বিশ্বকাপ ফাইনালে উইকেট নিয়ে শেফালি বর্মার উল্লাস। ছবি: রয়টার্স।
বিশ্বকাপের চৌহদ্দির ১০০ কিলোমিটারের মধ্যেও ছিলেন না শেফালি বর্মা। ভারতের বিশ্বকাপের দলে জায়গা না পেয়ে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি প্রতিযোগিতা খেলছিলেন। ফর্মে থাকা প্রতিকা রাওয়াল চোট পেয়ে ছিটকে যাওয়ায় বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের আগে দলে সুযোগ পেয়েছিলেন শেফালি। ফাইনালে সেই শেফালিই ভারতকে চ্যাম্পিয়ন করলেন। ব্যাটে-বলে দাপট দেখালেন তিনি। প্রত্যাবর্তনের কাহিনি লিখলেন ভারতের এই ক্রিকেটার।
বিশ্বকাপের দলে শেফালির সুযোগ পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতোই। তাঁকে নিয়ে কোথাও কোনও আলোচনা হচ্ছিল না। ভারতের ওপেনিং জুটি প্রতিকা ও স্মৃতি মন্ধানা রান পাওয়ায় কেউ তাঁর কথা বলছিল না। কিন্তু প্রতিকা চোট পাওয়ার পরে সেই তাঁর দিকেই নজর দেয় ম্যানেজমেন্ট। তড়িঘড়ি ডেকে পাঠানো হয় তাঁকে। শেফালি এসে শুধু ভাল খেললেন না, দলকে জেতালেন।
তাঁর বিশ্বকাপের দলে সুযোগ পাওয়ার মধ্যে ঈশ্বরের নির্দেশ দেখতে পেয়েছিলেন শেফালি। বলেছিলেন, “প্রতিকার সঙ্গে যা হয়েছে, সেটা খুব দুর্ভাগ্যজনক। কেউ চায় না, একজন ক্রীড়াবিদ ও রকম চোট পাক। কিন্তু যা হয়েছে তা ঈশ্বরের নির্দেশে। ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছেন ভাল কিছু করার জন্য।” সেই নির্দেশের প্রতিদান দিলেন শেফালি।
সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দু’টি চার মারলেও বেশি ক্ষণ টিকতে পারেননি। ফাইনালে ৪৫ হাজার দর্শকের সামনে শেফালি লম্বা ইনিংল খেললেন। ৭৮ বলে ৮৭ রান করলেন ভারতের ওপেনার। তাঁর ব্যাটে ভর করে বড় রান করল ভারত। শেফালি ভাল শুরু না দিলে ২৯৮ রান করা সম্ভব হত না হরমনপ্রীত কৌরদের।
২১ বছর ২৭৮ দিন বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনালে অর্ধশতরান করলেন শেফালি। পুরুষ ও মহিলাদের ক্রিকেট মিলিয়ে বিশ্বকাপ ফাইনালে সর্বকনিষ্ঠ ওপেনার হিসাবে শতরান করলেন তিনি। পুরুষদের ক্রিকেটে এত দিন এই রেকর্ড ছিল বীরেন্দ্র সহবাগের দখলে। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ২৪ বছর ১৫৪ দিন বয়সে অর্ধশতরান করেছিলেন তিনি। শেফালি নিজের আদর্শ মনে করেন সহবাগকে। তাঁর খেলার ধরন অনেকটা সহবাগের মতোই। শুরু থেকে বড় শট খেলতে পারেন। যত ক্ষণ মাঠে থাকেন, তাঁকে থামানো যায় না। সেই গুরুকেই ছাপিয়ে গেলেন শেফালি। পুরুষ ও মহিলা মিলিয়ে এক দিনের বিশ্বকাপে কোনও ভারতীয় ওপেনার হিসাবেও সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেললেন শেফালি।
আগের ম্যাচে আড়াআড়ি শট খেলতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন শেফালি। এই ম্যাচে নিজের ব্যাটিংয়ে কিছুটা বদল করেন তিনি। অনেক বেশি সোজা ব্যাটে খেলতে শুরু করেন। ফলে বল ব্যাটে ভাল ভাবে আসছিল। ১০০-র বেশি স্ট্রাইক রেটে খেলেন তিনি। একটা সময় পরে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন শেফালি। পায়ে ক্র্যাম্প ধরছিল। ফলে বাধ্য হয়ে বড় শট মারার চেষ্টা করতে গিয়ে আউট হন।
শেফালির কাছে বড় রান আশা করা যায়। কিন্তু বল হাতে তিনি যা করলেন তা কেউ আশা করেনি। ভারতের বিশেষজ্ঞ বোলারেরা যখন উইকেট তুলতে পারছেন না তখন শেফালির হাতে বল তুলে দেন হরমনপ্রীত। ফাটকা খেলেন তিনি। এর আগে এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোট ১৪ ওভার বল করেছিলেন তিনি। সেই শেফালিই ভারতকে খেলায় ফেরান। প্রথম ওভারেই সুনে লুসকে ফেরান তিনি। নিজে বল করে নিজেই ক্যাচ ধরেন।
পরের ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আরও বড় ধাক্কা দেন শেফালি। মারিজ়ান কাপকে আউট করেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার রান তাড়া করার ক্ষেত্রে কাপের বড় ভূমিকা ছিল। সেই কাপকে ফিরিয়ে খেলার রাশ ভারতের হাতে এনে দেন তিনি। সাত ওভারে ৩৬ রান দিয়ে ২ উইকেট নেন তিনি। ম্যাচের সেরাও হন শেফালি।
খেলা শেষে শেফালির মুখে শোনা গেল সেই ঈশ্বরের নির্দেশের কথাই। তিনি বললেন, “ঈশ্বর আমাকে ভাল কিছু করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। এই ম্যাচে সেটাই দেখা গেল। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতেছি। ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।” বাইরে থেকে হঠাৎ করে দলে ঢুকলেও নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছিলেন শেফালি। তিনি বললেন, “আমি খেলার মধ্যেই ছিলাম। নিজের উপর বিশ্বাস ছিল। নিজেকে শান্ত রেখেছিলাম। জানতাম, আমি পারব। আমার পরিবার, বন্ধুরা আমাকে অনেক উদ্বুদ্ধ করেছে।”
ফাইনালে একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিলেন শেফালি। সেটাই করার চেষ্টা করেছেন। শেফালি বললেন, “এই ম্যাচে আমার একটাই লক্ষ্য ছিল। রান করতে হবে। দলের সকলে আমাকে বলেছিল, স্বাভাবিক খেলা থেকে না বেরাতে। আমি নিজের স্বাভাবিক খেলাই খেলেছি। বড় শট মেরেছি। শতরান করতে পারতাম। কিন্তু আমার কাছে দলের রান বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দলের জয়ে আমার যোগদান রয়েছে। এর থেকে ভাল কিছু হতে পারে না।”
শেফালি ভক্ত সচিন তেন্ডুলকরের। এই ম্যাচ সচিন গ্যালারিতে বসে তাঁর ব্যাটিং দেখেছেন। এর থেকে অনুপ্রেরণার আর কিছু হতে পারে না শেফালির কাছে। তিনি বললেন, “সচিন স্যরকে দেখে আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গিয়েছিল। ওঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। উনি সবসময় আমাকে আত্মবিশ্বাস জোগান। উনি কিংবদন্তি। ওঁর কাছে শেখার অনেক কিছু রয়েছে। চেষ্টা করি শেখার। খুব ভাল লাগছে যে উনি আমার খেলা দেখলেন।”