যুগলবন্দি: দলকে বিপদ থেকে টেনে তোলে হার্দিক-ধোনি জুটি। ছবি: পিটিআই।
বছর পাঁচেক বয়সে বাবা-দাদার সঙ্গে যখন ছেলেটা বড়োদরায় তাঁর অ্যাকাডেমিতে এসেছিল, কিরণ মোরে ঠিক করতে পারেননি, ছেলে দু’টোকে সুযোগ দেবেন কি না। কারণ অত ছোট বয়সের ছেলে তখন তাঁর অ্যাকাডেমিতে সুযোগ পেত না। কিন্তু বাবার জেদাজেদিতে আর খুদে বাচ্চা দু’টোর আগ্রহ দেখে তাদের নেটে ডেকে নেন মোরে।
তার পরে নিয়ম পাল্টে পাঁচ আর সাত বছরের দু’টো ছেলেকে নিজের অ্যাকাডেমিতে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিলেন প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক।
ভাগ্যিস দিয়েছিলেন! কারণ সেই পাঁচ বছরের ছেলেটাই যে হয়ে দাঁড়িয়েছে আজকের হার্দিক পাণ্ড্য।
রবিবার চিপকে হার্দিক তাণ্ডব দেখার পরে ফোনে ভারতের প্রাক্তন উইকেটকিপার মোরে বলছিলেন, ‘‘আমি হার্দিককে সেই ছোটবেলা থেকে দেখেছি। ওর মধ্যে সব সময় একটা আগুন ছিল। তবে আন্তর্জাতিক স্তরের ক্রিকেটার হওয়ার মশলা যে আছে, সেটা বুঝি একটা ম্যাচ দেখে। অনূর্ধ্ব ১৪ দলের ম্যাচ ছিল সেটা। মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিল হার্দিক। সে দিন থেকেই বুঝে যাই ও অনেক লম্বা রেসের ঘোড়া হতে চলেছে।’’
মোরে অবশ্য একবারে শুরুতেও হার্দিকের মধ্যে আগুনটা দেখেছিলেন। না হলে কেন প্রথম তিন বছরে বিনা পারিশ্রমিকে অ্যাকাডেমিতে খেলা শেখার সুযোগ দেবেন। ‘‘হার্দিকের যেটা সবচেয়ে ভাল লাগত আমার, সেটা হল ছোট থেকেই ওর পরিশ্রম করার ক্ষমতা। শেখার আগ্রহ ছিল প্রচণ্ড,’’ অতীতে ফিরে গিয়ে বলছিলেন মোরে।
আইপিএল থেকে আলোয় আসা শুরু। এর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছেন হার্দিক। রবিবার যখন নামেন ২২ ওভারের মধ্যে ৮৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে গিয়েছিল ভারতের। যেখান থেকে শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। অ্যাডাম জাম্পার এক ওভারে পর পর তিনটে ছয়। এই রকম বিধ্বংসী কিন্তু ক্লিন হিটিংয়ের রহস্যটা কী? মোরে তিনটে কারণের কথা বলছেন। যাকে বলা যায় ক্লিন হিটিংয়ের ‘হোলি ট্রিনিটি’। যে তিন শর্ত পূরণ করলে অনায়সে বলকে বাউন্ডারির বাইরে পাঠানো যায়।
সেগুলো কী? মোরে বলছেন, ‘‘টাইমিং, ব্যাট সুইং এবং ব্যাট স্পিড। এই তিনটে যদি আপনি ঠিকঠাক করতে পারেন, তা হলে বড় শট নিতে সমস্যা হয় না। হার্দিক এই তিনটে ব্যাপারেই পুরো নম্বর পাবে। ওর মারা ছয়গুলো দেখেছেন! কোনও স্লগিং নয়। সব ব্যাটের মাঝখান দিয়ে মারা।’’ হার্দিকের বিগ শট নেওয়ার ক্ষমতার পিছনে আরও দু’টো কারণের কথা বলছেন মোরে। এক, হার্দিকের উচ্চতা। যা বল লিফট করার পক্ষে আদর্শ। দুই, হার্দিকের অনুশীলন। ‘‘ও নেটে নিয়মিত বড় শট নেওয়া প্র্যাকটিস করে। ২৫০ থেকে ৩০০ বল মারে। সহজাত ক্ষমতার সঙ্গে পরিশ্রমের মিশেলের ফলই কিন্তু হার্দিক।’’
এর পরে নিজে থেকেই হার্দিকের এই ছয় মারার সঙ্গে এক জনের তুলনা টেনে আনেন মোরে। বলতে থাকেন, ‘‘ওকে এ রকম বড় শট নিতে দেখে আমার এক জনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সৌরভের মতোই ক্লিন অ্যান্ড বিগ শট নেয় হার্দিক। একেবারে সোজা বল তুলে দেয় বাউন্ডারির ওপারে।’’ তা হলে কি বলা যায় হার্দিকের মধ্যে আপনি ডান-হাতি সৌরভকে দেখছেন? মোরে একমত। ‘‘হার্দিকের মধ্যে সৌরভের নিখুঁত টাইমিংটা দেখতে পাচ্ছি আমি,’’ বললেন হার্দিককে গড়া মোরে।
মুম্বই ক্রিকেট মহলে খোঁজ করলে জানা যায়, ২০১৫ সালে চেন্নাইয়ের বিরুদ্ধে আইপিএলের একটা ম্যাচে ৮ বলে ২১ করে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে জিতিয়েছিলেন হার্দিক। এবং তার পরেই সচিন তেন্ডুলকর তাঁকে বলেছিলেন, বছর দেড়েকের মধ্যেই তুমি ভারতের হয়ে খেলবে। সচিনের সেই ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গিয়েছে। এ বার মোরেও একটা ভবিষ্যদ্বাণী করতে চান। থুরি, একটা নয়, দু’টো।
প্রথমটা হল, কপিল দেবের পরে ভারত যে সত্যিকারের পেসার- অলরাউন্ডার খুঁজছিল, তাকে পাওয়া গিয়েছে। দুই, ২০১৯ বিশ্বকাপে নিজের জায়গাটা প্রায় পাকা করে ফেলেছেন হার্দিক। ‘‘অবশ্যই হার্দিকের মধ্যে খুব ভাল অলরাউন্ডার হওয়ার মশলা আছে। ব্যাটিংটা যেমন করে, পেসটাও খুব ভাল। টিম ম্যানেজমেন্টেরও হার্দিকের ওপর খুব আস্থা আছে। সে জন্যই বিরাট কোহালি-রবি শাস্ত্রীরা ওকে সব ধরনের ফর্ম্যাটে খেলাচ্ছে।’’
আর ২০১৯ বিশ্বকাপ? ‘‘দেখুন, হার্দিক বিশ্বকাপ না খেললেই আমি দারুণ অবাক হবো। আমি শুধু বলব, ঠিক করে পারফর্ম করে যা। আর কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না।’’ পাশাপাশি মোরে মনে করেন, হার্দিককে বাইরে থেকে দেখে যাই মনে হোক না কেন, ওর মধ্যে একটা দারুণ পেশাদারিত্ব আছে। আর আছে যথার্থ ক্রিকেটীয় মানসিকতা। ‘‘হার্দিকের মানসিকতা খুব ভাল। কোনও কিছুতেই ফোকাস নষ্ট হয় না। তার ওপর বিরাট কোহালি, ধোনিদের সঙ্গে খেলছে। ওদের সঙ্গে যত খেলবে, ও তত পরিণত হবে, মানসকিতাও আরও ভাল হবে।’’ বলে দিচ্ছেন পাঁচ বছরের ছেলের মধ্যে হিরে খুঁজে পাওয়া কিরণ মোরে।