(বাঁদিকে) মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী (ডানদিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম
আর্থিক সমস্যার সমাধান তো দূর অস্ত! সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে মহমেডানের। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সমস্যা না মিটলে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভাবছে ক্লাবের ট্রাস্টি বোর্ড। খুব বেশি অপেক্ষা করতে চাইছে না তারা।
আর্থিক সমস্যার কথা জানাতে গত রবিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিলেন মহমেডান ক্লাবের কর্তারা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তখন উত্তরবঙ্গে সফরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। নিজেদের বক্তব্য জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির লাগোয়া দফতরে মহমেডান কর্তারা একটি চিঠি দিয়ে আসেন।
বন্যা পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে মুখ্যমন্ত্রী এত দিন উত্তরবঙ্গে ছিলেন। বৃহস্পতিবার তিনি ফিরছেন। তাঁর অপেক্ষায় রয়েছেন মহমেডান কর্তারা। তাঁদের আশা, ফেরার পর মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের ডাকবেন। তখন যদি সমস্যার সমাধান হয়। ইতিমধ্যে কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গেও দেখা করার চেষ্টা করছেন কর্তারা। নইলে ‘বিকল্প’ ভাবনাও ভেবে রেখেছে ক্লাব। কোনও ভাবেই আর্থিক সমস্যার সমাধান না হলে ক্লাবের ট্রাস্টি বোর্ড সরাসরি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সাহায্য চাইবে বলে ঠিক করে ফেলেছে।
তবে মোদী সরকারের দ্বারস্থ হওয়ার বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেকেই মনে করছেন, এই ‘বিকল্প পরিকল্পনা’ আসলে একটি ‘রাজনৈতিক চাপ’। বিধানসভা ভোট আর কয়েক মাস পরেই। ১৩৪ বছরের প্রাচীন তথা দেশের একমাত্র সংখ্যালঘু ক্লাব মহমেডান যদি এই আবহে দিদিকে ছেড়ে মোদীর দ্বারস্থ হয়, তা হলে সংখ্যালঘু মনস্তত্ত্বে তার ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ পড়বে বলে কেউ মনে করলে তা একেবারে অমূলক বলা যাবে না। নিজেদের ‘সংখ্যালঘু ক্লাব’ বলে পরিচয় দেওয়াও তারই অংশ।
সেই সূত্রেই ময়দানের একাংশ এই পরিকল্পনাকে ‘রাজনৈতিক চাপ’ বলে মনে করছেন। ময়দানের ফুটবল এবং রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগসম্পন্ন এক কর্তার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মহমেডানকে সাহায্য করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি তো এখনও ‘না’ বলেননি। তার মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের মুখাপেক্ষী হওয়ার পরিকল্পনা ভাসিয়ে দেওয়া হলে সেটা তো প্রকারান্তরে রাজনৈতিক চাপ তৈরির চেষ্টা বলেই মনে হবে। যদি ক্লাবের কর্তারা বৈঠকে বসে তেমন কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা পাশ করিয়ে নিতেন, তা হলে বলা যেত, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। তা তো নয়ই, বরং তাঁরা প্রকাশ্যে এমনকিছু বলছেনও না। বিভিন্ন রকমের বিকল্প ভাবনা তো থাকতেই পারে। কিন্তু সেই ভাবনা সিদ্ধান্তে পরিণত হওয়া ঠোঁটের সঙ্গে কাপের ফারাকের মতোই।’’
মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে অর্থাভাবের কারণে এখনও দল গঠন করতে না পারার কথা জানিয়েছিল মহমেডান। ক্লাব সভাপতি আমিরুদ্দিন ববি, সহ-সভাপতি মহম্মদ কামারুদ্দিন এবং সচিব ইশতিয়াক আহমেদের সই করা চিঠিতে লেখা হয়, সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশন শীঘ্রই ঘরোয়া ফুটবলের সূচি ঘোষণা করবে। মহমেডানকে আইএসএলে খেলার অনুমতি দিচ্ছে না ফেডারেশন। মহমেডানের লক্ষ লক্ষ সমর্থক বর্তমান পরিস্থিতিতে চিন্তিত। এই পরিস্থিতিতেই মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের আবেদন করা হয়েছে চিঠিতে। ওই চিঠিতে শিল্পোদ্যোগী সত্যম রায়চৌধুরীর কথাও লেখা হয়েছে। বলা হয়, পাঁচ মাস ধরে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে লাভ হয়নি। ক্লাব সূত্রের দাবি, সত্যমকেই মহমেডানের আর্থিক সমস্যা মেটানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে ক্লাব-কর্তাদের একাধিক বৈঠকও হয়েছে। কিন্তু টাকার অঙ্ক নিয়ে দু’পক্ষের বনিবনা হয়নি। সত্যমের সঙ্গে আনন্দবাজার ডট কমের তরফে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত তাঁর মোবাইলে পাঠানো বার্তার কোনও জবাব আসেনি। জবাব এলে তা এই প্রতিবেদনে সংযুক্ত করা হবে।
দীর্ঘ দিন ধরে মহমেডান ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত এক কর্তা বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আমরা ভারতের একমাত্র সংখ্যালঘুদের ক্লাব। ভারতীয় ফুটবলে মহমেডান ক্লাবের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। এই ক্লাবের বিশাল ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আছে। বয়সে আমরা মোহনবাগানের থেকে দু’বছরের ছোট, ইস্টবেঙ্গলের থেকে বড়। অথচ, সব কিছুই ওই দু’টি ক্লাবের কথা ভেবে করা হচ্ছে। আমাদের কথা কেউ ভাবছে না।’’
বেশি দিন আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয় জানিয়ে ওই কর্তা বলেছেন, ‘‘আমরা গত বছর থেকে আইএসএল খেলতে শুরু করি। সমস্যা শুরু হয় তখন থেকেই। দুই বিনিয়োগকারী সংস্থার জন্যই সমস্যা। প্রচুর আলোচনা করেও কোনও লাভ হয়নি। আমরা তো নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে ২০ বছর ধরে দল চালিয়েছি! আই লিগ খেলেছি। সমর্থকেরাও খুশি হয়েছেন। কিন্তু নিজেদের টাকা খরচ করে তো আইএসএলে খেলা সম্ভব নয়।’’
অসমর্থিত সূত্রের খবর, সত্যমের পরে মহমেডানের আর্থিক সমস্যা মেটাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ও। কলকাতার একটি হোটেলে মহমেডান কর্তাদের সঙ্গে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয় বার সিএবি-র সভাপতি হওয়া সৌরভের বৈঠক হয়েছিল। তিনি একটি সংস্থাকে বিনিয়োগে রাজিও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু সেই চুক্তিও শেষ পর্যন্ত হয়নি। অতঃপর অথৈ জলে থাকা মহমেডানের পুরো কার্যকরী কমিটিই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। গত মঙ্গলবার ট্রাস্টি বোর্ডের সঙ্গে বৈঠকে সকলে একযোগে ইস্তফাও দিয়ে দেন। কিন্তু সেগুলি গৃহীত হয়নি। সূত্রের খবর, ট্রাস্টি বোর্ড ক্লাব কর্তাদের আরও চার-পাঁচ দিন অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে। তাদের আশা, মুখ্যমন্ত্রী কলকাতায় ফেরার পর তাঁদের সময় দেবেন এবং সমস্যার সমাধান করবেন। শেষমেশ সমস্যা না মিটলে মোদীর দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভেবে রেখেছে ‘সংখ্যালঘু’দের ক্লাব মহমেডান।