The Rise of Lamine Yamal

বার্সার বিস্ময় ইয়ামালই ভবিষ্যতের মারাদোনা-মেসি, স্প্যানিশ ফুটবলারই এখন ইউরোপের সেরা

ফুটবলবিশ্বে এই মুহূর্তে বিস্ময় ফুটবলার বলা হয় তাঁকে। তাঁর পায়ের জাদুতে মোহিত গোটা দুনিয়া। সমর্থক থেকে শত্রুরাও কুর্নিশ করেন। সেই লেমিন ইয়ামালই কি এখন ইউরোপের সেরা ফুটবলার?

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০২৫ ১২:৩৭
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

“লেমিন হল এমন এক প্রতিভা যা ৫০ বছরে এক বার আসে,” বার্সেলোনার বিরুদ্ধে ৩-৩ ড্র করার পর বলেছিলেন ইন্টার মিলানের কোচ সিমোনে ইনজাঘি।

Advertisement

“ফুটবলে একটা জিনিস আমাকে বার বার অবাক করে। আমরা সব সময় ভাবি রোনাল্ডো, মেসি, (রুড) গুলিট, (দিয়েগো) মারাদোনা, এদের চেয়ে ভাল ফুটবলার আর হতেই পারে না। ঠিক তখনই ইয়ামালের মতো ফুটবলারদের আবির্ভাব হয়,” বলেছিলেন ফ্রান্সের প্রাক্তন ফুটবলার এবং অধুনা ধারাভাষ্যকার থিয়েরি অঁরি।

ইন্টার মিলানের বিরুদ্ধে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালের প্রথম পর্বে তাঁর পারফরম্যান্সের পর গোটা বিশ্বে তিনি বন্দিত। তার একটা কারণ যদি বয়স হয়, দ্বিতীয়টা শৈল্পিক ফুটবল। ইন্টারের বিরুদ্ধে বার্সেলোনা ড্র করে মাঠ ছেড়েছে ঠিকই, কিন্তু ইয়ামালের বিস্ময়-ফুটবল নজর এড়ায়নি কারওরই। যে কারণে বলা হচ্ছে, তিনিই এখন বিশ্বের সেরা ফুটবলার। কেউ বলছেন তিনিই ভবিষ্যতের মারাদোনা, কারও মতে তিনিই মেসি। অনেকেই তাঁকে ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার দেওয়ার দাবি তুলেছেন।

Advertisement

ইয়ামালের প্রতিভা নিয়ে আর কারও কোনও সন্দেহ নেই। এখনই যদি তিনি খেলা ছেড়ে দেন, তা হলে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ ফুটবলার যা অর্জন করতে পারেননি, সেটা অর্জন করেই খেলা ছাড়বেন। আর দু’মাস পরে হয়তো লা লিগা, স্প্যানিশ কাপ এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ত্রিমুকুটও জিতবেন।

স্বাভাবিক ভাবেই বার্সেলোনার আর এক নক্ষত্র লিয়োনেল মেসির সঙ্গে তাঁর তুলনা করছে এই প্রজন্ম। তার আগের প্রজন্মের চোখে তিনি মারাদোনা। যদিও ইয়ামাল নিজে বলেছেন, “এ সব তুলনার কোনও অর্থ নেই।” সে যা-ই বলুন, মারাদোনা-মেসির সঙ্গে তুলনা অন্তত এখনই তিনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না।

গত দু’বছরে যে ভাবে ইয়ামালের উত্থান হয়েছে তা অবিশ্বাস্য। প্রাক্তন কোচ জ়াভির অধীনে বার্সেলোনার প্রথম দলে সুযোগ পেয়েছিলেন ইয়ামাল। সেই সময় অর্থকষ্টে ভুগছিল স্পেনীয় ক্লাব। গোটা বিশ্বের কাছে হাসির উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা। অর্থের টানাটানি থাকায় বেশি দাম দিয়ে ফুটবলারও কেনা যাচ্ছিল না। সেই সময়ে জ়াভি যে কতটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সেটা আজ বোঝা যাচ্ছে।

ফুটবলার সই করানো, প্রথম একাদশ নির্বাচন, ট্রফি জেতার চাপ— এ সব নিয়ে চিন্তার মাঝেই বার্সেলোনা পেয়ে গিয়েছিল এক অসাধারণ প্রতিভা। তার জন্য একটুও অর্থ খরচ করতে হয়নি তাদের। কারণ ইয়ামাল বড় হয়েছেন বার্সারই অ্যাকাডেমি লা মাসিয়ায়, ঠিক মেসির মতোই। এই মুহূর্তে বার্সেলোনায় যাঁরা খেলছেন, তাঁদের বেশির ভাগের সঙ্গে লা মাসিয়ায় খেলেছেন ইয়ামাল। যেমন পাউ কুবারসি, গাভি, ফারমিন লোপেজ় এবং আলেজান্দ্রো বালদে। ঠিক যে ভাবে মেসির দলে ছিলেন জ়‌াভি, আন্দ্রে ইনিয়েস্তা, সের্জিয়ো বুস্কেৎসরা।

আধুনিক বিশ্বে ইয়ামালের উত্থানের খবর নজর এড়ায়নি কারও। ১৫ বছর বয়সেই তাঁকে সই করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল প্যারিস সঁ জরমঁ। ইয়ামালকে বার্সেলোনায় রেখে দেওয়ার নেপথ্যে আসল নায়ক জ়‌াভিই।

স্পেনের এক সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জ়াভি ইয়ামালকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, বার্সেলোনার সঙ্গে প্রথম পেশাদার চুক্তিতে সই করলে তিনি প্রথম একাদশে নিয়মিত খেলার সুযোগ করে দেবেন।

কথা রেখেছিলেন জ়াভি। ২০২৩-এর এপ্রিলে, ১৫ বছর, ন’মাস এবং ১৬ দিন বয়সে ইয়ামালের অভিষেক হয় নীল-লাল জার্সি গায়ে। ক্লাবের সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে অভিষেকের নজির গড়েন।

কথা রেখেছিলেন ইয়ামালও। ক্লাবের সঙ্গে চুক্তি করেন, যেখানে ‘রিলিজ় ক্লজ়’ (চুক্তি ভাঙিয়ে কোনও ফুটবলারকে নিতে গেলে যে অর্থ দিতে হয় সংশ্লিষ্ট ক্লাবকে) রাখা হয় ১০০ কোটি ইউরো (এখন ৯৬০০ কোটি টাকা)।

গত মার্চে বার্সেলোনার সভাপতি জোয়ান লাপোর্তা বলেছিলেন, “ইয়ামালের মতো খেলোয়াড়ের জন্য প্রচুর টাকার প্রস্তাব পাচ্ছি আমরা। অবশ্যই সব ক’টা ফিরিয়ে দিয়েছি। লেমিনের উপর আমাদের বিশ্বাস রয়েছে। আমরা ওকে বিক্রি করতে চাই না।”

বয়স ভুলে যান, গত দুটো বছর ইয়ামালের যেমন গিয়েছে, তা অনেক খেলোয়াড় সারা জীবনেও অর্জন করতে পারেন না। ২০২৪ সালে স্পেনে গুগ্‌লে সবচেয়ে বেশি বার ‘সার্চ’ করা হয়েছে তাঁর নাম। ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় স্থানে।

রিয়াল বেটিসের বিরুদ্ধে অভিষেকে মাত্র সাত মিনিট খেলেছিলেন ইয়ামাল। লিগ খেতাব জিতেছিল বার্সেলোনা। পরের মরসুমে তিনি বিশ্বের নজর তো কেড়েইছিলেন, পিছু পিছু এসেছিল বিপদও, যা সব খ্যাতনামীদের ক্ষেত্রেই কোনও না কোনও সময়ে এসে থাকে।

