উষার অন্ধকারে সোনা না জেতার হতাশা

ওই তো, টানেল থেকে বেরিয়ে আসছে পর পর আট জন। ওদের মধ্যেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমাদের ছিপছিপে কৃষ্ণকলিকে। ট্র্যাকস্যুট খোলার পর দেখা গেল, ওর বুকে-পিঠে বড় হরফে লেখা ২১০। এ বার গা ঘামিয়ে নিতে ওয়ার্ম আপ। স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে প্রথম হার্ডল পর্যন্ত হেঁটে গেল আমাদের ২১০ নম্বর।

Advertisement

চিরঞ্জীব

শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৬ ০৫:০৯
Share:

লস অ্যাঞ্জেলিসের সেই দৌড়।

ওই তো, টানেল থেকে বেরিয়ে আসছে পর পর আট জন। ওদের মধ্যেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমাদের ছিপছিপে কৃষ্ণকলিকে। ট্র্যাকস্যুট খোলার পর দেখা গেল, ওর বুকে-পিঠে বড় হরফে লেখা ২১০। এ বার গা ঘামিয়ে নিতে ওয়ার্ম আপ। স্টার্টিং পয়েন্ট থেকে প্রথম হার্ডল পর্যন্ত হেঁটে গেল আমাদের ২১০ নম্বর।

Advertisement

১৯৮৪-র ৮ অগস্ট। তখনও বিকেল চারটে বাজতে অল্প বাকি। মার্কিন মুলুকে লস অ্যাঞ্জেলিসের কলিসিয়াম স্টেডিয়াম। একটু পরেই, বিকেল চারটে পঁচিশে শুরু হবে মেয়েদের ৪০০ মিটার হার্ডলসের ফাইনাল। দৌড়বে আমাদের উষা। অলিম্পিক্সে অ্যাথলেটিক্সের কোনও ইভেন্টের ফাইনালে প্রথম কোনও ভারতীয় মহিলা। আর সেই শেষ।

সে বার অলিম্পিক্সে নতুন ইভেন্ট মেয়েদের ৪০০ মিটার হার্ডলস। উষার উচ্চতা, অবয়ব, কাঠামো, স্ট্রাইডের কথা মাথায় রেখে কোচ নাম্বিয়ার সিদ্ধান্ত নেন, ওর জন্য ওই ইভেন্ট উপযুক্ত। সঠিক সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয় সেমিফাইনালে প্রথম হয়ে উষা ফাইনালে ওঠে। ‘লস অ্যাঞ্জেলিস টাইমস’-এ উষাকে নিয়ে শিরোনাম হয়। লেখা হয়েছিল, ফাইনালে সোনা জিততে পারেন উষা।

Advertisement

ফাইনালের আগের দিন ইন্ডিয়ান অলিম্পিক্স সংস্থার কর্মকর্তা বিদ্যাচরণ শুক্ল, এআইএফএফের প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি উষাকে গেমস ভিলেজে শুভেচ্ছা জানাতে যান। প্রিয়র সঙ্গে ছিলেন এখনকার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ও। প্রিয় বলেছিলেন, ‘‘আমরা সবাই দল বেঁধে ফাইনাল দেখতে যাব।’’

প্রেস গ্যালারিতে আমরা, ভারতীয় সাংবাদিকেরাও জোট বেঁধে। আমার পাশে কলকাতার আর এক সাংবাদিক শ্যামসুন্দর ঘোষ। আমাদের একটু দূরে, চিত্র সাংবাদিকদের গ্যালারিতে লম্বা টেলি-লেন্স বাগিয়ে তৈরি হচ্ছেন অমিয় তরফদার।

ফাইনালিস্টদের নাম ডাকা হচ্ছে। লাউডস্পিকারে ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে নাম ভেসে উঠছে কলিসিয়ামের জায়ান্ট স্ক্রিনে। পাঁচ নম্বর লেনে উষা। সাংবাদিকদের নিরুত্তাপ, নিরপেক্ষ থাকতে হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে ও সব আদর্শ বাক্য শিকেয় তুলে রেখেছি। লাউডস্পিকারে ‘পিটি উষা ইন্ডিয়া’ শুনতেই গর্বে বুক ফুলে উঠল। অভদ্রতা হচ্ছে জেনেও নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। পিছন থেকে চিৎকার ‘সিট ডাউন, সিট ডাউন’। কে শোনে কার কথা! অন্য ভারতীয় সাংবাদিকেরাও উত্তেজনায় শৃঙ্খলা ভুলেছেন। উষা পদক জিতলে প্রত্যেকের বড় স্টোরি হবে।

উষার ডান দিকে, চার নম্বর লেনে জামাইকার সান্দ্রা ফার্মার। বাঁ দিকে ছয় নম্বরে অস্ট্রেলিয়ার ডেবি ফ্লিনটফ। সকলেই স্টার্টিং ব্লকে বসলেন।

কাঁটায় কাঁটায় ঠিক চারটে পঁচিশে পিস্তলের গর্জন। স্টার্টিং ব্লক থেকে উষা ছিটকে বেরোল, ঠিক যেন গোলা। ফ্লিনটফের সঙ্গেই চকিতে পৌঁছে গেল প্রথম হার্ডলে। কিন্তু পরক্ষণেই ফেরার ডাক। ফ্লিনটফ ফল্স স্টার্ট নিয়েছে।

একটু দমে গেলাম। যে ভাবে উষা স্টার্ট নিয়েছিল, পরের বার পারবে তো? আর সেটাই হল। দ্বিতীয় বার আর অমন বিদ্যুৎ গতিতে স্টার্টিং ব্লক থেকে বেরোতে পারল না উষা। দৌড়ের প্রথম ২০০ মিটার পর্যন্ত উষা অনেক পিছিয়ে। খারাপ লাগছিল। এমন সময় পায়োলি এক্সপ্রেস আচমকা হরিণ গতিতে অন্যদের ধরে ফেলল অষ্টম হার্ডলে। তখন উষার সামনে কেবল মরক্কোর নাওয়াল এল মৌতাওয়াকেল।


এখন উষা।

তবে নবম হার্ডল টপকানোর আগে আমেরিকার জুডি ব্রাউন পিছনে ফেলে দেয় উষাকে। উষাও ছাড়ার পাত্রী নয়। গতি বাড়িয়ে প্রায় পেরিয়ে গিয়েছিল জুডিকে। তবে পারল না। হঠাৎই যেন উষার গতি কিছুটা কমে গেল। এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। সোনা, রুপোর কোনওটাই হচ্ছে না দেখে বসে পড়লাম। তবে ব্রোঞ্জের আশা এখনও আছে।

দৌড়ের শেষটা প্রেস গ্যালারি থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল না। কয়েক মুহূর্ত পরে জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখলাম, তৃতীয় হওয়ার দৌড়ে রোমানিয়ার ক্রিস্টিনা কোজহোকারু আর উষা ফোটো ফিনিশ করেছে। তবে আমাদের মনে হল, উষাই এগিয়ে। আবার উঠে দাঁড়ালাম। চিৎকার করে দু’হাত শূন্যে ছুড়ে দিলাম। চিৎকার করছি, ‘ইন্ডিয়া ইন্ডিয়া’ বলে। একা নই, বাকি ভারতীয় সাংবাদিকেরাও সমস্বরে। লাউডস্পিকারে এক বার ঘোষণাও করা হল, উষা থার্ড। কিন্তু এ কী সর্বনাশ! এ বার জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখাচ্ছে, থার্ড হয়েছে রোমানিয়ার কোজহোকারু। তার সময় ৫৫.৪১ সেকেন্ড, চতুর্থ উষা ৫৫.৪২ সেকেন্ড। ০.১ সেকেন্ডের জন্য পদক হাতছাড়া হল উষার।

৩২ বছর পর আজও মনে হয়, ফ্লিনটফের স্টার্ট ফলস না হলে উষা পদক আনতই, হয়তো সোনাও। কলিসিয়ামে সূর্যাস্ত আর আমাদের পদকের আশা অস্তমিত হওয়ার সেই দুঃখ আজও পীড়া দেয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন