(উপরে, বাঁ দিক থেকে) সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, গৌতম গম্ভীর ও গ্রেগ চ্যাপেল। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ়ে ভারতীয় দল (নীচে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
দৃশ্য ১: গুয়াহাটিতে চতুর্থ দিনের খেলা শুরুর আগে ক্রিকেটারদের সঙ্গে কথা বলছেন কোচ গৌতম গম্ভীর। কী বলছেন, জানা যায়নি। টেলিভিশন ক্যামেরার ক্লোজ় শটে দেখে মনে হয়েছে, ধমকই দিচ্ছেন। তাঁর সামনে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে ঋষভ পন্থ, যশস্বী জয়সওয়ালরা।
দৃশ্য ২: ২০ বছর আগে ২০০৫ সালে জ়িম্বাবোয়ের হারারে স্পোর্টস কমপ্লেক্সে মাঠে অনেকটা এমনই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল। উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন ভারতের তৎকালীন কোচ গ্রেগ চ্যাপেল। যাঁকে বলছিলেন, তাঁর নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই ঘটনার কয়েক দিন আগে সৌরভকে অধিনায়কত্ব ছাড়তে বলেছিলেন কোচ গ্রেগ। সৌরভ অবশ্য পন্থদের মতো নীরব থাকেননি। মাঠেই তর্কে জড়িয়েছিলেন কোচের সঙ্গে। তার পরেই গ্রেগের ই-মেল ফাঁস, কোচ-অধিনায়ককে বোর্ডের সমন, সৌরভের দল থেকে বাদ পড়া।
দু’দশক আগে গ্রেগকে নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের অন্দরমহল তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। দু’দশক পরে হচ্ছে গম্ভীরকে নিয়ে। মাত্র দু’বছরে ভারতীয় ক্রিকেটের বাস্তুতন্ত্র ওলটপালট করে দিয়েছিলেন গ্রেগ। সেই ক্ষত সারতে আরও তিন বছর লেগেছিল। গম্ভীর এক বছরেই তার অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছেন।
গ্রেগ ভারতীয় ক্রিকেটে ‘তারকা সংস্কৃতি’র অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁকে কোচ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন সৌরভই। পরে বলেছেন, বিরাট ভুল করেছিলেন। কিন্তু তখন ভাবতে পারেননি। ভারতে ক্রিকেটারেরা ‘ঈশ্বর’-এর সমতুল। সুনীল গাওস্কর, সচিন তেন্ডুলকর থেকে শুরু করে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা— যখন যে তারকা এসেছেন, তাঁরা দর্শকদের কাছে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মর্যাদা পেয়েছেন। বহির্জগতে তো বটেই, দলের অন্দরেও সেই ‘তারকা সংস্কৃতি’ তৈরি হয়ে গিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটে। কোচ রবি শাস্ত্রীর কাছে বিরাট অনুরোধ করেছিলেন, অস্ট্রেলিয়া সফরে তৎকালীন বান্ধবী (পরে স্ত্রী) অনুষ্কা শর্মাকে নিয়ে যেতে চান। শাস্ত্রী অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সে গ্রেগ-পরবর্তী এবং গম্ভীর-পূর্ব জমানা। গ্রেগ ভারতীয় ক্রিকেটে তারকা সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাঁর কাছে পারফরম্যান্সই ছিল আসল। অধিনায়ক সৌরভকে ছেঁটে গুরু গ্রেগ বার্তা দিয়েছিলেন, দলে তারকা একজনই— তিনি।
ভারতীয় ক্রিকেটে তারকা সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন অনিল কুম্বলে। অধিনায়ক কোহলির গুডবুকে না-থাকায় কোচের পদ থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছিল। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপের পরে ভারতীয় দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিল। কুম্বলে ফিরেছিলেন বেঙ্গালুরুর বাড়িতে। শাস্ত্রী সেই ‘ভুল’ করেননি। তিনি কোহলির মন জুগিয়ে চলেছেন। কোচ হিসেবে রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গেও কোহলির মতো তারকাদের সংঘাত বাধেনি। যদিও তার অন্যতম কারণ যুগপৎ ক্রিকেটার এবং মানুষ হিসাবে রাহুলের প্রতি সমীহ।
