকে। ১৮৯৪ সাল থেকে ইংলিশ উইলো বিক্রি করছে তারা। গত ৩০ বছর ধরে সংস্থার কর্ণধার জেরেমি রাগেলস জানিয়েছেন, একটি চারাগাছ পরিণত হতে ১২ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। ২০ বছর আগে ১৫,০০০ চারা পুঁতেছিলেন তাঁরা। সেই গাছগুলি থেকে এখন ব্যাট তৈরি হচ্ছে। গত বছর আরও ৪০,০০০ চারাগাছ পুঁতেছেন। সেই সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। একটি পরিণত গাছ থেকে সাধারণত ৪০টি ‘ক্লেফ্‌ট’ (একটি ক্লেফ্‌ট থেকে একটি ব্যাট বানানো হয়) পাওয়া যায়। এ বছর সাত লক্ষ ‘ক্লেফ্‌ট’ রফতানি করেছে ওই সংস্থা।

জেরেমি জানাচ্ছেন, ব্যাটের জন্য একটি গাছ কাটলে সেখানে সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি চারাগাছ পোঁতা হয়। ফলে গাছের পরিমাণ কমেনি। কিন্তু অন্য অনেক সংস্থা গাছ কম লাগায়। ফলে উইলোর জোগানে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাঁর আরও অভিযোগ, সময়ের আগেই গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। ফলে সেই গাছের কাঠ থেকে তৈরি ব্যাটের মান খুব ভাল হচ্ছে না। অনেক সময় ব্যাট তাড়াতাড়ি ভেঙেও যাচ্ছে।

ইংল্যান্ডের এক কারখানায় দক্ষ হাতে তৈরি হচ্ছে ব্যাট। ছবি: রয়টার্স।

ভারতে জনপ্রিয় ব্যাট প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি হল এসএস (সারিন স্পোর্টস লিমিটেড), এসজি (সান্সপারেইল্‌স গ্রিনল্যান্ডস), এমআরএফ, কুকাবুরা, ব্যাস (বিট অল স্পোর্টস)। দেশে সবচেয়ে বড় ব্যাটের কারখানা রয়েছে উত্তরপ্রদেশের মেরঠে। এসএস-এর মতো বড় কারখানার পাশাপাশি অনেক মাঝারি এবং ছোট কারখানাও আছে সেখানে। মেরঠের লোহিয়ানগর থেকে থাপরনগর পর্যন্ত চার কিলোমিটার জুড়ে রাস্তার দু’দিকে একের পর এক ব্যাটের কারখানা। সেখান থেকে বিদেশেও ব্যাট রফতানি করা হয়। তারাও কি সমস্যায়?

দয়াল স্পোর্টস ইন্ডাস্ট্রিজ়ের মালিক হর্ষ দয়ালের বক্তব্য, কোভিড তাঁদের ব্যবসায় অনেকটাই ক্ষতি করেছে। লকডাউনের সময় কারখানায় পড়ে থেকে অনেক ব্যাট নষ্ট হয়েছে। উইলোও খারাপ হয়েছে। ফলে কোভিডের পরে ব্যাটের দাম বেড়েছে। এখন ব্যাটের জোগান নিয়ে তাঁর জবাব, “উইলো আসতে সময় লাগছে। আমরা সে ভাবেই অর্ডার দিচ্ছি। তাই জোগানে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। তবে দাম অনেকটাই বেড়েছে। আগামী দিনে আরও বাড়বে।”

মেরঠেরই আর এক ব্যাট কারখানা গর্গ স্পোর্টস ইন্টারন্যাশনালের মালিক প্রশান্ত গর্গ জানিয়েছেন, তাঁরা ইংলিশ উইলোর পাশাপাশি কাশ্মীরি উইলো দিয়েও ব্যাট বানান। ছোট ছেলেমেয়েরা শুরুতে কাশ্মীরি উইলো দিয়েই খেলে। প্রশান্তের কথায়, ‘‘ইংলিশ উইলোর মান খুব খারাপ না হয়ে গেলেও কাশ্মীরি উইলোর মান কিন্তু নেমেছে। ব্যাট তৈরি করার সময়ই আমরা বুঝতে পারছি, সেগুলো বেশি দিন চলবে না। তাই আমরাই বলছি ইংলিশ উইলো কিনতে। দাম বেশি। কিন্তু চলবেও তো বেশি দিন।”

মেরঠের এক কারখানায় তৈরি হচ্ছে ব্য়াট। ছবি: রয়টার্স।

কত বেড়েছে ব্যাটের দাম? সোমরূপের কথায়, “কোভিডের আগে ২০১৮ সালে ভাল কাশ্মীরি উইলো দেড় হাজার টাকায় পাওয়া যেত। সেটাই এখন ছ’হাজার টাকা। তখন ভাল ইংলিশ উইলোর দাম ছিল পাঁচ হাজার। এখন সেটাই ১৫ হাজার। সব ধরনের ব্যাটের দাম অন্তত তিন গুণ করে বেড়েছে।”

ব্যাট কারখানার মালিকদের একাংশের অভিযোগ, কাশ্মীরি উইলোর মান খারাপ না হলে হয়তো ব্যাটের দাম এতটা বাড়ত না। কিন্তু শিক্ষা এবং সচেতনতার অভাবে কাশ্মীরের ব্যাটশিল্প এখন ধুঁকছে। কাশ্মীরি উইলোর বেশিরভাগ কারখানা অনন্তনাগ জেলায়। সেখানে ‘জিআর ৮ স্পোর্টস’ কারখানার মালিক ফওয়াজ় উল কবির বললেন, “কাশ্মীরি উইলো থেকে আন্তর্জাতিক মানের ব্যাট তৈরি করা কঠিন। এর প্রধান কারণ অবলীলায় গাছ কাটা ও তার বিকল্প গাছ না লাগানো। একটা গাছ পরিণত হতে ২০ বছর সময় লাগে। সেই সময় দিতে হবে। বেশি ব্যাট তৈরির জন্য অপরিণত গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে। তাই ব্যাটের মান খারাপ হচ্ছে।” বস্তুত, কাঠের মান খারাপ হওয়ায় কাশ্মীরের অনেক ব্যাট তৈরির কারখানা এখন উইলো দিয়ে আসবাব তৈরি করছে। ফলে ব্যাটের সংখ্যাও কমছে।

ব্যাট-সমস্যার সমাধানে ইতিমধ্যেই আইসিসি-র ক্রিকেট কমিটির কাছে আবেদন করেছেন ব্যাট প্রস্তুতকারী সংস্থার মালিকেরা। কমিটির মাথায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সোমরূপের বিশ্বাস, সৌরভ বুঝবেন কী করে এই সমস্যা মেটানো যায়। কারণ, তিনিই ‘সেরা’। সোমরূপের কথায়, “উইলোতে কোথাও দাগ থাকলে সেটা থেকে আর ব্যাট তৈরি হয় না। ফেলে দিতে হয়। কিন্তু মানের কোনও তফাত নেই। কিন্তু সব ক্রিকেটারই সাদা ফটফটে, দাগহীন ব্যাট চান। তাই একটা বিকল্প ভাবনা হচ্ছে। ব্যাটের উপরে ল্যামিনেশন করা গেলে দাগ বোঝা যাবে না। সে ক্ষেত্রে একটা গাছ থেকে অনেক বেশি ব্যাট বানানো যাবে। তাতে খরচ কিছুটা কমতে পারে।”

ব্যাটের দাম বেড়ে যাওয়াটা যে সমস্যা, তা মেনে নিয়েছেন বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিজের অ্যাকাডেমি রয়েছে। সম্বরণ বললেন, “ব্যাটর দামটাই প্রধান সমস্যা। পেশাদার খেলোয়াড়েরা হয়তো স্পনসর পায়। কিন্তু যারা ক্রিকেট শুরু করেছে, তারা কী করবে? এখন শুরুতে ব্যাট-সহ গোটা কিট কিনতে অন্তত ২০ হাজার টাকা লাগে। যারা আর্থিক ভাবে একটু পিছিয়ে, তারা অত টাকা কোথায় পাবে?”

ব্যাটের জোগান বা মান আগের থেকে কমেছে বলে মনে করেন না সম্বরণ। যেমন মনে করেন না, বাংলার ক্রিকেটার অনুষ্টুপ মজুমদারও। তাঁর কথায়, “পেশাদার ক্রিকেটারেরা তো ব্যাট খুব একটা কেনে না। স্পনসরদের কাছে পায়। তাই তাদের সমস্যা হয় না। কিন্তু ব্যাটের দাম অনেকটা বেড়েছে। তার কারণ বলতে পারব না। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা তো হচ্ছেই।”

ব্যাট কারখানার মালিকদের সঙ্গে কথা বলে মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানা গেল। বিশ্বের প্রথম সারির ব্যাটারদের সঙ্গে চুক্তি করতে এখন প্রচুর অর্থ ব্যয় হয় ব্যাট প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির। চুক্তির আওতায় থাকা ক্রিকেটারের সংখ্যাও প্রতিদিন বাড়ছে। ফলে যে টাকা সংস্থাগুলি খরচ করছে, তা তুলে নিতে ব্যাটের দাম বাড়াতে হচ্ছে। তা চাড়াও, মাত্রই কয়েকটি সংস্থা বিশ্বের তিন-চতুর্থাংশ ব্যাট তৈরি করে। সেই একচেটিয়া ব্যবসাও ব্যাটের মূল্যবৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে।

এশিয়া কাপের প্রস্তুতিতে নেটে দু’হাতে দু’টি ব্যাট নিয়ে শুভমন গিল। ছবি: সমাজমাধ্যম।

কলকাতা ও শহরতলির ক্রিকেট অ্যাকাডেমিগুলিতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদেরই ভিড় বেশি। ব্যাট-সমস্যায় পড়েছে তারা। শ্যামবাজারের দাশগুপ্ত স্পোর্টসে মা সুতপা সেনের সঙ্গে ব্যাট কিনতে এসেছিল ১১ বছরের অভিজ্ঞান। ব্যাটের সঙ্গে উইকেটরক্ষকের দস্তানা এবং ‘ইনার গ্লাভস’-ও কেনার ছিল। দাম হল প্রায় ১২ হাজার টাকা। নৈহাটির বাসিন্দা সুতপা বললেন, “ছেলে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হবে বলে অনেক দিন ধরে বায়না করছে। ভর্তিও করেছি। তাই ব্যাট কিনতে আসা। দাম বড্ড বেশি। কিন্তু কী করব? এখন এটা দিয়ে খেলুক। ওদের স্বপ্নপূরণের দিকটা আমাদেরই তো দেখতে হবে।”

স্বপ্ন আপাতত পূরণ তো হল। কিন্তু ব্যাটের এই আকালে স্বপ্ন দেখাই না বন্ধ হয়ে যায়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement