জীবনের তেতো স্মৃতি দ্রুত মুছে ফেলার তাগিদে সকাল থেকেই ছুটছেন। কখনও কেরল ব্লাস্টার্সের প্রশাসনিক কাজে। কখনও সতীর্থ ফুটবলারদের দরকার মেটাতে। আসলে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া প্রাক্তন ইংল্যান্ড বিশ্বকাপার গোলকিপার সদ্য তাঁর প্রায় যাবতীয় স্মারক নিলামের ধাক্কা সামলে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন। সচিন তেন্ডুলকরের আইএসএল দলের সেই ম্যানেজার-কাম-মার্কি ফুটবলার ডেভিড জেমস বৃহস্পতিবার প্রবল ব্যস্ততার ফাঁকেও কোচির টিম হোটেলের লবিতে একান্ত সাক্ষাত্কার দিলেন আনন্দবাজারকে।
প্রশ্ন: মধ্য চল্লিশেও চুলের স্টাইল নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করা অভ্যাস আপনার। ব্যাপারটা কি ইয়ং বয়সে আরও বেশি ছিল?
জেমস: অনেক বছর আগে ওয়েস্ট হ্যামে খেলার সময় ব্লিচ করা ফ্যাকাশে চুল রেখেছিলাম। কিছু দিনের মধ্যেই পাল্টে ফেলি। ওই হেয়ার স্টাইলের জন্য আমাকে লজ্জায় পড়তে হয়েছিল। এক দিন নিউক্যাসলের এক পাব-এ কয়েকজন বন্ধু নিয়ে ঢুকতেই সবাই আমাকে দেখে হো হো করে হাসতে লাগল। ওটা বোধহয় আমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা।
প্র: লম্বা চুলও কেটে ফেললেন কেন? ওটা তো বিশ্ব ফুটবলে আপনার ট্রেডমার্ক!
জেমস: লম্বা চুল দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু যত্ন করাটা খুব ঝামেলা। দু’সপ্তাহ অন্তরই ট্রিম করতে হত। ব্যাপারটা কষ্টকর। যখন করতাম, যন্ত্রণা হত। দু’-এক দিন খুব ব্যথা থাকত। মাথায় জল দেওয়া দূরের কথা, হাত লাগাতেও পারতাম না।
প্র: আপনার দেখা সেরা গোলকিপার কে?
জেমস: ব্রুস গ্রোবেলার। আমি লিউটনের সঙ্গে লিভারপুলের একটা ম্যাচে ওকে প্রথম খেলতে দেখেছিলাম। আর ব্রুস সেই ম্যাচে যা যা করেছিল, সব কিছু আমার অসাধারণ লেগেছিল। গোলকিপার হওয়ার স্বপ্ন দেখাও আমার তখন থেকে শুরু।
প্র: ওই দিন ব্রুস গ্রোবেলারকে না দেখলে ডেভিড জেমস কী হতেন?
জেমস: ঝাড়ুদার হতাম (হাসতে হাসতে)। মজা করছি, অন্য ভাবে নেবেন না। প্রথম দিকে আমার আর্মিতে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। পরের দিকে হাইজাম্পার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে গোলকিপার হওয়া লেখা থাকলে, সেটাকে আর বদলাব কী করে!
প্র: এক জন সফল গোলকিপার হওয়ার জন্য প্রধান গুণ কী-কী?
জেমস: এক— শেখার ইচ্ছা। সেটা যেমন ভুল থেকে তেমনই ঠিক থেকেও। দুই— কোয়ালিটি ট্রেনিং। দু’ঘণ্টা ধরে এক টানা একশো-দু’শোটা সেভ প্র্যাকটিস করে গেলাম, তাতে কোনও লাভ নেই। সুনির্দিষ্ট ভাবে প্র্যাকটিস করা দরকার। পনেরোটা বল সেভ করব, কিন্তু সেটা যেন একই ধরনের হয়। যেমন, আজ শুধু বাঁ-দিকেই শরীর ছুড়ে সেভ ধরব। পরের দিন শুধু আউটিং-ই করব...।
ভারতে আসার পরে একটা ভিডিও শু্যট করেছিলাম। সেখানে মুম্বই টিমের গোলকিপারকে (সুব্রত পাল) দেখছিলাম বল নিয়ে প্রচুর কেরামতি দেখাচ্ছে। খুব ভাল। কিন্তু সেটা যদি গোলকিপারের কাজে না লাগে, তা হলে আর লাভ কী? সে দিন ওকে ডেকে সেটা বলেওছিলাম।
প্র: আইএসএলের সেরা গোলরিপারকে কে?
জেমস: আপনাদের কলকাতার রয় (শুভাশিস রায় চৌধুরি) আর মুম্বইয়ের সেই ছেলেটা— পল (সুব্রত পাল)। দু’জনেরই গোলকিপিংয়ের একটা নির্দিষ্ট স্টাইল আছে।
প্র: তিন মাস ভারতীয় ফুটবল দেখে আপনার উপলব্ধি কী?
জেমস: প্রতিভাবান ফুটবলারে ভরা। কিন্তু কী করে প্রতিভার সদ্ব্যবহার করতে হয় সেটা জানে না। ওয়েস্টেজ অব ট্যালেন্ট।
প্র: কোথায় সমস্যা মনে হচ্ছে?
জেমস: সবচেয়ে বড় সমস্যা পরিকাঠামোয়। আমাদের ওখানে একশোভাগ সমান টার্ফে খেলা হয়। গোটা ভারত ঘুরেও এখানে সে রকম টার্ফ কোনও স্টেডিয়ামে খুঁজে পেলাম না। সব মাঠই অসমান। তা ছাড়া প্র্যাকটিস আর ম্যাচ খেলার মাঠ এক! আমাদের ওখানে হলে তো ঢুকতেই দিত না। স্টেডিয়াম গ্রাউন্ডে প্র্যাকটিস আর ম্যাচ মিলে এত বেশি খেলা হলে আর মাঠের দোষ কী! সব টিমকে প্র্যাকটিসের জন্য আলাদা মাঠ তৈরি করতে হবে।
প্র: তাও আইএসএলে আপনার দেখা সেরা মাঠ কোনটা?
জেমস: দিল্লির মাঠটা। তবে স্টেডিয়ামেরটা নয়। ওখানে একটা রাগবি মাঠে প্র্যাকটিস করেছিলাম। সেটা তুলনামূলক ভাবে অনেক ভাল।
প্র: আপনার ফুটবল জীবনের সেরা সময় কোনটা?
জেমস: পোর্টসমাউথে খেলার সময়টা। ওখানে যেমন আকাশ ছুঁয়েছি, তেমন মাটিতে আছাড়ও খেয়েছি। দু’টো এফএ কাপ ফাইনাল খেলেছি। আবার অবনমনেও পড়েছি।
প্র: জীবনের সবচেয়ে বড় আফসোস?
জেমস: ২০০২ বিশ্বকাপে গ্রুপ লিগে আর্জেন্তিনা ম্যাচটা না খেলতে পারা। রিজার্ভ বেঞ্চে বসে সিম্যানের উপর খুব রাগ হচ্ছিল। ভাবছিলাম ইস, ওর জায়গায় যদি আমি খেলতে পারতাম! কিন্তু বেকহ্যামের গোলে যখন ম্যাচটা জিতলাম, তখন সব ভুলে গিয়েছিলাম। খেলার শেষে সবার আগে মাঠে ঢুকে আমিই বেকহ্যামের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলাম।
প্র: এত বছর খেলার পর এ রকম দুঃখের দিন নেমে আসবে জীবনে কখনও ভেবেছিলেন? নিজের প্রায় যাবতীয় ফুটবল স্মারক নিলাম হওয়াটা কী ভাবে দেখছেন?
জেমস: (হাসি উধাও। গম্ভীর গলা) টাইম ওভার। থ্যাঙ্ক ইউ।