ডংকে নিয়ে চেনা উচ্ছ্বাস। শুক্রবার বড় দলের মেজাজ। ছবি তুলেছেন শঙ্কর নাগ দাস।
দিব্যি রয়েছেন সল্টলেকের বাড়িতে। কিন্তু সনি-কাতসুমি-গ্লেনের সঙ্গে বলবন্ত-জেজের বিভীষিকা সামলানোর কথা উঠতেই লাল-হলুদ শিবিরে তাঁর নাম যে উঠে আসবে কে জানত?
শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা। দলবল নিয়ে প্র্যাকটিসে নামতে চলেছেন বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য অ্যান্ড কোং। ঠিক তখনই ইস্টবেঙ্গল কোচের সহকারী স্যামি ওমোলোর দিকে উড়ে এল প্রশ্নটা—আপনাদের রক্ষণ সনি-গ্লেনদের সামলাতে পারবে তো?
কলকাতা ময়দানের ইতিহাসে প্রথম কিনিয়ান মহাতারকা ডিফেন্ডার যা শুনেই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলেন ঊনিশ বছর আগের এক ডার্বির আগের সকালে। ‘‘সাতানব্বইয়ে মোহনবাগানের ডায়মন্ড সিস্টেম সামলানোর আগেও এ রকম প্রশ্ন শুনেছিলাম। আমাদের কোচ পিকে স্যর ডায়মন্ডের অ্যান্টিডোট বানিয়ে ফেলেছিলেন। কাল আমরাও সে রকমই কিছু একটা নিয়ে নামব।’’
ভরসন্ধেয় যা শুনে সল্টলেকের বাড়িতে বসে হাসেন প্রবীণ পিকে প্রদীপ। ডার্বির সফলতম কোচ বলে দেন, ‘‘কত রাত যে ঘুমোইনি সে বার! তবে আমি নিজের শক্তিতেই বিশ্বাস রেখে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আর আন্ডারডগ ইস্টবেঙ্গল কিন্তু গুলি খাওয়া বাঘের মতোই ভয়ঙ্কর।’’
বাগানের রক্তচক্ষু দেখানো আক্রমণ ভাগের বিরুদ্ধে তাঁর রক্ষণের শক্তি কতটা তা জানতে চাইলে ইস্টবেঙ্গল কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যও তাঁর গুরু পিকের দর্শনই আওড়ালেন। ‘‘ওরা ভাল মানলাম। কিন্তু তার জন্য আমাদের কাঁপতে হবে নাকি। রেকর্ড বই খুলে দেখে নিন, ইস্টবেঙ্গল কাঁপেনি। কাঁপবেও না। উল্টে কাঁপাবে।’’
বড় ম্যাচের আগের সকালে লাল-হলুদের ট্রেনিং সেশনে যেন সেই জোশের প্রতিচ্ছবি। সিচ্যুয়েশন প্র্যাকটিস চলাকালীন র্যান্টি মার্টিন্স এরিয়াল বল রিসিভ করে গোলের দিকে ঘুরছিলেন। উদ্দেশ্য অরক্ষিত জায়গায় ডংকে বলটা ঠেলা। রাইট ব্যাক রাহুল ভেকে ছুটে এসে এমন কোবরা ট্যাকল করে বসলেন যে, বল ছেড়ে ছিটকে পড়লেন র্যান্টি। প্র্যাকটিসে টিমকে ‘চিয়ার আপ’ করতে আসা শ’দুয়েক সমর্থকের হৃদস্পন্দন ততক্ষণে বেড়ে গিয়েছে। এক মিনিট পরে যখন র্যান্টি প্রাথমিক শুশ্রূষার পর উঠে দাঁড়ালেন, গ্যালারিতে স্লোগান শুরু হয়ে গেল, ‘‘হাতে মশাল, হৃদয়ে বারুদ। আমরা হলাম লাল-হলুদ।’’
এ তো গেল আবেগের কথা। কিন্তু মাঠে? সেখানেও মোহনবাগান আক্রমণকে বোতলবন্দি করতে স্ট্র্যাটেজিতে শান দিয়ে রেখেছে ইস্টবেঙ্গল। এ দিন অনুশীলনে রাহুল-অর্ণব-বেলো-রবার্টদের সামনে প্রথমে মেহতাব-রফিক। পরে খাবরা-মেহতাবকে রেখে তা ঝালিয়ে নেওয়া হল পুরোদমে। তার পর সোজা ড্রেসিংরুমে ঢুকে মিনিট চল্লিশের ক্লাস।
যেখানে সনিদের থামাতে নাকি উঠে এসেছে তিনটে ফ্যাক্টর।
এক, বাগানের বেশির ভাগ আক্রমণ শুরু হয় বাঁ দিকে ধনচন্দ্রের পা থেকে। যেখান থেকে বল পেয়ে সনি হয় ডাউন দ্য মিডল ঢুকে পেনিট্রেটিভ জোনে ওয়ান-টু খেলে গোলে শট নেন। না হলে অরক্ষিত গ্লেন-বলবন্তদের বল বাড়ান। কখনও কখনও উইং ধরে উঠে ভাসিয়ে দেয় বিষাক্ত সব ক্রস।
দাওয়াই— ধনচন্দ্র এবং সনির সাপ্লাই লাইন উড়িয়ে দিতে হবে খেলার শুরু থেকেই। শুরু থেকেই সনিকে জোনাল মার্কিং করো। তার পর মাঝমাঠে মেহতাব বা খাবরা তো থাকছেনই।
দুই, কাতসুমির অস্ত্র বল নিয়ে বা বল ছাড়া গতির তাওয়ায় বিপক্ষকে ভাজা।
দাওয়াই— তাঁকে কোনও মতে ফাঁকা জায়গা দেওয়া হবে না ইস্টবেঙ্গলের মিডল করিডরে। যে দায়িত্বে জেনারেলের ভূমিকায় থাকবেন মেহতাব।
তিন, গ্লেন-বলবন্ত বা জেজেরা ছোট জায়গায় শর্ট স্প্রিন্টে গোলের দরজা খুলে ফেলেন। ওভারহেড বলেও সাবলীল বাগানের এই তিন সুযোগসন্ধানী ফুটবলার।
দাওয়াই— তাঁদের চোখে চোখে রাখবেন অর্ণব। আর কভার দেবেন বেলো।
ক্লাসে প্রত্যেকের কথা মন দিয়ে শোনেন কোচ। যেখানে খাবরা নাকি বলেন, ‘‘সনি প্রতি দশ পা দৌড়ের পরই আউটসাইড বা ইনসাইড ড্রিবল করে ডিফেন্সকে ধোঁকা দেয়।’’ সেই তথ্যও গুরুত্ব দিয়ে এ দিন কাঁটাছেঁড়া হয়েছে লাল-হলুদ ড্রেসিংরুমে।
সবুজ-মেরুনের তারকাখচিত আক্রমণ ভাগকে যাঁরা বোতলবন্দির দায়িত্বে তাঁদের পুরোভাগে দুই বঙ্গসন্তান— অর্ণব মণ্ডল আর মেহতাব হোসেন। অর্ণব বললেন, ‘‘ওদের দাওয়াই ওয়ান ভার্সাস টু বা থ্রি। তা হলেই ডাবল বা ট্রিপল কভারিংয়ে পড়ে হাঁসফাঁস করবে।’’ মেহতাব আবার বলে গেলেন, ‘‘কাতসুমি জায়গা পেলে তো দৌড়বে।’’ আর বেলো রজ্জাক বলছেন গেলেন, ‘‘আমার নিজেকে ফের চেনানোর ম্যাচ শনিবার।’’
যুবভারতীতে ‘বাগান আর্মাডা’ ডোবাতে সেই মাইরা ফ্যালামু, কাইট্টা ফ্যালামু মেজাজে যেন হাজির ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্ডাররা।
সঙ্গে শেষ বেলায় বিশ্বজিতের বোমা—‘‘ডংকে কাল প্রথম এগারোয় রাখব কি না ভাবছি।’’
প্রিন্স অব ডেনমার্ক ছাড়া যেমন হ্যামলেট হয় না, সে রকম ডং ছাড়া লাল-হলুদের ডার্বি অভিযান?
লাল-হলুদ সমর্থকরা কিন্তু বলছেন, ‘‘ইয়ে বাত কুছ হজম নেহি হুয়া...।’’