২০০৭ সালে মৌনির নাসরাউই এবং শিলা ইবানার সন্তান হিসাবে জন্ম হয় ইয়ামালের। বেড়ে উঠেছেন স্পেনের শহর মাতারোতে। গত বছর ইউরো কাপ চলাকালীন বিখ্যাত হয়েছিল ইয়ামালের বিখ্যাত ‘৩০৪’ উচ্ছ্বাস, যা ছিল মাতারোর প্রতি তাঁর কুর্নিশ। মরক্কো থেকে স্পেনে আসা নাসরাউই বরাবর ছেলের পাশে থেকেছেন।

বাবা নাসরাউইয়ের সঙ্গে ইয়ামাল। ছবি: সমাজমাধ্যম।

তাল কাটে স্পেন ইউরো জেতার পর ইয়ামালকে প্রতিযোগিতার সেরা ফুটবলার ঘোষণা করা হয়েছিল। তার এক মাস পরেই একটি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় কয়েক জনের হাতে ছুরিকাহত হয়েছিলেন নাসরাউই। হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি ছিল, কুকুর নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কয়েক জনের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে হাতাহাতি এবং শেষে নাসরাউইকে একাধিক বার ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।

৩৫ বছরের নাসরাউইকে বেশ কয়েক ঘণ্টা আশঙ্কাজনক অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ)। কাতালান পুলিশ ঘটনার পরেই চার জনকে আটক করে। তবে থামেননি নাসরাউই। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে আবার ছেলের জন্য মুখ খোলেন। আসলে তাঁর নিজেরও ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সফল করতে পারেননি। বিভিন্ন ছোটখাটো কাজ করে দিন গুজরান করতেন। ছেলের বেলায় কোনও রকম আপস করতে রাজি ছিলেন না।

ইয়ামালের ব্যক্তিগত জীবনটাও তখন ভাল যাচ্ছিল না। সদ্য সদ্য বিচ্ছেদ হয়েছিল বান্ধবী আলেক্স পাডিলার সঙ্গে। ইউরো চলার সময় ইয়ামালের সমর্থনে অনেক ম্যাচেই গ্যালারিতে হাজির ছিলেন পাডিলা। বসতেনও ইয়ামালের পরিবারের সঙ্গে। ট্রফি জয়ের পর তাঁদের ছবি ভাইরাল হয়। ইউরো শেষের পর বান্ধবীর সঙ্গে ছুটি কাটাতেও গিয়েছিলেন ইয়ামাল। সেই পাডিলাকেই কিছু দিন পরে দেখা যায় অন্য একজন ছেলের সঙ্গে।

প্রাক্তন বান্ধবী পাডিলার (বাঁ দিকে) সঙ্গে ইয়ামাল। ছবি: সমাজমাধ্যম।

তবে এর কোনও আঁচ ফুটবল মাঠে পড়তে দেননি ইয়ামাল। বরং ক্লাবে ফিরে এমন খেলতে শুরু করেন যা ঘুম কেড়ে নেয় প্রতিপক্ষের। চলতি মরসুমের পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, ২ মে পর্যন্ত ৪৯টি ম্যাচে ইয়ামাল ১৫টি গোল এবং ২৪টি অ্যাসিস্ট করেছেন।

তার থেকেও আশ্চর্য হল, বড় ম্যাচ এলেই ইয়ামালকে দেখা যায় জ্বলে উঠতে, যা বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই হয় না। ইন্টার ম্যাচের পর কোচ হান্সি ফ্লিক বলেছিলেন, “বড় ম্যাচে আমরা আসল ইয়ামালকে দেখতে পাই। ও চাপে পড়লে আরও ভাল খেলে।” ইয়ামালকে ‘অসাধারণ প্রতিভা’ উল্লেখ করে ফ্লিক আরও বলেছিলেন, “ইনজাঘির কথা উল্লেখ করে যদি মেনেও নিই ইয়ামালের মতো প্রতিভা ৫০ বছরে এক বার আসে, আমি আরও খুশি এটা ভেবে যে ও বার্সেলোনার হয়ে খেলে।”

