আমার চাপটা এ বার ফেডেরারের মতো

২০১৪-র কাকভোর। মুম্বই থেকে আট কোটির প্রথম আইএসএল ট্রফিটা হাতে তুলে সে দিন তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমিই বস। ড্রেসিংরুমে আমিই শেষ কথা...।’’

Advertisement

রতন চক্রবর্তী ও দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৫ ০৩:৪২
Share:

গাঁধীজির ছবির সামনে এসে থমকে গেলেন হাবাস। বুধবার। ছবি: উৎপল সরকার।

২০১৪-র কাকভোর।

Advertisement

মুম্বই থেকে আট কোটির প্রথম আইএসএল ট্রফিটা হাতে তুলে সে দিন তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমিই বস। ড্রেসিংরুমে আমিই শেষ কথা...।’’

৮ জুলাই, ২০১৫-র দুপুর।

Advertisement

মধ্য কলকাতার ভিক্টোরিয়া হাউসের সভাঘরে একঘর সাংবাদিকের মধ্য থেকে উড়ে এল প্রশ্নটা—আপনার টিমে ভাইচুং ভুটিয়ার ভূমিকা ঠিক কী? রাফা বেনিতেজের একদা সহকারীর ঝটতি জবাব, ‘‘ভাইচুং টিম গঠন নিয়ে টেকনিক্যাল পরামর্শ দেয় আমাকে। কিন্তু টিমে শেষ কথা আমিই... আমি ঠিক করব কে আমার টিমে খেলবে।’’

বিশৃঙ্খল ফিকরুকে অনায়াসে বাদ দিয়েছেন, ফাইনালের গো‌লদাতা রফিককে দলেই নেননি, মার্কি গার্সিয়াকে পাঠিয়ে দিয়েছেন বাউন্ডারির বাইরে, সুশীল সিংহের মতো ‘ফসিল’ হয়ে যাওয়া ফুটবলার টিমে। এদেল বেটে বা শুভাশিস রায়চৌধুরীর মতো দুই ম্যাচ উইনার কিপারেরও জায়গা হয়নি টিমে।

কেন? মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উত্তর এল, ‘‘সেটা তো আমার ব্যাপার। আপনাদের বলতে যাব কেন? গত বারের তুলনায় এ বারের টিম অনেক ব্যালান্সড।’’

রাগী চেহারার মুখাবয়ব নিয়ে এক ঘর সাংবাদিকের বাউন্সার সামলানো কে তিনি? তিনি আটলেটিকো দে কলকাতা কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাস। দু’শো দিনেও যিনি বদলাননি একটুও।

এই সময়ে ঋণে জর্জরিত গ্রিসে সরকার পড়ে যেতে পারে, শার্লি এবদো কাণ্ডের জেরে ফ্রান্সে রক্তধারা বইতে পারে, মহিলাদের বিশ্বকাপ ফুটবলে জাপানকে হারিয়ে হোপ সোলোরা জেতায় মার্কিন মিডিয়া ‘পার্ল হারবারের বদলা’ বলে বিতর্ক তৈরি করতে পারে। এমনকী বদলে যেতে পারে হোসেমি-অর্ণব মণ্ডলদের জার্সির ডিজাইনও। কিন্তু হাবাস রয়েছেন হাবাসেই!

‘আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী’ মার্কা বিনয় তাঁর কষ্মিনকালেও ছিল না। সেই ধারা বজায় রেখেই ‘আনন্দবাজার’-এর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘‘জিকো, রবের্তো কার্লোসের টিম নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমার টিম ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে ভাবার সময় কোথায়!’’

বদল কেবল মন্তব্যে। ‘আমিই সে’ মার্কা রাফ অ্যান্ড টাফ ব্যক্তিত্বে বরং জুড়েছে নতুন মন্তব্য। যা জানান দেয়, এ বার চাপটা বেশি স্প্যানিশ কোচের। নিজে বলছেনও সে কথা। ‘‘গত বার লক্ষ্য ছিল চ্যাম্পিয়ন হওয়া। এ বার ফোকাসটা অন্য ভাবে সেট করতে হচ্ছে। কারণ এ বার খেতাবটাকে ধরে রাখার লড়াই। যেটা করতে হত ফেডেরারকে...আমার চাপটা এ বার ফেডেরারের মতোই।’’

মঙ্গলবার সকালে কলকাতায় আসার পর থেকেই তাই ডুবে গিয়েছেন কাজে। কখনও বৈঠক করেছেন ভাইচুং ভুটিয়ার সঙ্গে। কখনও বা সহকারী কোচ নিয়োগের ইন্টারভিউ। এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে এলেন কাঁটায় কাঁটায় ঠিক একটায়। পরনে সেই ট্রেড মার্ক সাদা শার্ট আর কেউটে-কালো ট্রাউজার্স।

