নতুন চ্যাম্পিয়নের জন্য প্রহর গুনছে বিশ্ব

ক্রিকেট ছাপিয়ে জীবনের ম্যাচ আজ লর্ডসে

এক জন অধিনায়ক, যিনি আইরিশ হয়ে ‘ব্রেক্সিট’-এর মধ্যেও হয়ে উঠেছেন ইংল্যান্ডের ওয়ান ডে ক্রিকেটকে  পাল্টে দেওয়া নায়ক। যাঁর হাত ধরে অধরা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে দেশ।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

লন্ডন শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৯ ০৪:৩১
Share:

দ্বৈরথ: কার হাতে উঠবে বিশ্বকাপ? ফাইনালের আগের দিন ট্রফির সঙ্গে দুই অধিনায়ক অইন মর্গ্যান এবং কেন উইলিয়ামসন। শনিবার লর্ডসে। টুইটার

১৩ জুলাই: এক জন অধিনায়ক, যিনি জন্মানোর সময় অপারেশন থিয়েটারেও ডাক্তারদের কোনও ধারণা ছিল না, মাতৃগর্ভে আসলে রয়েছে যমজ সন্তান। প্রথমে তিনি ভূমিষ্ঠ হন। তার পরেই হঠাৎ ডাক্তারেরা আবিষ্কার করেন, আরও একটি মাথা দেখা যাচ্ছে! যমজের প্রথম জন রবিবার টস করতে নামবেন নিউজ়িল্যান্ডের জার্সিতে। আধুনিক ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটিং তারকা হয়েও যাঁর মধ্যে তারকা সুলভ কোনও ভঙ্গি বা অহং নেই। বরং এমনই মাটিতে পা-রেখে চলা এক মানুষ যে, ফাইনালের আগের দিন সাংবাদিক সম্মেলন কক্ষে ঢুকে প্রথমেই বলে ফেলবেন, ‘‘আরে, আজ অনেক লোক দেখছি!’’

Advertisement

এক জন অধিনায়ক, যিনি আইরিশ হয়ে ‘ব্রেক্সিট’-এর মধ্যেও হয়ে উঠেছেন ইংল্যান্ডের ওয়ান ডে ক্রিকেটকে পাল্টে দেওয়া নায়ক। যাঁর হাত ধরে অধরা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দেখছে দেশ। বোথাম, গ্যাটিং, গাওয়ার, গুচরা যা দিতে পারেননি। যিনি ছোটবেলায় ডাবলিনের অভ্যন্তরে সেন্ট ক্যাথরিন এস্টেটসে বসবাস করার সময় ক্রিকেট খেলছেন দেখে লোকের কটাক্ষ ভেসে আসত, ‘‘কে হে তুমি, একটা ব্রিটিশ খেলাকে আপন করে নিয়েছ কেন? এখানে সকলে ফুটবলই খেলে, দেখোনি কি তুমি?’’ আয়ারল্যান্ডের উত্তর দিকে তখন অশান্তির আগুন জ্বলছে। সে সব জায়গায় ক্রিকেট সরঞ্জাম কাঁধে নিয়ে ছুটতে হত। চোখের সামনে কত বার দেখতে হয়েছে, দুষ্কৃতীরা গাড়ি উল্টে দিয়ে জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তবু ক্রিকেট ঘিরে স্বপ্নকে নষ্ট হতে দেননি। রবিবার লর্ডসে তিনি নামবেন ইংল্যান্ডের জার্সিতে

টস করতে।

Advertisement

পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক ফাইনালের দুই যুযুধান অধিনায়কের সঙ্গে। কেন উইলিয়ামসন এবং অইন মর্গ্যান। ভারত ছিটকে গিয়েছে, কোহালি, রোহিতদের জয়গান আর গাওয়া হবে না তেরঙ্গা পতাকাধারীদের, লর্ডসে বইবে না নীল জার্সির স্রোত। তার জন্য সর্বজনীন দুঃখের আবহ রয়েছে। কারও কারও মনে হতে পারে, কোহালিদের বিদায়ে পুজোমণ্ডপ আছে, প্রতিমা আছে, কিন্তু আলোকসজ্জাই যেন খুলে নেওয়া হয়েছে। তা-বলে ক্রিকেট মাঠের অনুপ্রেরণামূলক কাহিনির কিন্তু অভাব নেই। বরং অসাধারণ সব জীবনকাহিনি আর সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসা সেই সব উদাহরণই ২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালকে অন্য শৃঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে।

মর্গ্যানের ডাবলিন থেকে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক হয়ে বিশ্বকাপ জেতানোর স্বপ্ন দেখানোর কাহিনি যেমন। সমুদ্রপারের একটি ছোট্ট শহর রাশ। সেখানে ক্রিকেট নিয়ে উৎসাহী লোকের দেখা পেতে গেলে তপস্যা করতে হবে। বরং দুলকি চালে জীবনের এক-একটা দিন কাটিয়ে দিতেই অভ্যস্থ সকলে। ক্রিকেট যদিও প্রথম থেকেই গেঁড়ে বসেছিল মর্গ্যান পরিবারের মধ্যে। রাশ একাদশের অধিনায়কত্ব করেছেন বাবা জোডি। তাঁর দুই ভাই ক্রিকেট খেলেছেন। এমনকি, তাঁর দুই বোনও খেলতেন। সকলকেই রাশ ক্রিকেট ক্লাবে নিয়ে গিয়েছিলেন জোডি। তাঁদের মধ্যে অইন যদিও সমুদ্রপারের অলস শহর ছাড়িয়ে ক্রিকেট আকাশে ওড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এগারো বছর বয়সেই তিনি খেলতে শুরু করে দেন তাঁর চেয়ে বড় তেরো, চোদ্দো বছরের ছেলেদের সঙ্গে। যাতে ছোটবেলায় বড়দের বক্সিং রিংয়ে গিয়ে মার খেতে খেতে আজকের শক্ত চোয়ালের ক্যাপ্টেন মর্গ্যান তৈরি হয়। খুব অল্প বয়স থেকেই তিনি লক্ষ্য স্থির করে নেন— ‘‘আয়ারল্যান্ডের ক্রিকেট নিয়ে সুদূরপ্রসারী কোনও লক্ষ্য নেই। ক্রিকেট সংস্থার কোনও চিন্তাভাবনাই নেই খেলাটাকে ছড়িয়ে দেওয়ার। দু’একটা বিশ্বকাপে গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স দিয়েই চলে যাবে। আমাকে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে হবে।’’ হাজার টিটকিরির মধ্যেও স্বপ্নের মৃত্যু হতে দেননি অইন।

নিউজ়িল্যান্ড অধিনায়কের জীবন একই রকম আকর্ষণীয়। ভাগ্য সহায় না হলে পৃথিবীর আলো দেখাই হত কি না, কেউ জানে না। মা সান্দ্রা অন্তঃসত্ত্বা থাকার সময় জটিলতা কেন দেখা দিচ্ছে, ডাক্তারেরাও ধরতে পারছিলেন না। তিন রাত ধরে হাসপাতালে গভীর পর্যবেক্ষণ চলে মায়ের। তাতেও কিছু উদ্ধার করা যায়নি। কার্যত অন্ধকারে থেকেই তাঁরা সান্দ্রাকে নিয়ে যান প্রসব টেবলে। তার পরে যমজ আবিষ্কারের ধাক্কা এবং ভাগ্যের জোরে মা এবং কেন ও লোগান, দুই যমজ সন্তানের জীবনরক্ষা হওয়া। তাউরংয়ার বে অফ প্লেন্টিতে থাকতেন তাঁরা। অইন মর্গ্যানের সমুদ্রপারের হাওয়ায় বড় হওয়ার ছোঁয়া রয়েছে কেন উইলিয়ামসনের জীবনের পথেও। বে অফ প্লেন্টিতে বিশ্বের সেরা সব সমুদ্রসৈকত রয়েছে। যেখানে বছরের নানা সময়ে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। নিউজ়িল্যান্ডের একমাত্র সক্রিয় আগ্নেয়গিরিও এখানেই।