স্বাভাবিক কারণেই মেসির সঙ্গে ইয়ামালের তুলনা হচ্ছে। তাঁর বাবা নাসরাউই নিজেই বলেছেন, মেসির থেকেও বড় ফুটবলার হতে পারেন ইয়ামাল। ইউরো কাপের সময় খুদে ইয়ামালকে মেসির কোলে ধরে থাকার ছবি ভাইরাল হয়েছে। তবে মেসি যখন নিজের সোনালি সময় কাটিয়েছেন, তার থেকে এখনকার ফুটবল অনেকটাই বদলে গিয়েছে।

মেসির কোলে খুদে ইয়ামাল। ছবি: সমাজমাধ্যম।

তবে সমসাময়িক যাঁরা খেলেন, তাঁদের থেকেও কি ইয়ামাল ভাল?

সবচেয়ে কাছাকাছি তুলনা আসতে পারে যাঁর সঙ্গে, তিনি ইয়ামালের চিরশত্রু ক্লাবে খেলেন। কিলিয়ান এমবাপে। ইয়ামালের থেকে খুব বেশি বড় নন। রিয়াল মাদ্রিদে গত মরসুমে যোগ দিয়ে খুব যে ভাল খেলেছেন, এমনটা বলা যাবে না। তবে ৩০-এর বেশি গোল রয়েছে। এটাও ভুললে চলবে না, এমবাপে দুটো বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছেন। পকেটে একটা বিশ্বকাপ রয়েছে, যেটা জিতেছিলেন ১৮ বছর বয়সে (পেলের মতোই)। বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে দ্বিতীয় ফুটবলার হিসাবে (১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ডের জিয়োফ হার্স্টের পর) হ্যাটট্রিকের নজির রয়েছে।

ইয়ামালের সঙ্গে একই দেশের জার্সি গায়ে খেলেন, সেই রদ্রিকে অনেকে বাদ দিতে পারছেন না। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির একাধিক ইপিএল ট্রফি হোক বা স্পেনের ইউরো কাপ, দলের চালিকাশক্তি হিসাবে খেলেছেন রদ্রি। তিনি চোট পাওয়ায় ম্যাঞ্চেস্টার সিটির পরিকল্পনাই ভেস্তে গিয়েছে। একজন ফুটবলার কতটা গুরুত্বপূর্ণ হলে তাঁর বিকল্প খুঁজে পেতে এত সমস্যা হয়!

খুব একটা দূরে রাখা যাবে না ভিনিসিয়াসকেও। হতে পারে তিনি এই মরসুমে ভাল খেলেননি। কিন্তু ভিনিসিয়াসের খেলার মধ্যে অনেকেই সেই পুরনো ব্রাজিলের ছাপ দেখতে পান— সেই পায়ের কাজ, ড্রিবল করে ভেতরে ঢোকা, দূরপাল্লার শট, এক ভাঁজে প্রতিপক্ষকে মাটি ধরিয়ে দেওয়া। ক্লাবের হয়ে অনেক কিছু জিতেছেন ভিনিসিয়াস। কিন্তু দেশের হয়ে এখনও ট্রফি নেই।

ভুললে চলবে না মহম্মদ সালাহকেও। ইয়ামালের দ্বিগুণ বয়সী ফুটবলার গত কয়েক বছরে একাই ইপিএল মাতিয়ে দিয়েছেন। লিভারপুলের সাম্প্রতিক সাফল্যের পিছনে সবার আগে সালাহ ছাড়া আর কারওর নাম করা যাবে না।

ইয়ামাল ইউরোপ কেন, বিশ্বের সেরা ফুটবলার কি না, তা বিচার করবে সময়। তবে যত দিন তিনি দৃষ্টিনন্দন ফুটবল উপহার দিচ্ছেন, তত দিন ফুটবলপ্রেমীদের আনন্দের কোনও কমতি হবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement