উচ্চতা কম। রোগা পাতলা। একটু এলোমেলো চুল। দেখলে মনে হবে পাশের বাড়ির আর পাঁচটা ছেলের একটা।
কিন্তু একে ভুলেও হাল্কা ভাবে নেবেন না। এ রকম ছোটখাটো চেহারার প্লেয়ারই তো এ বার ইউরোয় ডিফেন্ডারদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। যার বিরুদ্ধে ম্যানুয়েল ন্যয়ারের মতো হাট্টাকাট্টা গোলকিপারও কোনও জবাব খুঁজে পাননি। হ্যা, আঁতোয়া গ্রিজম্যানের কথাই বলছি।
ইউরো শুরু হওয়ার আগে কেউ ধর্তব্যেই রাখেনি গ্রিজম্যানকে। আসলে স্প্যানিশ ফুটবলে রিয়াল মাদ্রিদ বা বার্সেলোনা নিয়ে যা উন্মাদনা আছে, আটলেটিকো মাদ্রিদের তো সে রকম জনপ্রিয়তা নেই। তাই যখন এ রকম দলের ফুটবলারের উপর ফ্রান্সের ফরোয়ার্ড লাইন নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব এসে পড়ে, স্বভাবতই সবাই চমকে যায়। কিন্তু ছয় ম্যাচ পরে আর কারও কিছু বলার নেই। যে টুর্নামেন্টে রোনাল্ডো, বেল, ইব্রাহিমোভিচের মতো ফুটবলাররা খেলেছেন, সেখানে এখন ছয় গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্রিজম্যান। এটা আলাদা করে বলতে হবে না, ফ্রান্সের ফাইনাল পৌঁছনোর পিছনে আসল কারিগর কে।
গ্রিজম্যানের সবচেয়ে বড় সম্পদ ওর বাঁ পা। আমরা দেখে থাকি, বাঁ পায়ের ফুটবলাররা সাধারণত একটু বেশি স্কিলফুল হয়। রোনাল্ডোর চেয়ে সেটা আর বেশি কে জানবে। শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষায় তো ওঁকে মেসির বাঁ পায়ের বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হচ্ছে। গ্রিজম্যানের বাঁ পা থেকে যেমন রকেট শট বেরোয়, সে রকম ড্রিবলও। দু’তিনজনকে বলে বলে কাটাতে পারে। স্ট্রাইকারের সবচেয়ে বড় গুণ স্কোরিং জোনে থাকা। সারা মাঠ জুড়ে তুমি খেললে, কিন্তু গোল না পেলে কেউ মনে রাখবে না। গ্রিজম্যানের সেই খিদেটা আছে। জার্মানির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় গোলটা তো প্রমাণ করল ও কতটা সুযোগসন্ধানী। ন্যয়ারের একটা খারাপ ফিস্ট আর গ্রিজম্যান আরাম করে বলটা ট্যাপ করে দিল।
ফাইনালে গ্রিজম্যানের উল্টো দিকের সাত নম্বরও ভয়ঙ্কর। শুরুর দিকে যে রোনাল্ডোকে দেখে মনে হয়েছিল চোট সমস্যায় ভুগছেন, এখন তিনি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছেন। সেমিফাইনালে শূন্যে উঠে স্পটজাম্পে হেড এখনও চোখে লেগে আছে। তবে রোনাল্ডোর এই অবিশ্বাস্য গোলের পিছনে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম। যা দু’বছর আগে নিজের চোখের সামনে দেখেছিলাম।
২০১৪ বিশ্বকাপে পর্তুগালের ম্যাচ দেখার সৌভাগ্য না হলেও কাম্পিনাসে ওঁদের ট্রেনিং দেখতে গিয়েছিলাম। পর্তুগালের ট্রেনিং, মানেই নজরটা সেই রোনাল্ডোর উপরই ছিল। গোটা সেশনে দেখলাম একের পর এক শট নিচ্ছেন। ওয়ান টাচে পাওয়ার দিয়ে সমস্ত শট বুলেট গতিতে মারছেন। হেডিং প্র্যাকটিসের জন্য আবার বারবার স্পটজাম্প করছিলেন। একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে বারবার লাফাচ্ছেন। বুঝতে পারছিলাম, রোনাল্ডো কতটা পারফেকশনিস্ট, আর সেটা হয়ে উঠতে কতটা পরিশ্রম লাগে।
রোনাল্ডোর শারীরিক গঠনের ধারেকাছেও নেই গ্রিজম্যান। কিন্তু এত ছোট চেহারা হওয়ায় গতিকেই তো হাতিয়ার করেছে গ্রিজম্যান। ডিফেন্ডারদের টপকে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আছে ওর। আইসল্যান্ড ম্যাচটার কথা ভেবে দেখুন। দৌড়ে গিয়ে ও রকম দারুণ গোল দুর্দান্ত গতি ছাড়া হয় না। সঙ্গে আবার প্রতিআক্রমণে এক-দু’পাসে মুভ শেষ করে দেয় গ্রিজম্যান। গোলের সামনে মিলি সেকেন্ডের একটা ভুল সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্ত নিতে একটু ইতস্তত করা, একটা মুভকে শেষ করে দিতে পারে। কিন্তু গ্রিজম্যানের কৃতিত্বটা এখানেই। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে ও। আর তাই অধিকাংশ মুভ সফল ভাবে শেষও করে।
ফিনিশ যদি গ্রিজম্যানের একটা বড় অস্ত্র হয়, তা হলে খুব কাছাকাছি থাকবে ওর স্কিল। সুন্দর ফার্স্ট টাচ। বলটাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। ড্রিবল করতে পারে। ডিফেন্ডারদের ফাইনাল ট্যাকলে যেতে বাধ্য করে। ও আগে উইংয়েও খেলেছে। তাই উইঙ্গারদের মতোই সাইডলাইনকে টার্গেট করে। খেলাও ছড়ায়। কিন্তু এর পরেও গ্রিজম্যানকে এখনও কমপ্লিট ফুটবলার বলব না। এমনও ম্যাচ গিয়েছে যেখানে ও কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। আর প্লেয়ার হিসেবে তো রোনাল্ডোর সঙ্গে তুলনাই চলে না। গ্রিজম্যান উঠতি তারকা। রোনাল্ডো সেখানে উচ্চতার শৃঙ্গে। এমন কোনও রেকর্ড বাকি নেই যে ভাঙেননি। এক থেকে নব্বই— এমন কোনও মিনিট নেই যেখানে গোল করেননি।
কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে রোনাল্ডো অনেক এগিয়ে থাকলেও, গ্রিজম্যানের সাপোর্ট ভাল। পল পোগবা, দিমিত্রি পায়েত, অলিভিয়ার জিরুঁ। সবাই কিন্তু দারুণ। সেই আন্দাজে পর্তুগাল দলে রোনাল্ডোর পাশে নানি, রেনাতো স্যাঞ্চেজ ছাড়া আছেটা কে? তাও বলব সেমিফাইনালের রোনাল্ডোকে যদি ফাইনালে দেখা যায়, তা হলে ফরাসিদের তিন নম্বর ইউরো কাপ জেতার স্বপ্নটা স্বপ্নই থেকে
যেতে পারে।