আর সেখানেও টিম মালিক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, হর্ষ নেওটিয়া, সঞ্জীব, গোয়েন্কা, উৎসব পারেখদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ফাঁকেই হাবাস বুঝিয়ে দিলেন ড্রাফটিংয়ের জন্য ভাল রকম হোমওয়ার্ক করেই তিনি পা দিয়েছেন ভারতে। ‘‘ড্রাফটিং থেকে আরও পাঁচ জন ফুটবলার তুলতে মুম্বই যাচ্ছি। এর মধ্যে দু’জন ভারতীয় গোলকিপারকে নেব আমরা।’’

জন্মদিনের সকালটা বাড়িতে ভক্তদের সঙ্গে কাটিয়ে ততক্ষণে সাংবাদিক সম্মেলনে ঢুকে পড়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ও এটিকে-র বাকি তিন মালিক হর্ষ নেওটিয়া, স়ঞ্জীব গোয়েন্কা ও উৎসব পারেখ এ বার হাবাসের হাতে তুলে দিলেন নতুন ডিজাইনের জার্সি। যেখানে বুকের বাঁ দিকের উপর ঝলমল করছে গত বারের জেতা আইএসএল ট্রফির প্রতীক (ভারতে তো বটেই ফুটবল বিশ্বেও অভিনব)। জুড়েছে নীল রঙের কলার। তিন থেকে বেড়ে লাল-সাদা স্ট্রাইপও হয়েছে পাঁচটা। সে দিকে এক বার দৃষ্টি গেল আটলেটিকো চিফ কোচের। মুচকি হাসলেন। তার পর ফের ডুবে গেলেন টিম নিয়ে আলোচনায়।

সেখান থেকেই বেরিয়ে এল এ বারের প্রস্তুতির নীল নকশা। ২৫ অগস্ট থেকে মাদ্রিদে তিন সপ্তাহের আবাসিক শিবির। তার পর কলকাতায় ফিরে আরও দু’সপ্তাহ শিবিরের পর শুরু হবে টিম সাজানোর পালা।

গত বার ১৬ ম্যাচের মধ্যে ন’টা ম্যাচ ড্র করে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন অর্ণব মণ্ডলদের আটলেটিকো দে কলকাতাকে। গোটা টুর্নামেন্ট মাঝমাঠে বল হোল্ড করে তাঁর প্রতি-আক্রমণের স্ট্র্যাটেজি ঝড় তুলেছিল ভারতীয় ফুটবলে। মার্কি ফুটবলার গার্সিয়া ও হোফ্রেকে ফাইনালে প্রথম একাদশের বাইরে রেখেই কিস্তিমাত করে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এ বারও কি তা হলে সেই থিওরিতেই টিম সাজাবেন? ফের দেখা গেল চেনা হাবাসকে। ‘‘আমি আগে টিমটা সাজিয়ে নেই। তার পর ফুটবলারদের দেখে ঠিক করব টিমের স্ট্র্যাটেজি, ছক সব কিছু।’’

এ দিনই টিম ম্যানেজমেন্টের তরফে জানিয়ে দেওয়া হল দিয়েগো সিমিওনেদের আটলেটিকো মাদ্রিদের কো-অর্ডিনেটর আলবার্তো মারেরো এ বার এটিকে-র স্পোর্টস ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব সামলাবেন।

গত বার টুর্নামেন্টে হাবাসের ‘জোকার কার্ড’ ছিলেন ইথিওপিয়ান ফিকরু তেফেরা। স্প্যানিশ কোচ এ বার চোখ রাখতে বলছেন, উইঙ্গার ভালদো, সামিঘ দোউটি এবং হোসে লুইজ এস্পিনোজা ওরফে তিরির দিকে।

কিন্তু আপনার টিমের মার্কি ফুটবলার কে? হুগো আলমেইদা না পস্তিগা? ফের চোয়াল শক্ত আইএসএল চ্যাম্পিয়ন কোচের। স্কুলের কড়া হেডস্যারের মতোই বলছেন, ‘‘ওটা নিয়ে একটা কথাও এখন আপনাদের বলব না। সময় মতো সব জেনে যাবেন।’’

হাবাস যে আছেন হাবাসেই। যিনি মন থেকে আজও বিশ্বাস করেন—শৃঙ্খলা আর লক্ষ্য স্থির থাকলে ভাগ্য দরজাতে কড়া নেড়ে যাবে এ বারও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন