রবি শাস্ত্রী। ছবি:ফাইল চিত্র।
প্রশ্ন: হেড কোচ হিসেবে প্রত্যাবর্তনের পর তো দুরন্ত গতিতে ছুটছে ভারতীয় দল। শ্রীলঙ্কাকে ৯-০ হোয়াইটওয়াশ করা। দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ উড়িয়ে দেওয়া। এটাই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দেশের মাটিতে সেরা ব্যবধানে জয়। রবি শাস্ত্রী নিশ্চয়ই খুব খুশি, খুব তৃপ্ত একজন ব্যক্তি এখন?
রবি শাস্ত্রী: খুব বড় মিথ্যা কথা বলা হবে যদি আমি বলি, ছেলেদের এই পারফরম্যান্সে আমি খুশি বা তৃপ্ত নই। কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে, প্রথম দিন থেকে আমরা কয়েকটা লক্ষ্য পূরণ করতে চেয়েছি। কাগজে কয়েকটা পয়েন্ট নোট করে বলা হয়েছে, এই এই জিনিসগুলো আমরা করতে চাই। তার মধ্যে সব চেয়ে বেশি করে যেটার উপর আমরা গুরুত্ব দিতে চেয়েছি, তা হচ্ছে ধারাবাহিকতা। আমি ছেলেদের নিয়ে গর্বিত যেভাবে ওরা খেলছে এবং যে রকম একাগ্রতা নিয়ে ওরা লক্ষ্যগুলো পূরণ করছে, সেটা দেখে। গত দু’মাস ধরে যে টার্গেট রাখা হয়েছে ওদের সামনে, ওরা ঠিক সেটাই করে দেখাচ্ছে।
প্র: সেই কারণেই কি গত দু’মাস বেশি তৃপ্তিদায়ক আপনার কাছে?
শাস্ত্রী: শুনুন, আমাদের এই টিমটার দর্শনটা একটু অন্য রকম। কাদের সঙ্গে আমরা খেলছি, সেটা আর গুরুত্বপূর্ণ নয়। ক্রিকেট বদলে গিয়েছে। প্রত্যেকটা টিমকে সমান সমীহ, সমান সম্মান করতে হয় এখন। সেই কারণে, তোমার প্রতিপক্ষ নয়, তুমি কী করলে সেটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যেমন ভাবি, আমরা কী করতে পারি। আরও কত রকম ভাবে উন্নতি করতে পারি।
আরও পড়ুন: ধোনির বাড়িতে জিভার গান শুনে মুগ্ধ অনুপম খের
প্র: এই ভারতীয় দলটাকে দেখে মনে হচ্ছে, প্রত্যেকটা ম্যাচই যেন জেতার জন্য খেলতে নামছে। এটাই কি এই দলটার মনোভাব?
শাস্ত্রী: আমি যখন প্রথম ডিরেক্টর হিসেবে চার্জ নিয়েছিলাম, তখনই এই মানসিকতাটা ওদের মধ্যে দেখেছিলাম। তখনই আমরা এই কথাটা আলোচনা করেছিলাম যে, প্রত্যেকটা ম্যাচ জেতার জন্য খেলো। সেটাই ছিল আমার মন্ত্র। শুধু কোচ হিসেবে নয়, যখন আমি নিজে ক্রিকেট খেলেছি, তখনও এটাই ছিল আমার মন্ত্র। সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলার সময় হোক কী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার ক্ষেত্রে। ক্লাব ক্রিকেট, ইউনিভার্সিটি ক্রিকেট, লিগ ক্রিকেট, রঞ্জি ট্রফি, টেস্ট ক্রিকেট— যখনই আমি খেলেছি, প্রত্যেক ম্যাচে জেতার মন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছি। আমার কাছে একটাই ফোকাস গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছে। ইউ প্লে টু উইন। তুমি খেলবে জেতার জন্য। ড্র করার জন্য খেলতে নামাটা কোনও মন্ত্র নয়। তাই তোমাকে ভাবতে হবে, কী ভাবে জিততে পারো।
প্র: এই টিমটার ছেলেদের মনোভাবও তো ভীষণ ইতিবাচক। অনেককেই দেখে মনে হয়, ওঁরা কেউ হারার কথা ভাবেনই না। আপনি ওঁদের কী বলেন?
শাস্ত্রী: আমি ব্যাপারটাকে খুব সহজ রাখায় বিশ্বাসী। কোচ হিসেবে কখনও ক্রিকেট খেলাটাকে আমি জটিল করে তুলতে চাইনি। কিপ থিংগস সিম্পল— আমি এই দর্শনে বিশ্বাসী। জেতার জন্য খেলো, টিম এথিক্স গড়ে তোলো আর সেই এথিক্সকে বোর্ডে টাঙিয়ে দাও। তার পর নিজেরাই নিজেদের বলো, এগুলো আমরা মেনে চলব। শুনুন, ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স আসবে, যাবে। কিন্তু যদি দলগত সংস্কৃতি বা ন্যায়নীতির ভিতটা মজবুত থাকে, তাহলে ভাল জিনিস ঘটতেই থাকবে। এই সিরিজগুলোয় যেমন দেখা যাচ্ছে। কখনও দিনটা ছিল রোহিত শর্মার। কখনও হার্দিক পাণ্ড্যর দিন গেল। কখনও ভুবনেশ্বর কুমারের দিন। কখনও বুমরার দিন। কখনও বিরাটের দিন, কখনও অজিঙ্ক রাহানের। কখনও এম এস ধোনির দিন। কখনও কুলদীপ যাদবের দিন, কখনও যুজবেন্দ্র চহালের। টিমের হাতে আট-নয় বা দশ জন মতো ক্রিকেটার রয়েছে, যারা ম্যাচের নায়ক হয়ে উঠতে পারে। বুমরার কথা ধরুন। যে অনেক ভাল দিন উপহার দিচ্ছে। বা ভুবনেশ্বর। তাই ফোকাসটা হওয়া উচিত দলগত প্রচেষ্টার উপর। সেটা যদি রেখে দেওয়া যায়, এরকম দলগত সাফল্যও আসতে থাকবে।
প্র: এই ভারতীয় দলটা যখন মাঠে খেলতে নামে, ঠিক কী রকম মনোভাব নিয়ে নামে? আপনার ক্রিকেটারদের মাথায় কী ঘুরতে থাকে? ‘অ্যাপ্রোচ’টা ঠিক কীরকম, সেটা জানতে চাইছি।
শাস্ত্রী: ওরা মাঠে নামে সম্পূর্ণ পজিটিভি এনার্জিতে ভরপুর হয়ে। দুঃসাহসিক এক দল ছেলে ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলতে যায়। এটাই হচ্ছে এই টিমটার মনোভাব। হারের ভয় পায় না কেউ। ওটাকে আমরা সিস্টেম থেকে বাদ দিয়ে ফেলছি। মাঠে নামো, নিজের মনের ভাব আর আবেগের উপর পাথর চাপিয়ে না রেখে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে উজাড় করে দাও। ‘এক্সপ্রেস ইওরসেল্ফ’।
গুরুবিদ্যা: কোচ হিসেবে দ্বিতীয় ইনিংসে কুলদীপ যাদবের মতো তরুণ প্রতিভায় জোর দিচ্ছেন শাস্ত্রী। ফাইল চিত্র
প্র: আপনার যে ‘মুভ’টা নিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ায় আলোড়ন পড়ে গেল, সেটা নিয়ে বলুন। ইনদওরে হার্দিক পাণ্ড্যকে আচমকা চার নম্বরে পাঠানো। কারও কারও মতে, ওটাই সিরিজের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে থাকল।
শাস্ত্রী: আমার ডিসিশন ছিল বলব না, বলব সাজেশন ছিল। হার্দিককে আমার অসম্ভব প্রতিভাবান মনে হয়। লড়াই করতে পারে। ম্যাচউইনার। আমার মনে হয়েছিল, প্রতিপক্ষ যখন এই চালটা একেবারেই আশা করছে না, তখনই ওকে পাঠিয়ে চমকে দেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে আর একটা কথা বলি, ইনদওরে হয়তো হার্দিককে পাঠানো হয়েছিল। পরের দিন অন্য কেউ যেতে পারে। এম এস (ধোনি) হতে পারে, কেদার যাদব হতে পারে, মণীশ পান্ডে হতে পারে।
প্র: ইনদওরে কঠিন সেই পরিস্থিতিতে যখন হার্দিক ব্যাট করতে যাচ্ছে, তখন আপনি কী বলেছিলেন?
শাস্ত্রী: খুব সিম্পল। গো অ্যান্ড প্লে ইওর গেম। অন্য কিছু নিয়ে ভেবো না। যাও, নিজের খেলা খেলো।
প্র: আপনার ক্রিকেটজীবনে যখন ক্যাপ্টেন ছিলেন, এটা বার বার করেছেন। হঠাৎ নীচের দিককার ব্যাটসম্যানকে তুলে এনে উপরের দিকে পাঠিয়েছেন। আর তারা প্রত্যেকে সফলও হতো। এটা কী ভাবনা থেকে করতেন?
শাস্ত্রী: হ্যাঁ, ক্যাপ্টেন থাকার সময় অনেক বার করেছি, ঠিকই। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, ক্রিকেট খেলাটা পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলতে হয়। আর প্রতিপক্ষ বুঝে খেলতে হয়। আমার মনে আছে ঘরোয়া ক্রিকেটে এক বার আমি ব্যাট করছিলাম। ম্যাচটা সম্ভবত উইলস ট্রফির ছিল। বিনোদ কাম্বলির ব্যাট করার কথা ছিল ছয় নম্বরে। কিন্তু আমি ওকে তিন নম্বরে ব্যাট করতে আসতে বলি। আমাদের সেই মুম্বই টিমে তখন সচিন তেন্ডুলকর ছিল। দিলীপ বেঙ্গসরকর ছিল। সঞ্জয় মঞ্জরেকর ছিল। দুর্দান্ত টিম ছিল। তবু বিনোদকে আমি তিনে আসতে বলি আর এসে ও চার-পাঁচটা ছক্কা মেরে দেয়। আর স্মৃতিশক্তি যদি খুব খারাপ না হয়ে গিয়ে থাকে, অনিল কুম্বলের প্রথম বলেই ছক্কা মেরেছিল কাম্বলি।
প্র: আর একটা ম্যাচের কথাও মনে পড়ছে। সেদিন বাংলার রঞ্জি জয়ের পথে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল আপনার এরকম একটা সিদ্ধান্ত। রঞ্জি ফাইনালে দ্বিতীয় ইনিংসে সাইরাজ বাহুতুলেকে আগে পাঠিয়ে দিলেন। বাহুতুলে গিয়ে বাংলার আশা শেষ করে দিয়েছিলেন।
শাস্ত্রী: সাইরাজকে পাঠিয়েছিলাম বিশেষ একটা দায়িত্ব পালন করতে। ও সেটা করে দেখিয়েছিল। ক্যাপ্টেন হিসেবে আমি নিজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিতাম।
প্র: এ সব ক্ষেত্রে আসল ব্যাপার কি ‘ইন্সটিঙ্কট’? সহজাত প্রবণতার উপরেই কি আস্থা রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হয়?
শাস্ত্রী: একদমই তা-ই। সঠিক শব্দটা হচ্ছে ‘ইন্সটিঙ্কট’। ক্যাপ্টেন্সি বা লিডারশিপে ওটা খুব জরুরি। তবে কী জানেন তো, ক্রিকেট খেলাটা সম্পর্কেও একটু-আধটু জ্ঞান থাকতে হবে। আর সবার আগে চাই বুকের পাটা। আরে ভাই, সাহস করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কলিজাটা তো থাকতে হবে। না হলে ‘ইন্সটিঙ্কট’ নিয়ে বসে থেকে কোন উপকার সাধনটা হবে!
(চলবে)