কিন্তু গম্ভীর দ্রাবিড়ের পর্যায়ভুক্ত নন। কিন্তু তিনি চান সাজঘরে কোনও ‘তারকা’ থাকবে না। সেই কারণে কোচ হয়েই তিনি বিদেশ সফরে ক্রিকেটারদের পরিবার, স্ত্রী ও বান্ধবীদের নিয়ে যাওয়ায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। গম্ভীর ক্রিকেটারদের আলাদা আলাদা গাড়িতে যাতায়াত বন্ধ করেছেন। বন্ধ হয়েছে আলাদা রাঁধুনি নিয়ে যাওয়াও। কোচ গম্ভীর বলেছেন, ‘‘এই দলে তারাই খেলবে, যারা দেশের হয়ে খেলতে গর্ব বোধ করে। যারা নিঃস্বার্থ ভাবে ক্রিকেটটা খেলে।’’
বার্তা খুব স্পষ্ট— মুড়ি এবং মিছরির দরের খুব ফারাক তাঁর ক্লাসে নেই। তখন থেকেই ভারতীয় ক্রিকেটের অন্দরমহলে গম্ভীরকে নিয়ে অনুযোগ শুরু হয়েছিল। তা ক্ষোভের আকার নেয় আচমকা কোহলি এবং রোহিত টেস্ট থেকে অবসর নিয়ে নেওয়ায়। তার আগে ঝপ করে সিরিজ়ের মাঝপথে অবসর ঘোষণা করেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ক্রিকেটমহলের খবর, তিন জনেই অবসর নিতে খানিকটা বাধ্য হয়েছেন। যেমন ভারত তথা বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারি। তাঁর কথায়, “আমি বিশ্বাস করি, রোহিত-কোহলির এখনও ভারতীয় ক্রিকেটকে অনেক কিছু দেওয়ার ছিল। অশ্বিনও খেলতে পারত। কিন্তু ওরা অবসর নিয়ে নিল। কেন? কারণ, ওদের উপর চাপ দেওয়া হয়েছে। বাধ্য হয়ে ওরা অবসর নিয়েছে।”
গম্ভীরের জমানায় যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা কি নিজেদের পারফরম্যান্সকে বেশি গুরুত্ব দিতেন দেশের জয়ের চেয়ে? তেমন মনে করেন না ভারতের হয়ে খেলা বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “রোহিত, কোহলিদের রেকর্ডের ধারেকাছে কেউ যেতে পেরেছে? কত ম্যাচ ওরা একার কাঁধে দেশকে জিতিয়েছে! এই সব ক্রিকেটারের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাই বোকামো।” আর মনোজের মনে হচ্ছে, সম্মান বাঁচাতে সরে গিয়েছেন রোহিত, কোহলি। তাঁর কথায়, “ওদের নিশ্চয় মনে হয়েছে, কোচ ওদের চাইছে না। সাজঘরে ওদের ভাবমূর্তি খারাপ হচ্ছে। ওদের মতো ক্রিকেটার ওই পরিবেশে থাকতে পারেনি। তাই ওরা অবসর নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু তাতে কি ভারতের ভাল হচ্ছে? ওদের বাদ দিয়ে ভারত কি টেস্টে আরও ভাল ক্রিকেট খেলতে পারছে?”
গ্রেগের জমানায় ভারতীয় ক্রিকেটে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল। সৌরভ-লক্ষ্মণদের অনুপস্থিতিতে মহম্মদ কাইফ, সুরেশ রায়না, বেণুগোপাল রাওদের খেলিয়েছিলেন গ্রেগ। ‘গ্রেট’দের শূন্যস্থান পূরণ হয়নি। ১৮ মাস পরে সৌরভই জাতীয় দলে ফিরেছিলেন। শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে গম্ভীরের দলেও। রোহিত-কোহলি-অশ্বিনের বিকল্প এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের যা প্রতিভা রয়েছে, তাতে এমন শূন্যস্থান হওয়া উচিত ছিল না বলেই মনে করেন মনোজ। তিনি বলেন, “ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে এত প্রতিভা। হঠাৎ করে পরিবর্তনের তো দরকার নেই। সময়ের সঙ্গে সব হয়ে যেত। রোহিত, কোহলিরা খেলতে খেলতে পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করে রাখা যেত। জোর করে ওদের সরিয়ে দিতে হত না। এতে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, তাতে ক্ষতিই হচ্ছে ভারতীয় ক্রিকেটের।”
ক্ষতি বলে ক্ষতি? বিশ্বক্রিকেটে অধুনা ‘দুধভাত’ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারালেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ঠকঠকানি শুরু হয়েছে গম্ভীরের দলের।
গ্রেগ-গম্ভীর মিল আরও আছে। গ্রেগের মতোই গম্ভীরেরও পরীক্ষানিরীক্ষার অভ্যাস আছে। ইরফান পাঠানকে ‘পিঞ্চহিটার’ ব্যাটার তৈরি করতে গিয়ে তাঁর আসল অস্ত্র বোলিংয়ের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিলেন গ্রেগ। সচিন তেন্ডুলকরকে ওপেনিং থেকে সরিয়েছিলেন। মিডল অর্ডারে কখনও যুবরাজ, কখনও কাইফ, কখনও রায়নাদের খেলিয়েছেন। ফলে কারও নির্দিষ্ট জায়গা তৈরি হয়নি। ২০ বছর পরে গম্ভীর তার কার্বন কপি নিয়ে হাজির হয়েছেন। ভারতের টেস্ট দলে ওপেনার যশস্বী ছাড়া কারও জায়গা পাকা নয়। প্রতি ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডার বদলাচ্ছে। ওয়াশিংটন সুন্দর হচ্ছেন গম্ভীর জমানার ‘ইরফান’। কখনও তিনি যাচ্ছেন তিন নম্বরে। কখনও আট নম্বরে। নীতীশ রেড্ডিকে দলে নিচ্ছেন গম্ভীর। কিন্তু ওজন ঝরিয়ে, ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরম্যান্স করেও দলে আসতে পারছেন না সরফরাজ খান। ইডেনের ঘূর্ণি উইকেট হোক বা গুয়াহাটির পাটা উইকেট— একটু ভদ্রস্থ বোলিং অ্যাটাক হলেই ভারতীয় ব্যাটিংয়ের হাড়গোড় বেরিয়ে পড়ছে।
ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার তথা প্রাক্তন ওপেনার অরুণ লাল মনে করেন, টেস্টে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে এত পরীক্ষানিরীক্ষার দরকার নেই। তাঁর বক্তব্য, “টেস্টে প্রত্যেক ব্যাটারের আলাদা ভূমিকা থাকে। কিন্তু বার বার ব্যাটিং অর্ডারে বদল হলে সেটা গুলিয়ে যায়। কখন কী ভাবে খেলতে হবে, সেটাই মাথায় থাকে না। ইডেন আর গুয়াহাটিতে সেটাই দেখছি। মনে হচ্ছে টেস্ট নয়, টি-টোয়েন্টি খেলছে সকলে। এ ভাবে টেস্ট জেতা যায় না।”
গুয়াহাটিতে টিম ইন্ডিয়ার পারফরম্যান্স দেখতে দেখতে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে তিতকুটে গলায় শাস্ত্রী বলেছেন, ‘‘আমি তো এদের ভাবনাচিন্তাটাই বুঝতে পারছি না! কোন যুক্তিতে এই টিম তৈরি করা হল? পরে যখন সকলে এই সিরিজ়টার দিকে ফিরে তাকাবে, তখন নিশ্চয়ই অন্যদেরও এটাই মনে হবে। কলকাতা টেস্টে চার জন স্পিনার খেলানো হল। তাদের মধ্যে এক জনকে (ওয়াশিংটন সুন্দর) বল করানো হল মাত্র এক ওভার! সেই জায়গায় তো একজন স্পেশ্যালিস্ট ব্যাটারকে নেওয়া উচিত ছিল। আগের টেস্টে ওয়াশিংটন সুন্দর তিন নম্বরে ব্যাট করল। এখানে ওকে অনায়াসে চার নম্বরে পাঠানো যেতে পারত। কারণ, তিন নম্বরের জন্য একজনকে (সাই সুদর্শন) নেওয়া হয়েছে। এখানে সুন্দরকে পাঠানো হল আট নম্বরে!’’
তবে গম্ভীরের পক্ষে আশার কথা একটাই। এর পর ভারত টেস্ট সিরিজ় খেলবে ২০২৬ সালের অগস্টে। ফলে টেস্টের কঙ্কাল আবার আলমারিতে লুকিয়ে ফেলা যাবে। সাদা বলের ক্রিকেটে কোচ গম্ভীরের সাফল্য তুলনায় বেশি। তাঁর কোচিংয়ে ভারত বিশ্বকাপ জিতে গেলে সব ঢাকা পড়ে যাবে। তার ব্যত্যয় হলে গম্ভীরকে না আবার ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি ক্রিকেট কোচিংয়ে ফিরে যেতে হয়!
পুনশ্চ: আত্মজীবনীতে গ্রেগকে ‘রিংমাস্টার’ বলে অভিহিত করেছেন সচিন। অর্থাৎ, ভারতীয় ক্রিকেট গ্রেগের আমলে সার্কাসে পরিণত হয়েছিল। গ্রেগ ছিলেন সেই সার্কাসের রিংমাস্টার। গম্ভীর যে দ্রুতগতিতে গ্রেগকে ছুঁতে ধাবিত হচ্ছেন, ভবিষ্যতে তাঁকেও না কারও না কারও আত্মজীবনীতে এমন সম্মানে ভূষিত হতে হয়!