উইলিয়ামসনের মধ্যে অবশ্য আগ্নেয়গিরির চেয়েও সমুদ্রের হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া বেশি। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পরে ক্রিকেট দুনিয়ার নতুন ‘ক্যাপ্টেন কুল’ বলা হচ্ছে তাঁকে। ধোনির মতোই শান্ত, স্থিতধী ভঙ্গিতে শেষ করলেন ধোনিদের অভিযান। তার পরেও এতটাই মাটিতে পা রেখে চলা মানুষ তিনি যে, শোনা গেল লর্ডসের গেট দিয়ে ঢোকার সময় নাকি পরিচয়পত্র গলায় ঝোলাচ্ছিলেন। যদি নিরাপত্তারক্ষীরা দেখতে চান, হাতের কাছে রেখে দিই। কে বলবে, আর কয়েক ঘণ্টা পরে তিনি বিশ্বকাপ ফাইনালে টস করতে নামবেন এ মাঠেই! মর্গ্যান পরিবারের মতোই উইলিয়ামসনদের সংসারেও খেলার প্রতি আগ্রহের অভাব ছিল না। বে অফ প্লেন্টিতে ক্লাব ক্রিকেটে খুব পরিচিত নাম ছিলেন তাঁর বাবা ব্রেট উইলিয়ামসন। মা সান্দ্রা ভাল বাস্কেটবলার ছিলেন। দুই বোন আনা এবং সফি ভলিবলে বয়সভিত্তিক বিভাগে নিউজ়িল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন। ছোটবেলায় লোগান এবং কেন, দুই যমজ ভাই নানা খেলায় অংশ নিতেন এবং কোনওটাতেই তাঁরা খারাপ ছিলেন না। তবে ক্রিকেট আকাশের উড়ানই যে তিনি ধরবেন, ক্রমশ পরিষ্কার হয়ে আসছিল। যাঁর সিনিয়র ক্রিকেটে প্রবেশ ১৪ বছর বয়সে, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আবির্ভাব ১৬ বছরে, স্কুল ছাড়ার আগেই যাঁর নামের পাশে লেখা হয়ে গিয়েছে ৪০টি সেঞ্চুরি, যাঁর টেস্ট ক্রিকেটে জয়যাত্রা শুরু ২০ বছর বয়সে সেঞ্চুরি দিয়ে, তাঁর জন্য লর্ডসের ফাইনাল মোটেও অনুপ্রবেশকারীর মঞ্চ নয়। তা সে যতই গোটা নিউজ়িল্যান্ডের জনসংখ্যার চেয়ে শুধু মুম্বইয়েই দু’গুণ লোক বসবাস করুক। যতই ভারত হোক বিশ্বের এক নম্বর টিম। আর যতই বিরাট কোহালি, রোহিত শর্মারা ক্রিকেট দুনিয়ার জনপ্রিয়তম তারকা হোন।

এর পরেও যদি লর্ডসের ফাইনালে অনুপ্রেরণার দরকার পড়ে, গ্যারি স্টিড আছেন। ভারতে হয়তো অনেকে তাঁর নামই শোনেনি। কেন উইলিয়ামসনদের কোচ হিসেবে লর্ডসে অতিথি ড্রেসিংরুমে থাকবেন স্টিড। এই বিশ্বকাপের সব চেয়ে আবেগপূর্ণ যাত্রা সম্পূর্ণ হতে চলেছে তখন। উনত্রিশ বছর আগে আঠেরো বছর বয়সি এক তরুণ হিসেবে এই লর্ডসে এ রকমই এক দুপুরে জানলা পরিষ্কার করছিলেন স্টিড। লর্ডসে মাঠের কর্মী হিসেবে তখন কাজ করতেন তিনি। নানা রকম কাজের মধ্যে একটা ছিল প্যাভিলিয়নে, ড্রেসিংরুমের জানলা পরিষ্কার করা। তেমনই থাকছেন জনি বেয়ারস্টো। এই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের সব চেয়ে সফল ব্যাটসম্যান। কিশোর বয়সে এক দিন স্কুল থেকে ফিরে যিনি দেখেছিলেন, অবসাদগ্রস্ত বাবার নিথর শরীর ঝুলছে ফ্যান থেকে। আজও যখন সেঞ্চুরি করেন বেয়ারস্টো, প্রথমে হেলমেট খুলে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাবাকে খোঁজেন। আর বিড়বিড় করে হয়তো বলতে থাকেন, কেন জীবনকে শেষ করে দিয়েছিলে?

রবিবার ভারতহীন হয়েও লর্ডসের ফাইনাল তাই জৌলুসহীন দেখাতে পারে বাইরে থেকে। কিন্তু মোটেও আবেগহীন হয়ে পড়ছে না। আর কে বলল, এটা ক্রিকেট ফাইনাল? এ তো জীবনযুদ্ধে জয়ীদের মঞ্চ। ফাইনালে যে-ই জিতুক, যে-ই হারুক, জীবনের জয়গান লেখা নিশ্চিত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন