Surajit Sengupta

Surajit Sengupta death: দক্ষিণ কোরিয়া দলের সঙ্গে গোলটা অমর হয়ে থাকবে

সে বার আমরা স্ট্যাফোর্ড কাপ ও নাগজি ট্রফিতে মরসুমের শুরুতেই হেরেছিলাম। কলকাতা লিগেও মোহনবাগানের সঙ্গে ড্র করায় লিগ পাইনি। এ রকম কোণঠাসা অবস্থায় আইএফএ শিল্ড আনতেই হবে—এ রকম চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের। 

Advertisement

প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১০:০৫
Share:

স্মরণীয়: দিল্লিতে ডুরান্ড কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে প্রশান্ত, সুরজিৎ ও উলগানাথন। ফাইল চিত্র

খেলোয়াড় থাকার সময় ঘটনাটা শুনেছিলাম আমাদের কালীঘাট এলাকার এক পরিচিত ব্যক্তির কাছে। চুরাশি সালে কালীপুজোর আগে ঘটনা। যিনি আমাকে ঘটনাটা বলেছিলেন, তাঁর পরিচিত একজন দিল্লিতে থাকতেন তখন। সেই ব্যক্তি, তাঁর মা ও দিদি হঠাৎ দিল্লি থেকে কলকাতা যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন পুজোর সময়। তাঁদের পদবি ছিল সেনগুপ্ত। কিন্তু ট্রেনের টিকিট পাওয়ায় সমস্যা হচ্ছিল। বুকিং ক্লার্ক ছিলেন এক শিখ ব্যক্তি। তিনি প্রথমেই তারিখ দেখে নাকি ওই সেনগুপ্তবাবুকে বলে দেন, টিকিট নেই। কিন্তু পদবী সেনগুপ্ত জানার পরে প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনি সুরজিৎ সেনগুপ্তকে চেনেন?’’

Advertisement

দিল্লির সেই বাঙালি ভদ্রলোক এ বার বললেন ‘‘ফুটবলার?’’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কাউন্টারে বসা সেই ক্লার্ক হেসে বললেন ‘‘দাদা, ঠিক ধরেছেন। ডুরান্ড কাপে আমরা ওর খেলা দেখতেই ছুটে যেতাম। ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা।’’ এর পরেই টিকিট কনফার্মড করে দিয়ে বলেন ‘‘তার মানে আপনি ওঁকে চেনেন। এই নিন আপনার টিকিট কনফার্মড করে দিয়েছি। চিন্তা করবেন না। সুরজিতকে গিয়ে আমার শ্রদ্ধা জানাবেন।’’

ঘটনাটা কতটা সত্যি বা গল্প, তা আমি কোনওদিন পরিচিত সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিনি। ময়দানের অনেককেই এই ঘটনাটা জানিয়ে বলেছি, যদি এটা সত্যি হয়, তা হলে গর্বে বুক ফুলে ওঠার মতোই ঘটনা। আর যদি এটা গল্পও হয়, তা হলেও বাঙালির ফুটবল ও ফুটবলারকে নিয়ে গর্ব হবে।

Advertisement

সুরজিৎ সেনগুপ্তের সেরা সময়ে তাঁর সঙ্গে আমি এক সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলে খেলেছি। চোখের সামনে তাঁকে ভারতীয় ফুটবলে দু’টি বিস্ময় গোল করতে দেখেছি। আর মাঠে অনুশীলনের সময় অহরহ মাঠের কর্নার কিংবা তার আশপাশের দুরূহ কোণ থেকে গোল করার মহড়া দিতে দেখেছি।

ভারতীয় ফুটবল ও সুরজিৎ সেনগুপ্তকে নিয়ে আলোচনা উঠলেই তাঁর শূন্য ডিগ্রি কোণ থেকে করা দুই গোলের কথা উঠবে। প্রথমটি ১৯৭৮ সালে। সুরজিতদাই সে বার ইস্টবেঙ্গলের অধিনায়ক। কলকাতা লিগে ইস্টবেঙ্গল বনাম কুমোরটুলি ম্যাচে একেবারে শেষ মিনিটে কর্নার পেল ইস্টবেঙ্গল। নেবেন সুরজিতদা। বাতাসের গতি অনুকূলে না থাকলেও তাঁর চমৎকার রামধনুর মতো বাঁক খাওয়ানো শট কুমোরটুলির খেলোয়াড়দের বোকা বানিয়ে পোস্টে লেগে সোজা চলে গেল জালে!

