কিংবদন্তি: কলকাতায় লুগানিস। বৃহস্পতিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
তিরিশ বছর আগে অলিম্পিক্স ডাইভিং বোর্ডে ওঠার আগেই তিনি জেনে গিয়েছিলেন ভয়ঙ্কর এইচআইভি তাঁর শরীর আক্রমণ করেছে।
তিরিশ বছর আগে সোল অলিম্পিক্সে ডাইভ দেওয়ার সময় স্প্রিংবোর্ডে আঘাত লেগে বীভৎস ভাবে মাথা ফেটে যায় তাঁর। রক্তাক্ত হয়ে যায় পুলের জল। যেখান থেকে প্রায় মৃত্যুকে হারিয়ে জোড়া সোনা জিতেছিলেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি।
তিরিশ বছর পরে সেই মানুষটাই দু’হাত দূরে বসে যখন স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন, মুখ-চোখে খেলে যাচ্ছিল আবেগের রামধনু। ‘‘সোল অলিম্পিক্সের মাস ছ’য়েক আগে ধরা পড়ে আমি এইচআইভি আক্রান্ত। খবরটা পাওয়ার পরে মনে হয়েছিল, ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে এ বার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করি,’’ বলছিলেন গ্রেগ লুগানিস। অলিম্পিক্স ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ডাইভার, অন্যতম সেরা অলিম্পিয়ান। যাঁর ঝুলিতে রয়েছে চারটি অলিম্পিক্স সোনা। ১৯৮৪ এবং ১৯৮৮ সালে তিন মিটার স্প্রিংবোর্ড এবং ১০ মিটার প্ল্যাটফর্ম ডাইভিংয়ে।
‘টাটা স্টিল কলকাতা ২৫কে ২০১৮’ দৌড়ের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে বৃহস্পতিবারই কলকাতায় এসেছেন লুগানিস। দুপুরে প্রথাগত সাংবাদিক বৈঠকের পরে সন্ধ্যায় মধ্য কলকাতার এক হোটেলে বসে বিশেষ আলাপচারিতায় তুলে আনছিলেন তাঁর জীবনের অন্ধকার দিনগুলোর কথা। ‘‘আমি যখন মৃত্যুর কথা ভাবছিলাম, তখন আমার চিকিৎসক বলে ‘ট্রেনিংটা চালিয়ে যাও। ওটাই তোমার সুস্থ থাকার উপায়।’’ আমারও ডাইভিং ছাড়া আর কিছু ছিল না। সুইমিংপুলটাই হয়ে উঠেছিল বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয়,’’ বলছিলেন ৫৮ বছর বয়সি কিংবদন্তি মার্কিন ডাইভার।
মৃত্যুকে তুচ্ছ করে যিনি ডাইভিং বোর্ডে উঠতে পারেন, তাঁকে শারীরিক চোট কি থামাতে পারে? গোটা বিশ্ব সে দিন চমকে উঠেছিল দৃশ্যটা দেখে। মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। পুলের জল লাল হয়ে গিয়েছে। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্ট্রেচার করে। সেই অবস্থায় মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে ফিরে এসে সোনা। কী ভাবে সম্ভব হল? একটু হেসে লুগানিস বললেন, ‘‘পাঁচটা সেলাই পড়েছিল আমার। কোচ এসে বলেন, তুমি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারো। কেউ কিছু মনে করবে না। আমি কোচকে বলেছিলাম, এত পরিশ্রম, এত যন্ত্রণা সহ্য করে এখানে এসেছি। লড়াই ছাড়ব না। এর পরে আমরা দু’জনে একটা ফাঁকা বারান্দায় গিয়ে হাঁটতে থাকি। কোচ মজা করে বলেন, ‘এই তো কোনও খেলায় কারও কারও ৪০-৪৫টা করে সেলাই পড়ে। তোমার তো মোটে পাঁচটা পড়েছে।’ পরের ডাইভটা যখন নিতে যাই, তখন ওই ঘটনাটা আমি মনের সিন্দুকে তালা চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছি।’’
সুইমিং পুলের বাইরের জীবনটাও লুগানিসের কম আকর্ষণীয় নয়। ডাইভিং থেকে অবসর নেওয়ার পরে নিজেকে সমকামী বলে ঘোষণা করেছেন। কম বয়সে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আবার অভিনয় থেকে লেখা— সবেতেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। ট্র্যাপিজেও পারদর্শী ছিলেন। ‘‘এই তো আমি একটা মিউজিক্যাল লিখছি,’’ বলে ফেললেন লুগানিস। নাম কী সেই নাটকের? আপনি নিজে অভিনয় করবেন? উত্তর এল, ‘‘নামটা হিরো। আমার চরিত্র হলেও আমি নিজে অভিনয় করছি না।’’
অবসর নেওয়ার পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডাইভিং দলের মেন্টর ছিলেন। কাজ করেছেন খুদেদের সঙ্গে। আপনার কোচিং দর্শন কী? কী বার্তা দিতে চান শিক্ষার্থীদের? হ্যারি পটারের ভক্ত লুগানিসের জবাব, ‘‘ভয়কে জয় করতে হবে। আমি হ্যারি পটারের উদাহরণ দিয়ে বলি, যা কিছুকে ভয় পাবে, সেটাকে হাস্যাস্পদ করে তুলবে। দেখবে, ভয় মুছে গিয়েছে।’’
লুগানিস ছাড়া এই মন্ত্র আর কে দিতে পারেন!