ধোনি মারতে গিয়ে উইকেট দিলে নিন্দুকেরা কী বলতেন?

আমার দেখে খারাপ লাগছে যে, উপমহাদেশের কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকল না রবিবারের ফাইনালে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা মিলিয়ে চার বার বিশ্বকাপ জিতেছে। শ্রীলঙ্কা আর আমরা তো আগেই বিদায় নিয়েছিলাম।

Advertisement

ওয়াসিম আক্রম

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৯ ০৬:০৯
Share:

ছবি এএফপি।

বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের হেরে যাওয়াটা এ বারের টুর্নামেন্টের সেরা অঘটন। সকলেই ধরে নিয়েছিল, নিউজ়িল্যান্ড সব চেয়ে সহজ প্রতিপক্ষ এবং লর্ডসে রবিবার ভারত ফাইনাল খেলছেই।

Advertisement

আমার দেখে খারাপ লাগছে যে, উপমহাদেশের কোনও প্রতিনিধিত্ব থাকল না রবিবারের ফাইনালে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা মিলিয়ে চার বার বিশ্বকাপ জিতেছে। শ্রীলঙ্কা আর আমরা তো আগেই বিদায় নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, কোহালিরা অন্তত ফাইনাল খেলবেই। খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং চমকে দেওয়ার মতো ওদের বিদায়।

নিউজ়িল্যান্ড তুলেছিল ২৩৯। আমরা ক্রিকেটে এই স্কোরটাকে বিপজ্জনক বলে ধরি। এই ধরনের স্কোরের সামনে পড়লে যারা রানটা তাড়া করছে, তাদের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি ঢুকে পড়তে পারে। ভারতীয় দলের মধ্যেও এ রকম একটা দোনোমোনো মনোভাব হয়তো এসে গিয়েছিল যে, ধরে ধরে খেলব নাকি নিজেদের স্বাভাবিক ভঙ্গি ধরে রাখব।

Advertisement

নিউজ়িল্যান্ড যখন বল করতে এল, ঠিক সেই সময় পরিবেশটা ওদের বোলারদের জন্য দারুণ মানানসই ছিল। ওদের দলে সুইং বোলার বেশি। সেই সময় আকাশ মেঘলা ছিল বলে ট্রেন্ট বোল্ট, ম্যাট হেনরিরা সুইং পাচ্ছিল। পিচটা দেখেও আমার মনে হচ্ছিল, নিউজ়িল্যান্ডের পিচ। আমার নিউজ়িল্যান্ডে খেলার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ওখানকার পিচে বল এ রকমই নড়াচড়া করে। বিশেষ করে নতুন বলে। হয়তো ওদের মতো ঘাস ছিল না কিন্তু চরিত্রের দিক থেকে অনেক মিল ছিল।

তবে শুরু থেকে অনেকের মতো আমারও যে সংশয় ছিল কোহালিদের মিডল অর্ডার নিয়ে, সেই আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হল। ভারতের এই টিমটা দু’জনের উপর খুব বেশি করে নির্ভরশীল। যে দিন রোহিত আর বিরাট ব্যর্থ হবে, সে দিন বাকিদের টেনে তোলার ক্ষমতা আছে তো? এটাই শুরু থেকে প্রশ্ন ছিল সকলের মনে। রোজ রোজ তো ওরা দু’জন খেলে দেবে, তা হয় না। ধোনিও রোজ রোজ ম্যাচ ‘ফিনিশ’ করতে পারবে, ভাবা অন্যায়। মিডল অর্ডারে দীনেশ কার্তিক, ঋষভ পন্থ, হার্দিক পাণ্ড্যদের উপর পুরোপুরি আস্থা রাখাটা বোধ হয় ঠিক হয়নি। আমাদের সময়ে ভারতের মিডল অর্ডার কী ছিল! দ্রাবিড়, সৌরভ, সহবাগদের বল করতে হত আমাদের। এর সঙ্গে ছিল সকলের সেরা সচিন তেন্ডুলকর। কখনও ওপেন করত, কখনও চারেও ব্যাট করেছে ওয়ান ডে-তে। দ্রাবিড়কে তো আউটই করা যেত না। এত জমাট ছিল ওর রক্ষণ। এখন দেখি, ক্রিজে এসেই চালাতে শুরু করেছে। আমার মনে হয়, অতিরিক্ত টি-টোয়েন্টি খেলার ফলেই ওয়ান ডে-তেও শুরু থেকে টপ গিয়ারে চলে যাচ্ছে এখনকার ব্যাটসম্যানেরা।

তবু ধোনি আর জাডেজা দারুণ ভাবে ম্যাচে ফেরত এনেছিল ভারতকে। ধোনিকে নিয়ে এর পরেও সমালোচনা হচ্ছে দেখে আমি বাক্‌রুদ্ধ। বলা হচ্ছে, ও নাকি মন্থর খেলেছে। সে দিন যদি ধোনি চালাতে গিয়ে আউট হয়ে যেত, ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত যায়ই না। সেই সময় দল নিশ্চিত হারের মুখে দাঁড়িয়ে। ম্যাচটাকে টানার দরকার ছিল। ধোনি যেটা সব চেয়ে ভাল করতে পারে। আর ঠিক সেটাই ও করেছিল। শুধু নিজে ক্রিজ আগলে দাঁড়ায়নি, জাডেজা পথপ্রদর্শকের কাজটাও দারুণ ভাবে করল। তার পরেও এই অন্যায় সমালোচনাটা ওর প্রাপ্য নয়। ধোনির মতো ক্রিকেটারের অসম্মান প্রাপ্য নয়। ওর দেশকে অনেক কিছু দিয়েছে ও। বিশ্বকাপে ওর মন্থর ব্যাটিং নিয়ে যাঁরা সমালোচনা করছেন, তাঁদের কাছে দু’টো বিনীত প্রশ্ন রাখতে চাই। এক) ধোনি যদি সত্যিই সে অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে উইকেট বিসর্জন দিয়ে আসত, আপনারা কী বলতেন? দুই) এ বারের প্রতিযোগিতায় দেখা যাচ্ছে, ২৫০-২৬০ রান অনেক ম্যাচে জেতার মতো স্কোর হয়ে দাঁড়াল। তা হলে ইংল্যান্ডে এ বারের পিচ আর পরিবেশটা কে সব চেয়ে ভাল ধরতে পেরেছিল? ধোনি না অন্য কেউ?

ময়নাতদন্ত করতে বসে অনেক কথাই মনে হতে পারে। খেলোয়াড়দের সিদ্ধান্ত নিতে হয় খেলার মাঠে দাঁড়িয়ে। আমি বলব, ধোনি বিশ্বকাপের পিচ, পরিবেশকে একদম ঠিক বুঝেছিল। আমরা সকলে জানি, মাহি মগজাস্ত্রের কথা। কত বড় ক্রিকেট মস্তিষ্ক, আবারও প্রমাণ করে দিয়ে গেল। একদম ঠিক ধরেছিল যে, ইংল্যান্ডের এই মন্থর পিচে বড় স্কোরের খেলা হচ্ছে না, হচ্ছে মাঝারি স্কোরের সেই পুরনো আমলের ওয়ান ডে। যেখানে অতি আগ্রাসন নয়, দরকার আগ্রাসনের সঙ্গে সাবধানতার ঠিক মিশ্রণ।

জাডেজাকে ‘বিট্‌স অ্যান্ড পিসেস’ অর্থাৎ টুকরো-টাকরা প্লেয়ার হিসেবে কী ভাবে সঞ্জয় (মঞ্জরেকর) ব্যাখ্যা করল, জানি না। টুকরো-টাকরা ক্রিকেটারেরা কখনও ম্যাচের উপরে কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না। কিন্তু জাড্ডু তো দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে শুধু ফিল্ডিং করতে নেমেই ম্যাচের রং পাল্টে দিয়ে চলে যায়। ইংল্যান্ড ম্যাচে ওর দুর্ধর্ষ ক্যাচই তো ভারতকে ম্যাচে ফিরিয়ে এনেছিল। তার পরে যেমন বল হাতে অবদান রাখবে তেমনই ব্যাটিংয়ে অবিশ্বাস্য আত্মবিশ্বাস এবং দুর্ধর্ষ সব শট রয়েছে। টেস্ট বা ওয়ান ডে-তে জাডেজা ব্যাট হাতেও অনেক স্মরণীয় ইনিংস খেলে বহু বার ভারতকে বিপদ থেকে টেনে তুলেছে। সে দিনও যত ক্ষণ জাডেজা ছিল, মনে হচ্ছিল, ম্যাচ বার করে দেবে। ও আউট হয়ে যাওয়ায় কঠিন হয়ে গেল। ধোনিকে নিয়ে একটাই কথা শুধু বলব আমি। মাঝের দিকে কয়েকটা সিঙ্গলস নিয়ে রাখতে পারলে শেষের দিকে গিয়ে অতটা চাপ তৈরি হত না। তা হলে মরিয়া হয়ে দ্বিতীয় রানটার জন্য না ছুটলেও হয়তো চলত।

যাই হোক, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এটাই ক্রিকেট। এটাই জীবন। লর্ডসে ফাইনাল হবে ইংল্যান্ড আর নিউজ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে। গরিষ্ঠ অংশের ফেভারিট নিশ্চয়ই ইংল্যান্ড। তবে সেমিফাইনালে নিউজ়িল্যান্ড যে রকম অঘটন ঘটিয়েছে, তার পরে ওদের একেবারে উপেক্ষা করতে গেলে বোকামি হবে। আমার মন বলছে, মার্টিন গাপ্টিলের একটা বড় স্কোর জমা হয়ে রয়েছে এবং সেটা ফাইনালে আসতে চলেছে। কেন উইলিয়ামসনও আছে। দারুণ ব্যাট করছে, দারুণ নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইংল্যান্ডের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে জেসন রয় আর বেন স্টোকস।

কিন্তু কোহালিরাই যেখানে ফাইনালে নেই, পূর্বাভাস কে করবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন