হতাশা: জীবনের শেষ একশো মিটার দৌড়ে সোনা হারিয়ে ইউসেইন বোল্ট। লন্ডনে। ছবি: গেটি ইমেজেস।
পৃথিবী যেন এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গিয়েছিল।
প্রকৃতি যেন এক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সীমারেখাটা অলিম্পিক স্টেডিয়ামে যেন মুছে গিয়েছিল এক সেকেন্ডের জন্য।
এক সেকেন্ডেরও কম সময় ইউসেইন বোল্ট যে হেরে গেলেন তাঁর জীবনের শেষ একশো মিটার দৌড়ে।
রেস শেষ হওয়ার পরে স্কোরবোর্ডে পর পর ভেসে উঠল নামগুলো: ১) জাস্টিন গ্যাটলিন (৯.৯২ সেকেন্ড), ২) ক্রিশ্চিয়ান কোলম্যান (৯.৯৪ সেকেন্ড), ৩) ইউসেইন বোল্ট (৯.৯৫ সেকেন্ড)। এক মুহূর্তের নীরবতা। তার পরেই স্টেডিয়াম জুড়ে বিদ্রুপ: চিটার, চিটার। অবশ্যই ধিক্কারের লক্ষ্য এক জনই: গ্যাটলিন। ডোপ কেলেঙ্কারিতে দু’বার জড়িয়ে পড়ে যিনি অতীতে সাসপেন্ড হয়েছিলেন।
এক দিকে যখন দর্শকদের ক্ষোভের শিকার হতে হল গ্যাটলিনকে, তখন অন্য দিকে একশো মিটারের নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পাশে পেয়ে গেলেন এক কিংবদন্তিকে। তিনি স্বয়ং বোল্ট। ‘‘এই সোনাটা গ্যাটলিনের প্রাপ্য ছিল,’’ সাংবাদিকদের বলেছেন বিদায়ী মহাতারকা, ‘‘ও খুব ভাল অ্যাথলিট। আর আপনি যদি নিজের সেরা ফর্মে না থাকেন, তা হলে গ্যাটলিন আপনাকে হারিয়ে দেবে।’’
আরও পড়ুন: গ্যাটলিন নিয়ে সতর্কতা
২০১১ সালের বিশ্ব মিটের ফাইনালে বাতিল হয়ে গিয়েছিলেন। এখানে নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে বোল্ট বলছেন, ‘‘আমার শুরুটা ভয়ঙ্কর খারাপ হয়েছিল। এ রকমটা হবে ভাবিনি। বরং ভেবেছিলাম, দু’টো রাউন্ডের পরে ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হল না।’’ বোল্ট স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘স্টার্ট’টা নিয়ে তিনি নিজের ওপর বেশি চাপ নিয়ে ফেলেছিলেন। ‘‘আমি নিজেকে বার বার বলছিলাম, স্টার্টটা ভাল হতেই হবে। না হলে আমি রেসে থাকতে পারব না। হয়তো এ জন্যই শুরুতে চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। একটু ভয়ও পেয়েছিলাম মনে হয়।’’
মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। শনিবার রাতে গোটা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের চোখ ছিল লন্ডনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। সোনা জিতে নিজের কেরিয়ার শেষ করবেন অতিমানব বোল্ট, এই দৃশ্য দেখার ইচ্ছে নিয়েই হাজির হয়েছিলেন দর্শকরা। এমনকী আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট সেবাস্তিয়ান কো পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, এটা নাটকের উপযুক্ত স্ক্রিপ্ট ছিল না। স্বপ্নভঙ্গের আঘাতটা তাই সহ্য হয়নি দর্শকদের। বিষোদ্গার আছড়ে পড়েছিল গ্যাটলিনের ওপর।
ফোটো ফিনিশে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথমে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ থাকার ইঙ্গিত করেন গ্যাটলিন। তার পরেই বুঝে যান, এই মঞ্চটা আসলে কার জন্য। ট্র্যাকের মধ্যেই নতজানু হয়ে সম্মান জানান জীবন্ত কিংবদন্তিকে। যার নাম বোল্ট। এক বার মাথাটা ঘুরিয়ে জায়ান্ট স্ক্রিনটা দেখে নেন তিনি। তার পরে জড়িয়ে ধরে গ্যাটলিনকে অভিনন্দন। বোল্ট কিন্তু এর পরেও কলঙ্কিত তারকার পাশে ছিলেন।
সাংবাদিক বৈঠকে এক মহিলা সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘‘এই বছরে একশো মিটার দৌড়ের সময় কমেছে। এটা কি কঠোর ডোপ নীতির জন্য?’’ বোল্ট অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘‘এ সব কী বলছেন আপনি?’’ তার পরে পাশে বসা গ্যাটলিন এবং কোলম্যানের উদ্দেশে বলেন, উত্তরটা আমি দেবো। ‘‘আপনি যে কথাটা বললেন, তা অত্যন্ত অসম্মানজনক,’’ মহিলা সাংবাদিকের দিকে ফিরে বলতে থাকেন বোল্ট, ‘‘আমরা এর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করি। গ্যাটলিন বার বার নিজেকে প্রমাণ করেছে। আমি নিজেকে বার বার প্রমাণ করেছি। এই যে বাচ্চা ছেলেটা (কোলম্যান) দেখিয়ে দিয়েছে ও একদিন খুব বড় অ্যাথলিট হয়ে উঠবে। সময় খারাপ হওয়ার অনেক কারণ থাকে। চোট-আঘাতের সমস্যা, খারাপ ফর্ম, হাওয়ার গতি।’’
এরিনা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে আর একটা কথা বলে গেলেন কিংবদন্তি। ‘‘আমরা পা দু’টোয় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। জীবনে এই প্রথম এ রকম যন্ত্রণা টের পাচ্ছি। আমার শরীর বোঝাচ্ছে, তোমার সময় শেষ।’’
ট্র্যাকে হয়তো তাঁর সময় শেষ (যদিও ফের রিলে-তে নামবেন)। কিন্তু ইতিহাসে ইউসেইন সেন্ট লিও বোল্টের সময় কোনও দিন শেষ হবে না। তিনি যে অমরত্ব লাভ করেছেন।