দুপুর সাড়ে বারোটা। জায়গাটা গুয়াহাটির গোটা নগর।
এক দিকে তাকালে, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। তার উল্টো দিকে একটা পাঁচতারা হোটেল। আটলেটিকো দে কলকাতার পাহাড়ি ঠিকানা। এলাকাটা কেমন যেন নিঝুম, শুনশান।
টিমটা ওই সাড়ে বারোটা নাগাদ ঢুকল যখন, বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। আটলেটিকো কোচ জোসে মলিনার মুখটা দেখলেও তখন গুয়াহাটি আকাশের সঙ্গে মিল পাওয়া যেত। মেঘলা, গম্ভীর। দেখলে, কথা বললে এটিকে সুপ্রিমোর বিষাদটা বোঝা যায়। উপস্থিত জনাকয়েক সাংবাদিক দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আপনারা ক্যালকাটা থেকে?’’ একটু পর যন্ত্রণাটা যেন আরও স্পষ্ট হয়। ‘‘কী করব আর? চেষ্টা করব স্ট্যান্ড থেকে টিমটাকে উৎসাহ দেওয়ার।’’
আটলেটিকো কোচের এমন বিমর্ষ প্রতিক্রিয়া যথাযথ। চব্বিশ ঘণ্টা পর নর্থ-ইস্ট ম্যাচে তো নেই তিনি। ডাগআউটেও নেই।
এমনিতে কলকাতা-সংসার দেখলে কোথাও দারুণ বিষাদ-ছায়া পাওয়া যাবে না। মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে টিমটা হেরেছে, নর্থ-ইস্টকে নিয়ে টেনশনও আছে কিছুটা, কিন্তু একেবারে ধ্বস্ত মোটেও হয়ে যায়নি। ইয়ান হিউমকে পাওয়া গেল। কানে হে়ডফোন গুঁজে কোচের পিছনে ঢুকছিলেন। প্রশ্ন করায় বিরক্ত হলেন একটু। কিন্তু এটাও শুনিয়ে দিলেন যে, তিনি তৈরি। টিমের মিডফিল্ড মার্শাল বোরহা ফার্নান্দেজ ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বলে গেলেন, ‘‘নর্থ ইস্ট? ইয়েস দে আর গুড টিম। বাট উই আর গুড টু!’’ হেল্ডার পস্টিগা— তাঁকেও তো বেশ ঝরঝরে মেজাজে পাওয়া গেল। তবে শুক্রবারের ম্যাচে খেলবেন কি না, জানতে চাওয়ার আগে পর্যন্ত! প্রশ্নটা শোনামাত্র গটগটিয়ে লিফট ধরে উঠে গেলেন।
সংক্ষেপে, এটাই বৃহস্পতিবারের এটিকে। এবং কিছুতেই পুরোটা নয়!
যতই মলিনা ডাগআউটে না থাকুন, যতই তাঁকে নির্বাসনে যেতে হোক, তাঁর মস্তিষ্ক কোথাও যাচ্ছে না। আন্তোনিও লোপেজ হাবাসের আমলে কলকাতার সহকারী কোচ হয়েছিলেন বাস্তব রায়। সেই বঙ্গসন্তানই পাহাড়ে এটিকে কোচের দায়িত্বে থাকবেন। পূর্ণ দায়িত্বে আইএসএল ডাগআউটে কোনও বাঙালি— বাস্তব-ই প্রথম। কিন্তু শোনা গেল, স্ট্র্যাটেজি, খেলার স্টাইল কিছুই পাল্টাচ্ছে না এটিকের। মলিনা যে ভাবে এত দিন টিমকে খেলাতেন, এটিকে শুক্রবার সে ভাবেই খেলবে। মলিনা যে স্ট্র্যাটেজিতে এত দিন চলতেন, টিম শুক্রবার তাতেই চলবে।
প্র্যাকটিসে তার ইঙ্গিত পাওয়া গেল। মনে হল, কলকাতা তাদের চেনা ফর্মেশনেই নামতে চলেছে। সেই ডাবল পিভট রেখে ‘লোন’ স্ট্রাইকার। মলিনার পরিবর্তে এটিকের দায়িত্বে থাকা বাস্তবও বলে গেলেন, ‘‘কোচ মাঠে হয়তো থাকতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের সঙ্গেই আছেন।’’ কোচও বুঝিয়ে গেলেন আছেন। মলিনা ম্যাচে না থাকতে পারেন, কিন্তু তাই বলে নর্থ-ইস্ট নিয়ে পড়াশোনা বন্ধ করেননি। বুঝতেও পারছেন যে, যুদ্ধটা সহজ হবে না। বললেন, ‘‘আসলে টিমটা ওদের বেশ ভাল। আক্রমণ, রক্ষণ দু’টোই।’’
ভুল বলেননি মলিনা। শুক্রবার যে টিমটার বিরুদ্ধে নামছে এটিকে, তারা সম্ভবত নিজেদের সেরা ফর্মের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আইএসএল ইতিহাসে এত ভাল শুরু আর করেনি নর্থ-ইস্ট। সবচেয়ে চোখ টানছে, তাদের পাসিং ফুটবল। আক্রমণে কাতসুমি থেকে মাঝমাঠে জোকোরা— নর্থ-ইস্ট মানে যেন এখন অবিসংবাদী দাপট। আইএসএল টেবলে প্রথম তিনে। কোচ নেলো ভিনগাদা বললেন বটে যে, ম্যাচটা সমানে-সমানে হবে। কারণ, তাঁর ভেলেজ আর রোমারিচের চোট। নর্থ-ইস্ট কোচ এটাও বললেন যে, ‘‘কলকাতা ব্যালান্সড টিম। দু’টো টিমই চেষ্টা করবে এক নম্বরে যাওয়ার।’’
কিন্তু আদতে তা নয়। যুদ্ধে নর্থ-ইস্ট এগিয়ে শুরু করবে। ঘরের মাঠে খেলা, পাহাড়ি সমর্থন এবং আরও এক জনের জন্য। শোনা গেল, প্রতিটা ম্যাচের আগে নাকি এসে টিম মেন্টরের কাজ করে যাচ্ছেন। প্রবল উৎসাহ দিচ্ছেন ফুটবলারদের। নিজের সিনেমার প্রোমোশনের কাজকর্মও তাঁকে আটকাতে পারছে না। তিনি জন আব্রাহাম, যাঁর ফুটবল-পাগলামি এখন আর বিস্ময় শোনায় না।
এটিকের সমস্যা সেখানে শুধু কোচের অনুপস্থিতিতে সীমাবদ্ধ নেই। টিমের মার্কি প্লেয়ার— পস্টিগাকে নিয়েও আছে। নামবেন তিনি? পারবেন তিনি? টিমের অর্ন্তবর্তিকালীন কোচ পস্টিগা প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘এমনি এমনি কাউকে নিয়ে আসা হয় না। তবে ও খেলবে কি না, ঠিক হবে কাল।’’ শোনা গেল, খেলার একটা সম্ভাবনা আছে। তবে নিশ্চিত করে বলার কোনও জায়গা নেই। প্রশ্নটা পস্টিগাকেও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। উত্তরে শুধু বললেন, ‘‘অ্যায়াম ফ্রেশ। অ্যায়াম ওকে।’’
‘ওকে’ হলেই ভাল। ‘ফ্রেশ’ থাকলেই স্বস্তি। লা লিগায় আটলেটিকো মাদ্রিদের একটা ট্র্যাডিশন আছে। যত বার তারা চোখের সামনে সাদা জার্সির প্রতিবেশী পায়, জ্বলে ওঠে ঠিক তত বার। সাম্প্রতিক ইতিহাস বলে, রিয়াল মাদ্রিদের সেরা কাঁটার নাম আটলেটিকো মাদ্রিদ। কাকতালীয় শোনাতে পারে। কিন্তু মজার হল, আটলেটিকো কলকাতার শুক্রবারের প্রতিপক্ষের জার্সির রংও একদম সাদা, ধবধবে সাদা!
মলিনা না থাকতে পারেন। পস্টিগা-ধোঁয়াশা থাকতে পারে। নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডও কৌলিন্যে রিয়াল মাদ্রিদের তিন হাজার মাইলের মধ্যে না থাকতে পারে। কিন্তু সাদা জার্সি দেখে স্পেনীয় ‘দাদা’দের স্ফূলিঙ্গের ছিটেফোঁটা কলকাতার ‘ভাই’দের মধ্যে আশা করাটা কি একেবারে অন্যায় হয়ে যাবে?