Kolkata Knight Riders' Possible Changes

সবচেয়ে আগে সরাতে হবে ‘মূর্খ’ পণ্ডিতকে, পরের আইপিএলে ছন্দে ফিরতে আরও কী সিদ্ধান্ত নিতে হবে নাইট টিমের কর্তাদের

দুঃস্বপ্নের মরসুম শেষ হয়েছে কলকাতা নাইট রাইডার্সের। গত বারের চ্যাম্পিয়ন এ বার শেষ করেছে পয়েন্ট ক্রমতালিকার আট নম্বরে। পরের বার আবার ছন্দে ফিরতে হলে বেশ কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে শাহরুখ খানের দলকে।

Advertisement

দেবার্ক ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০২৫ ১০:৪০
Share:

(বাঁ দিক থেকে) অজিঙ্ক রাহানে, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত, বেঙ্কটেশ আয়ার, (পিছনে) কেকেআরের মালিক শাহরুখ খান। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

একটা বছর যে কত কিছু ওলটপালট করে দিয়ে যায়! গত বছর এই সময়ে চ্যাম্পিয়ন কেকেআর। এ বছরে এই সময়ে তারা পয়েন্ট ক্রমতালিকায় ধুঁকতে ধুঁকতে আট নম্বরে! গোটা মরসুম ধরে নাইট রাইডার্সের পতনের ধারা অব্যাহত থেকেছে। বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়েছে শেষ ম্যাচে হায়দরাবাদের কাছে ১১০ রানে হেরে। ঘটনাচক্রে, এক বছর আগে এই হায়দরাবাদকেই ফাইনালে ১১৩ রানে শেষ করে দিয়ে আট উইকেটে জিতে ট্রফি নিয়ে গিয়েছিল শাহরুখ খানের নাইট রাইডার্স। এ এক আশ্চর্য সমাপতন বইকি।

Advertisement

এ বার কেকেআরের হাল কতটা খারাপ ছিল, তা বোঝাতে দুটো পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। প্রথমত, দলের সর্বোচ্চ স্কোরার অধিনায়ক অজিঙ্ক রাহানে (১৩ ম্যাচে ৩৯০ রান)। যাঁর খেলার ধরন টি-টোয়েন্টি তো বটেই, এক দিনের ক্রিকেটের সঙ্গেও এখন খাপ খায় না। দুই, কেকেআরের হয়ে সবচেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন বৈভব অরোরা। যিনি ওভার প্রতি ১০ রানের বেশি দিয়েছেন। এমনকি, সব ম্যাচে তাঁকে দিয়ে চার ওভার বলও করানো যায়নি।

মেগা নিলামে দল গুছিয়ে নেওয়ার জন্য তিন বছর অন্তর প্রতিটা দলকে একটা করে সুযোগ দেয় আইপিএলের গভর্নিং কাউন্সিল। কিন্তু এ বার তা কাজে লাগাতে পারেনি কেকেআর। প্রথম থেকেই অনেক পিছিয়ে পড়েছিল তারা। কোথায় সমস্যা হল? পরের বার সম্মানজনক জায়গায় ফিরতে পারবে কলকাতা? তার জন্য কী কী বদল আনতে হবে?

Advertisement

সরাতে হবে ‘মূর্খ’ পণ্ডিতকে

ব্রেন্ডন ম্যাকালাম ইংল্যান্ডের কোচ হয়ে যাওয়ায় কলকাতা প্রধান কোচ করে এনেছিল চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে বড় নাম। মুম্বইকে রঞ্জি জিতিয়ে প্রথম নজর কেড়েছিলেন। তার পরে তাঁর কোচিংয়ে বিদর্ভ দু’বার ও মধ্যপ্রদেশ এক বার রঞ্জি জিতেছে। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে ‘দ্রোণাচার্য’ তিনি। কিন্তু রঞ্জি আর আইপিএল তো এক নয়! ২০২৩ থেকে তাঁর তিন বছরের রিপোর্ট কার্ড এই রকম—প্রথম বছর বকলমে কোচিং করাতেন অভিষেক নায়ার। গত বার মেন্টর গৌতম গম্ভীর দল চালিয়েছেন। এ বারের ফলাফল সকলের চোখের সামনে রয়েছে। ‘কড়া কোচ’ বলে পণ্ডিতের নামডাক রয়েছে। দু’বছর আগে প্রকাশ্যেই ক্রিকেটার আশুতোষ শর্মা বলেছিলেন, পণ্ডিত তাঁর কেরিয়ার শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। আশুতোষের পাশাপাশি কেকেআরের বিদেশি ক্রিকেটারেরাও তাঁর সমালোচনা করেছিলেন। এ বার সমালোচনা হচ্ছে নিলামের টেবিলে তাঁর ভূমিকার জন্য। শ্রেয়স আয়ার বা ফিল সল্টের মতো ক্রিকেটারদের সরিয়ে বাতিল, বুড়ো ক্রিকেটারদের নিলামে কিনেছেন পণ্ডিত। ঘটনাচক্রে, এ বারই তাঁর চুক্তি শেষ হচ্ছে। পরের বার আর কলকাতার ডাগআউটে হয়তো দেখা যাবে না তাঁকে। এর পরে কলকাতার কোচ হওয়ার সম্ভাবনা অভিষেকের। তিনি দীর্ঘ দিন দলের সঙ্গে যুক্ত। গম্ভীরের সঙ্গেও কাজ করেছেন। জাতীয় দলে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তাঁর। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অবশ্য নাইট টিমের কর্তাদের।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

বদলাতে হবে কোচিং স্টাফে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ‘দলবাজি’

গম্ভীর চলে যাওয়ায় এ বার কেকেআর দলের মেন্টর করেছিল ডোয়েন ব্র্যাভোকে। টি-টোয়েন্টিতে ক্রিকেটার ব্র্যাভো ছিলেন অনেক অধিনায়কের তুরুপের তাস। তাঁর পারফরম্যান্স ওয়েস্ট ইন্ডিজ় এবং চেন্নাই সুপার কিংসকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছে। কিন্তু ভাল প্লেয়ার হলেই ভাল মেন্টর বা কোচ হওয়া যায় না। ফুটবলেও তার উদাহরণ রয়েছে (সবচেয়ে বড় উদাহরণ দিয়েগো মারাদোনা)। ব্র্যাভোও সেই ক্লাবের সদস্য। কলকাতায় এসে ব্র্যাভো মাঝেমাঝে কেকেআরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা টিম হোটেলে ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ গান গেয়েছেন। হোলিতে রং মেখে নেচেছেন। বাঙালি খাবার খেয়ে বাংলায় প্রশংসা করার চেষ্টা করেছেন। খেলা শেষে দেশীয় সতীর্থ রাসেল, নারাইন, পাওয়েলের সঙ্গে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে গল্পগাছা করেছেন। কেকেআর ম্যাচ জিতলে হোটেলে ফিরে সকলের আগে বাকিদের মুখে কেক মাখিয়েছেন। গত বার গম্ভীরের কাজকর্মের পাশে রাখলে ব্র্যাভো ইনিংসে হারবেন! তবে তিনি একে একে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ওটিস গিবসন, কার্ল ক্রো’কে সাপোর্ট স্টাফ হিসাবে নিয়ে এসেছেন। সাহস করে মেন্টর-সহ এই সাপোর্ট স্টাফ বদলাতে হবে নাইটদের।

বাদ দিতে হবে ২৪ কোটির ‘ফ্লপ’ বেঙ্কটেশকে

এ বার নিলামের আগে তাঁকে কেকেআর ধরে না রাখায় কেঁদে ভাসিয়েছিলেন। সেই কান্নায় কি মন ভিজে গিয়েছিল বেঙ্কি মাইসোর বা পণ্ডিতের? তাই নিলামে কোনও ক্রিকেটারের জন্য ১০ কোটির বেশি দাম দিতে না চাইলেও বেঙ্কটেশ আইয়ারকে তারা কিনেছিল ২৩ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকায়। নিলামের মঞ্চেই গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। বেঙ্কটেশ ভেবেছিলেন, তিনিই অধিনায়ক হবেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁকে সহ-অধিনায়ক করে কেকেআর। ২৪ কোটির বেঙ্কটেশ কী করেছেন? ১১ ম্যাচে ১৪২ রান। ২০.২৯ গড়। তার মধ্যে একটি ম্যাচেই (ঘরের মাঠে হায়দরাবাদের বিরুদ্ধে) ৬০ রান করেছিলেন। মিডল অর্ডারে কেকেআরের ব্যর্থতার বড় কারণ হয়ে থেকেছেন। না পেসারদের খেলতে পেরেছেন, না স্পিনারদের। পরিস্থিতি এমন হয় যে, কয়েকটা ম্যাচে সহ-অধিনায়ককেই ‘ইমপ্যাক্ট সাব’ হিসাবে মাঠে নামাতে হয়েছে! ১১টা ম্যাচের পর তাঁকে আর খেলানোই যায়নি। মিনি নিলামে বেঙ্কটেশকে ছাড়লে কলকাতার পকেট খানিক ভারী হবে। তা দিয়ে নতুন ক্রিকেটার কিনতে পারবে তারা। বেঙ্কটেশ দল পাবেন কি না, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ থেকে যাবে।

কেকেআর দল। ছবি: পিটিআই।

অধিনায়ক বদলাতে হবে

ব্যাট হাতে মুখরক্ষা করলেও রাহানের অধিনায়কত্ব ডুবিয়েছে। মাঠে নেমে তিনি যে সব ভুল করেছেন, তা পাড়ার ক্রিকেটেও দেখা যায় না। প্রতিটা টসের আগে বলেছেন, পিচ বুঝতে পারছেন না। ঘরের মাঠে হেরে পিচের দোষ দিয়েছেন। মন্থর উইকেটে স্পিনার কমিয়ে পেসার বেশি খেলিয়েছেন। আবার সবুজ উইকেটে স্পিনার বেশি খেলিয়েছেন। ব্যাটিং অর্ডারে কাকে কত নম্বরে নামাবেন ঠাহর করতে পারেননি। প্রতিটা ম্যাচে কেকেআরের বোলিং আক্রমণ গতে বাঁধা থেকেছে। পাওয়ার প্লে-তে কারা, মাঝের ওভারে কারা আর কারা ডেথ ওভারের বোলার, সম্ভবত সেটা মুখস্থ করে আসতেন। না ছিল ‘প্ল্যান বি’, না ফাটকা, না কোনও সাহসী সিদ্ধান্ত। অধিনায়কের কাঁধ ঝুলে গেলে টিম লড়বে কী করে। রাহানেকে দিয়ে চলবে না। তিনি ব্যাটার থাকুন, অধিনায়ক নয়। তবে তাঁর বদলে কাকে অধিনায়ক করা হবে, সেটাও ভাবনার বিষয়। কেকেআরকে তাকিয়ে থাকতে হবে নিলামের দিকে। অন্য দলগুলো কাদের ছাড়ে, তা দেখে বাছতে হবে তরুণ কাউকে। যশস্বী জয়সওয়াল রাজস্থান রয়্যালস সত্যিই ছাড়লে ওপেনার এবং অধিনায়ক হিসাবে তাঁর কথা ভাবতে পারে কেকেআর।

বুড়ো, বাতিলদের ছ‌াঁটতে হবে

আন্দ্রে রাসেল দীর্ঘ দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের জাতীয় দলের বাইরে। বিভিন্ন দেশে ‘খেপ’ খেলে বেড়ান। শরীরের যা অবস্থা, তাতে দু’বল খেলে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন। দৌড়োতে পারছেন না। তবু কেকেআরে একের পর এক ম্যাচে খেলেছেন। কুইন্টন ডি’কক আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন। তাঁকে ঢাকঢোল পিটিয়ে নিয়ে এসেছে কেকেআর। মণীশ পাণ্ডে এখন রঞ্জি দলেও সুযোগ পান না। তিনি রয়েছেন মিডল অর্ডারে। সুনীল নারাইনের ব্যাটে বল লাগলে ভাল। নইলে গেল। বলের ধারও কমেছে। ফিল্ডিংয়ের কথা না বলাই ভাল। মোটামুটি দর্শকের ভূমিকায় থাকেন। কেকেআরের এই দলে ১৩ জন ক্রিকেটারের বয়স তিরিশের বেশি। এঁদের ছেঁটে ফেলতে হবে। নজর দিতে হবে তরুণ ক্রিকেটারদের দিকে। যেটা মরসুমের মাঝপথ থেকেই করতে শুরু করেছে ধোনির চেন্নাই। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, নিউ জ়িল্যান্ডের অনেক ক্রিকেটার বিভিন্ন দেশের লিগে খেলেন। তাঁরা বড় নাম নন, কিন্তু কার্যকরী। ‘স্পটার’ লাগিয়ে তেমন ক্রিকেটার খুঁজে আনতে হবে। তাঁদের নাম নিলামে নথিভুক্ত করাতে হবে। তার পরে দলে নিতে হবে। টি-টোয়েন্টি তরুণদেরই খেলা— বুঝতে হবে কেকেআর টিম ম্যানেজমেন্টকে।

নিতে হবে অনামি দেশীয় ক্রিকেটার

এখন গোটা দেশে অজস্র টি-টোয়েন্টি লিগ হয়। সেখান থেকে ক্রিকেটার তুলে আনা যায়। সবচেয়ে বড় উদাহরণ সাই সুদর্শন। সুদর্শনকে তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগ থেকে তুলে এনেছিল গুজরাত টাইটান্স। আইপিএলে ভাল খেলেই ইংল্যান্ড সফরে সুযোগ পেয়েছেন। পঞ্জাবের প্রিয়াংশ আর্য, মুম্বইয়ের অশ্বনী কুমার ও বিগ্নেশ পুথুরও তেমনই প্রতিভা। প্রিয়াংশ দিল্লি প্রিমিয়ার লিগে নজর কেড়েছেন। অশ্বনী, বিগ্নেশকেও একই ভাবে নিয়েছে মুম্বই। কলকাতাকে ভারতের বিভিন্ন শহরের লিগে নজর রেখে ‘প্রতিভাবান’ মনে হলে সই করাতে হবে। মনে রাখতে হবে, অপরিচিত ক্রিকেটারেরা মাঠে নেমে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেন। আইপিএলের মঞ্চ অতীতেও এঁদের মধ্যে থেকেই তারকা তৈরি করেছে। সেই প্রতিভা বেছে বেছে আনতে হবে কেকেআর টিম কর্তাদের। নইলে ‘কেকেহার’ তকমা ঘোচার সম্ভাবনা কম।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement