ভারতের ক্রিকেটার শুভমন গিল। — ফাইল চিত্র।
দীর্ঘ দিন টি-টোয়েন্টি দলের বাইরে থাকার পর হঠাৎই ফেরানো হয়েছিল এশিয়া কাপে। শুধু তাই নয়, রাতারাতি বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল সহ-অধিনায়কও। ইঙ্গিতটা তখনই স্পষ্ট হয়েছিল। টেস্ট এবং এক দিনের ক্রিকেটের পর ভবিষ্যতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও নেতৃত্বের আর্মব্যান্ড যে শুভমন গিলের হাতে যেতে চলেছে এ নিয়ে বিশেষ সংশয় ছিল না। তবে এশিয়া কাপের সাতটি এবং অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের চারটি ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পর সেই শুভমনকে নিয়েই উঠছে প্রশ্ন। গোল্ড কোস্টে চতুর্থ ম্যাচে ৪৬ রান করেছেন ঠিকই। তবে খেলেছেন ৩৯ বল। স্ট্রাইক রেট ১২০-রও কম। খারাপ ফর্ম, দুর্বল স্ট্রাইক রেট থাকা শুভমনের পক্ষে বিশ্বকাপে অধিনায়ক হওয়া তো দূর, আদৌ টি-টোয়েন্টি দলে রাখা যাবে কি না সেটা নিয়েই এখন জল্পনা চলছে।
কয়েক মাসের ব্যবধানে শুভমনকে টেস্টের পর এক দিনের দলের অধিনায়ক বানানোর পর অনেকেই সেই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছিলেন। যদিও রোহিত শর্মাকে সরিয়ে এক দিনের ক্রিকেটে শুভমন নেতৃত্ব পাওয়ায় অনেকে গাঁইগুঁই করেছিলেন বটে। তা বিশেষ ধোপে টেকেনি। বোঝা যাচ্ছিল সাদা বলের আর একটি ফরম্যাটেও শুভমনের নেতৃত্ব পাওয়া সময়ের অপেক্ষা। তবে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ের পর নতুন করে বিষয়টি নিয়ে ভাবনাচিন্তা হতে পারে।
টেস্ট এবং এক দিনের ক্রিকেটে শুভমনের পরিসংখ্যান ভালই। তবে সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটে শুভমন এখনও নিজের প্রতিভার সুবিচার করতে পারেননি। টি-টোয়েন্টিতে শেষ বার অর্ধশতরান করেছিলেন ২০২৪-এর জুলাইয়ে। তার পর থেকে ১৪টি ইনিংস খেলে ফেললেও অর্ধশতরান করতে পারেননি। ওপেনার হিসাবে এই ঘটনা বিরল।
এশিয়া কাপ থেকে শুভমন ধারাবাহিক ভাবে টি-টোয়েন্টিতে ওপেন করছেন। তার আগে অভিষেক শর্মার সঙ্গে ওপেন করতেন সঞ্জু স্যামসন। দু’জনের মধ্যে বেশ ভাল একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবে শুভমনকে জায়গা দিতে গিয়ে সঞ্জুকে অনেকটাই নীচে নেমে আসতে হয়েছে। এতটাই যে প্রতিটি ম্যাচে তিনি ব্যাটিংয়েরও সুযোগ পাচ্ছেন না। অস্ট্রেলিয়া সিরিজ়ে তৃতীয় ম্যাচের পর তো দল থেকেও বাদ পড়ে গিয়েছেন।
শুভমন বনাম অন্য ওপেনারেরা
টি-টোয়েন্টিতে ওপেনিং নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন নয়। গত ২-৩ বছরে বেশ কয়েক বার ওপেনিং জুটি বদল হয়েছে। তার মধ্যে অভিষেক নিজের জায়গা মজবুত করে নিয়েছেন। ২৩টি ম্যাচে তিনি ৯১২ রান করেছেন, ১৯৬.৫৫ স্ট্রাইক রেটে। তিনি ছাড়াও ওপেনিংয়ে ভাল খেলেছেন সঞ্জু এবং যশস্বী জয়সওয়াল। সঞ্জু ১৩টি ইনিংসে ১৮২.৮৯ স্ট্রাইক রেটে ৪১৭ রান করেছেন। তিনটি শতরানও রয়েছে। ২২টি ইনিংসে ১৬৪.৩১ স্ট্রাইক রেটে ৭২৩ রান করেছেন যশস্বী। তাঁর একটি শতরান এবং পাঁচটি অর্ধশতরান রয়েছে। ভারত ওপেনার হিসাবে ব্যবহার করেছেন রুতুরাজ গায়কোয়াড়কেও। তিনি ৯টি ইনিংসে ১৪৭.১৭ স্ট্রাইক রেটে ৩৬৫ রান করেছেন।
সব ভারতীয় ওপেনারদের মধ্যে শুভমনের স্ট্রাইক রেট সবচেয়ে কম। তিনি ৩০টি ইনিংসে ১৪১.২০ স্ট্রাইক রেটে ৭৪৭ রান করেছেন। একটি শতরান এবং তিনটি অর্ধশতরান রয়েছে। গত ২-৩ বছরে শুভমনই টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন।
শুভমনের স্ট্রাইক রেটই শুধু নয়, গড়ও সবার চেয়ে কম। যতই চেষ্টা করুন, কিছুতেই ব্যাটে রান আসছে না। বৃহস্পতিবার গোল্ড কোস্টে তিনি এতটাই ধীরগতিতে খেললেন যে পরের দিকের ব্যাটারেরা বেশি বল পেলেন না। ‘ফক্স ক্রিকেট’-এ ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় শুভমনের কড়া সমালোচনা করেছেন রবি শাস্ত্রী। ভারতের প্রাক্তন কোচ বলেছেন, “টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ওর জন্য একেবারেই ঠিক ফরম্যাট নয়। পাটা পিচে এত দিন কত ভাল ব্যাট করত। এখন সেখানেও ভাল খেলতে পারছে না।” ইরফান পঠান বলেছেন, “শুভমনের হাতে শটের বৈচিত্র রয়েছে। কোনও কারণে ও শট খেলতে ভয় পাচ্ছে। হয়তো ও ভাবছে রিজ়ার্ভ বেঞ্চে সঞ্জুর মতো ক্রিকেটার বসে রয়েছে, যার তিনটে শতরান রয়েছে। সেই কারণে শুভমনের মধ্যে আড়ষ্টতা দেখতে পাচ্ছি।”
ভারতের টি-টোয়েন্টি দলের বোঝা শুভমন?
গম্ভীরের অধীনে ভারত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আগ্রাসী খেলার মন্ত্র নিয়েছে। কিছু দিন আগে এক সাক্ষাৎকারে গম্ভীর নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, আগ্রাসী খেলতে গিয়ে তাঁর দলের ব্যাটারেরা যদি ব্যর্থ হন বা দল হারে, তাতেও নিজের দর্শন থেকে পিছু হটবেন না। একই কথা বলেছিলেন সূর্যকুমারও। এমন নয় এই দর্শন ব্যর্থ হয়েছে। টানা বেশ কয়েকটি ম্যাচে ভারতকে কেউ হারাতে পারেনি। তবে ইদানীং গম্ভীরের আগ্রাসী খেলার দর্শন শুরুতেই ধাক্কা খাচ্ছে শুভমনের ব্যাটিং-মন্থরতায়। যে দিন থেকে শুভমন ওপেনার হিসাবে এসেছেন, সে দিন থেকেই শুরুতে রান তুলতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে ভারত। এক দিকে অভিষেক চালিয়ে খেললেও শুভমনের ধীরগতিতে খেলার কারণে পাওয়ার প্লে পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
আসলে শুভমন এমন একজন ব্যাটার যিনি উইকেটে থিতু হতে বেশ কয়েকটি বল নেন। তার পর বোলারদের উপর দাপট দেখান। টেস্ট বা এক দিনের ক্রিকেটে এই কৌশল কাজে লাগলেও টি-টোয়েন্টিতে ধরে খেলার কোনও জায়গা নেই। আধুনিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট মানেই শুরু থেকে ধুমধাড়াক্কা খেলা। অবাক হওয়ার হলেও এটাই সত্যি, শুভমন যে ৩০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ওপেন করেছেন, তার মধ্যে মাত্র তিনটিতে ভারত ২০০ বার তার বেশি রান করেছে।
শুভমনের বদলে কে?
এখনকার টি-টোয়েন্টি দলের দিকে তাকালে শুভমনের জায়গা নেওয়ার মতো অনেকে রয়েছেন। তার মধ্যে দৌড়ে সকলের আগে থাকবেন সঞ্জু। ব্যাটিং অর্ডারে নীচে নামতে নামতে এখন দল থেকেই বাদ পড়ে গিয়েছেন। পঠানের কথায়, “আমি যদি সঞ্জু স্যামসন হতাম তা হলে এটাই ভাবতাম, এত পরিশ্রম এবং এত রান করার পর এর থেকে বেশি কিছু পাওয়ার যোগ্য কি ছিলাম না? সঞ্জু নিজেও সেটাই ভাবছে। আমার প্রার্থনা সঞ্জুর সঙ্গে রয়েছে।”
সঞ্জু বা অভিষেকের কেউ ব্যর্থ হলে সেই জায়গা নেওয়ার দৌড়ে যশস্বী রয়েছেন। বিশ্বের অন্য যে কোনও দলে ওপেনার হিসাবে তাঁর জায়গা পাকা হওয়া উচিত। দুর্ভাগ্যবশত ভারতীয় দলে ১৫-১৬ জনের মধ্যেও তাঁর জায়গা হয় না।
শুভমনকে কি বাদ দেওয়া হবে?
আপাতত এই সম্ভাবনা দিবাস্বপ্ন দেখার মতোই। আচমকা দলে ফিরিয়েই যাঁকে সহ-অধিনায়ক করে দেওয়া হয়, খারাপ ফর্ম বা স্ট্রাইক রেটের কারণে তাঁকে বাদ দিলে কোচ এবং নির্বাচকদের মুখ পুড়বে। তা ছাড়া শুভমনকে শুধু তিন ফরম্যাটের অধিনায়কই নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন প্রজন্মের মুখ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। এমন ক্রিকেটারকে চট করে বাদ দিতে চাইবেনও না নির্বাচকেরা। তাই শুভমনের ভবিষ্যৎ আপাতত নিশ্চিত। এখন দেখার, টি-টোয়েন্টিতে নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে তিনি পারেন কি না।