এক বছর পরে সেই সুরজিদাই প্রায় একই রকম গোল দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দলের বিরুদ্ধে করেছিলেন। সেটা ১৯৭৯ সাল। আর আমিই ছিলাম ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক। আমার নেতৃত্বে ওই গোলটির জন্য আজও আমার গর্ব হয়।

সে বার আমরা স্ট্যাফোর্ড কাপ ও নাগজি ট্রফিতে মরসুমের শুরুতেই হেরেছিলাম। কলকাতা লিগেও মোহনবাগানের সঙ্গে ড্র করায় লিগ পাইনি। এ রকম কোণঠাসা অবস্থায় আইএফএ শিল্ড আনতেই হবে—এ রকম চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের। কিন্তু শিল্ড সেমিফাইনালে আমাদের সামনে পড়ে গেল দক্ষিণ কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দলটি। আর তাদের বিরুদ্ধেই ওই রত্নখচিত
গোল সুরজিতদার।

আমরা শুরুতেই ০-১ পিছিয়ে গিয়েছিলাম। এই অবস্থায় সুরজিতদার সমতা ফেরানোর গোলটা ছিল ঐশ্বরিক! প্রথমার্ধের শেষ দিকে ডান প্রান্ত দিয়ে এগোচ্ছিলেন সুরজিতদা। বলটা বাড়িয়েছিলাম আমি। ওঁর একটা বড় গুণ ছিল, যে বল বাড়ালে তা গতি বাড়িয়ে ঠিক ধরে নেবেন। বল ছাড়া ও বল-সহ দুর্দান্ত ছিল ওঁর গতি।
সঙ্গে ইনসাইড ডজ করবে দেখিয়ে আউটসাইড ডজ করতেন। যাই হোক, আগুয়ান সুরজিতদাকে দেখে কোরিয়ার দুই ডিফেন্ডার এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু সুরজিতদা সেই ইনসাইড ডজ করবে দেখিয়ে আউট সাইড ডজ করেন। এতেই ছিটকে যান ওই দুই কোরীয় ফুটবলার। প্রায় ৩০ গজ দূর থেকে এক পলকেই দেখে নিয়েছিলেন গোল ছেড়ে অনেকটাই এগিয়ে এসেছে কোরিয়ার দলটির গোলরক্ষক। সবাইকে চমকে দিয়ে কর্নারের লাগোয়া শূন্য ডিগ্রি কোণ থেকে নেওয়া সুরজিতের বাঁক খাওয়ানো শট
জড়িয়ে যায় জালে।

বিপক্ষ গোলকিপারও ভেবেছিলেন সুরজিতদা ক্রস রাখবেন। আর ৩০ গজ দূর থেকেই সুরজিতদা সেটা বুঝে যান। তিনি ডান পায়ের ইনস্টেপ ও আউটসাইডের মিশ্রণে বলে এমন চাঁটা লাগালেন যে, কর্নারের কাছ থেকে বলটা প্রথমে হাওয়ায় কিছুটা সোজা গিয়েই গোঁত্তা খেয়ে হাওয়ায় দিক পরিবর্তন করে গোলকিপারের নাগাল এড়িয়ে সোজা গোলে ঢুকে যায়। মাথায় রাখতে হবে সে সময়ে বুট ও বল আজকের মতো এতটা অত্যাধুনিক ছিল না। এখনকার মতো বল হাওয়ায় বেশি বাঁক খেত না। পুরোটাই পায়ের কেরামতি। আমরাও ওই গোলে সমতা ফিরিয়ে উজ্জীবিত হয়ে টাইব্রেকারে ম্যাচটা জিতে নিই। আজও চোখ বুজলে ওই গোলটা দেখতে পাই। ভারতীয় ফুটবলে সুরজিতদার ওই গোলটা অমর হয়ে থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন