অনেক খোঁজাখুঁজির পর আই এস বিন্দ্রা স্টেডিয়ামে একটা ছোট ঘরে পাওয়া গেল তাঁকে। স্বয়ং আই এস বিন্দ্রাকে।
অনেক থুরথুরে হয়ে গিয়েছেন। ওয়াকিং স্টিক লাগে তবু বললেন, ফাইনালে ভারত উঠলে যে করে হোক কলকাতা আসবেন। বিশ্বকাপ দেখছেন টিভিতে? বিন্দ্রা বলেন, ‘‘ধোনির ম্যাচটা দেখেছি। যেটা কেবল ওর অনবদ্য স্ট্র্যাটেজি জিতিয়েছে। বাংলাদেশ হারেনি। ধোনি ওদের হারতে বাধ্য করেছে।’’
রবি শাস্ত্রী বিকেলে চণ্ডীগড়ের হোটেলে বসে একই কথা বলছিলেন, ‘‘কী অসম্ভব ক্ষিপ্র ধোনির বুদ্ধি দেখলেন? শেষ মুহূর্তে ওই রকম চাপের মুখেও নার্ভ হারায় না। সাধে কী আর আমি এত দিন ধরে বলে আসছি ও-ই ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক? টেস্টে ওর আরও কিছু হয়তো উন্নতি করা বাকি ছিল। কিন্তু ওয়ান ডে আর টি-টোয়েন্টিতে ধোনি জাস্ট তুলনাহীন।’’
কাশ্মীর থেকে এ দিন হাজার দেড়েক মানুষ মোহালি স্টেডিয়াম চলে এসেছিলেন আফ্রিদিদের সমর্থন করতে। অবশ্যই ভারত অধিকৃত কাশ্মীর! এর চেয়ে বিস্ময়কর কিছু মাঠে অবশ্য ঘটেনি। সেই যা আন্দাজ করা হয়েছিল অবিকল তেমনই পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে গেল শুক্রবারের মোহালি। ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া নক আউটই শুধু হয়ে দাঁড়াল না, আপাতত ম্যাচটা টুর্নামেন্টের সরাসরি কোয়ার্টার ফাইনাল। তার আগে অবশ্য ধোনি নিয়ে চারপাশের প্রশস্তি টিমের ইমেজের সঙ্গে বাড়তি প্রাচীর যোগ করছে। অস্ট্রেলিয়ার জন্য দাঁড়িয়ে গেল, শুধু ইন্ডিয়াকে হারালে হবে না ধোনিকে হারাতে হবে। যে কিনা ম্যাচের শেষ বল পর্যন্ত জীবন্ত থাকে!
অথচ এ বারের বিশ্বকাপের প্রথম দু’টো ম্যাচে নিজের মাপে ধোনি একেবারেই ভাল ক্যাপ্টেন্সি করেননি। নাগপুরে স্পিনিং পিচ বুঝতে না পারায় হরভজনকে খেলাননি। ইডেনে অশ্বিনের কোটা শেষ করাননি। হার্দিককে ভুল সময় এনেছিলেন। শেষ বলে সে দিন হার্দিককে বাউন্সার করতে বলার আইডিয়াটাও নাকি শুনলাম অশ্বিনের।
কিন্তু চিন্নাস্বামীর রাতের ওই বিহ্বল করা সময়ে যে ভাবে শেষ তিনটে বল তিনি দল পরিচালনা করেছেন তা দেখে ক্রিকেট-দুনিয়া মোহিত হয়ে গিয়েছে। পাকিস্তান সাংবাদিকেরা দেখাচ্ছিলেন দেশ থেকে পাকিস্তানি আওয়ামের প্রতিক্রিয়া—ক্যাপ্টেন হতে হলে ধোনির মতো। ক্যাপ্টেন না হতে হলে আফ্রিদির মতো।
পাকিস্তান যখন আকুল ভাবে বলছে আফ্রিদি কেন আরও আটচল্লিশ বা বাহাত্তর ঘণ্টা সময় নিচ্ছে রিটায়ার করতে? তখন ভারতীয় ড্রেসিংরুম বলছে, আর্ট অব ক্যাপ্টেন্সির নতুন সংস্করণ মাইক ব্রিয়ারলি নয়, একমাত্র মাহিই লিখতে পারে। ক্রিকেট অধিনায়কত্বের ব্যাকরণই ও বদলে দিয়েছে। ভারতীয় টিম ডিরেক্টর যেমন বলছিলেন, ‘‘এখনকার দিনে তো টি-টোয়েন্টি আর ওয়ান ডে-ই বেশি হয়। আর এই সব ম্যাচে হঠাৎ হঠাৎ এমন মুহূর্ত আসে যে ক্যাপ্টেনের চাপ নেওয়ার ক্ষমতাটা সবচেয়ে বেশি দরকার হয়। যে সে তার মধ্যেও কতটা স্মার্টনেস দেখিয়ে যেতে পারে। সেটা এমএসডির চেয়ে ভাল কেউ কখনও পারেনি।’’
আর বেঙ্গালুরুর ওই যে শেষ বলের আগে ডান হাতের উইকেটকিপিং গ্লাভস খুলে ফেলা ওটা মনে হচ্ছে হেলিকপ্টার শটের মতোই তাঁর ট্রেডমার্ক হয়ে গেল! টি-টোয়েন্টিতে একই টেকনিক এর আগে ডে’ভিলিয়ার্স অনুসরণ করেছেন। দীনেশ কার্তিক এক-আধবার আইপিএলে করেছেন। ধোনি নিজেই ঢাকার এশিয়া কাপে একবার করেছেন। কিন্তু হৃদরোগীদের জন্য হাতে সরবিট্রেট রাখা মাস্ট এমন শেষ মুহূর্তে গিয়ে গ্লাভস খুলে ফেলা এবং জয়। টেকনিকটা এমন জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছে যে ক্রিকেটবিশ্বের সর্বত্র এখন ছড়াতে থাকবে। স্কুল ম্যাচট্যাচেও টানটান পরিস্থিতি দাঁড়িয়ে গেলে কিপার শেষ ওভারে এক হাতের গ্লাভস খুলে নেবে। দুপুরের পাকিস্তান প্র্যাকটিসেই তো এ দিন দেখলাম কিপার সরফরাজ আহমেদ গ্লাভস খুলে বল ছুড়ছেন। পাকিস্তান আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের কপি করছে এটাই বা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মন্ত্রে চিরদীক্ষিত ধোনির জন্য তোষামোদ হিসেবে খারাপ কী!
টিম ইন্ডিয়ার ধোনি আবিষ্কারের সময় যিনি নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন সেই কিরণ মোরেও দেখা গেল গ্লাভস খুলে নেওয়ার হ্যাংওভারে গভীর আচ্ছন্ন। ভারতের হয়ে ৪৯ টেস্ট আর ৯৪ ওয়ান ডে-তে কিপিং করা মোরে শুক্রবার বডোদরা থেকে ফোনে বলছিলেন, ‘‘এক-আধবার ক্লাব ম্যাচে রান আউট করার লক্ষ্যে গ্লাভস খুলে নেওয়া সে তো আমিও কত বছর আগেই করেছি। কিন্তু ধোনি যা করে দেখাল অবিশ্বাস্য।’’
মোরে মনে করেন, ধোনি ভারতের গ্রেটেস্ট উইকেটকিপারদের একজন হয়েও কখনও প্রাপ্য মর্যাদা পান না। ‘‘কী রেকর্ড দেখুন তো ওর! ধারেকাছে কেউ আছে? তা ছাড়া আমার বরাবর যেটা ভাল লাগে, ধোনি কিপার হিসেবে খুব ক্রিয়েটিভ। ব্যাটসম্যান যেমন ইম্প্রোভাইজ করে আজকালকার দিনে রান করে, কিপারও তাই করে। ধোনি যেমন চিন্নাস্বামীতে রায়নার বলে লেগ সাইডের বাইরে স্টাম্পিংটা করল। পুরোটাই ওর সুযোগ সৃষ্টি করা। কারণ স্টাম্পিং না হলে আম্পায়ার ওটা অবধারিত ওয়াইড ডাকতেন।’’
গ্লাভস খোলার মুহূর্তটা অবশ্য তাঁর মনে সবচেয়ে বেশি গেঁথে গিয়েছে জানালেন মোরে। ‘‘ওর অসুবিধেগুলো ভাবুন। ডান হাতে শুধু কাপড়ের পাতলা ইনার গ্লাভস। বল করছে পেসার। মানে ধরে নেওয়া যায় ডান হাতে জোরে বল লাগবে। সেই যন্ত্রণা সহ্য করে বলটা হাতে জমাতে হবে। মেন্টাল মেক আপ থাকবে যে এই একটা বল আমি স্লিপ ফিল্ডসম্যান। আমার তাই কোনও প্রোটেকশন নেই। সবচেয়ে জরুরি রান আউটের জন্যে বল দ্রুত ছুড়তে হবে। সেটার জন্য শেষ অবধি বল দেখা চাই। সঙ্গে ক্যাপ্টেন হিসেবে এটাও দেখতে হবে ফিল্ডাররা ওই সবচেয়ে চাপের মুহূর্তে ঠিকঠাক পজিশনে আছে কি না। একটা মানুষ কতখানি প্রেশার নিয়ে জিতল ভাবুন তো!’’ বারবার উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়ছেন মোরে।
চরম উত্তেজক প্রেশারে কোনও কোনও কিপার যে গ্লাভস আরও খুলেছেন আগেই লিখেছি। কিন্তু সেটার দৌলতে শেষ বলে রান আউট হয়ে টিম জিতছে এমন নজির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কারও মনে প়ড়ছে না। তাই ধোনির গ্লাভস খোলা ঘটনার বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই লোকগাথাতূল্য ভাবমূর্তি লাভ করেছে।
এ দিন স্টিভ স্মিথ বল হওয়ার আগেই স্টাম্পের দু’হাত বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন দেখেও ওয়াহাব রিয়াজ সেই ব্যাটসম্যানের গায়ের ওপর লো ফুলটস করলেন। বল চলে গেল বাউন্ডারিতে। পাকিস্তানি মিডিয়ার আক্ষেপ সমেত, এই জন্যই ক্রিকেট-দুনিয়ায় আর কেউ ধোনি নয়।