ধোনি ধাঁধার মধ্যেই উদয় পন্থের

কেউ কেউ বলছেন, সেই তো বড় স্ট্রোক বেরোল না ধোনির ব্যাট থেকে। সেই তো স্পিনারকে খেলতে গিয়ে থমকালেন। আবার ধোনি-সমর্থকদের সওয়াল, ওই সময়ে একের পর এক উইকেট যাচ্ছে।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

বার্মিংহাম শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৯ ০৪:১৮
Share:

ধোনি ও ঋষব পন্থ। ছবি: এএফপি।

মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে নিয়ে তৈরি হওয়া ধাঁধা জিইয়ে রাখল এজবাস্টন। ৩৩ বলে ৩৫ রান করার পরে প্রশংসা আর সমালোচনা—দু’রকম প্রতিক্রিয়াই পাওয়া যাচ্ছে তাঁকে নিয়ে।

Advertisement

কেউ কেউ বলছেন, সেই তো বড় স্ট্রোক বেরোল না ধোনির ব্যাট থেকে। সেই তো স্পিনারকে খেলতে গিয়ে থমকালেন। আবার ধোনি-সমর্থকদের সওয়াল, ওই সময়ে একের পর এক উইকেট যাচ্ছে। দেখলাম তো তোদের হার্দিক পাণ্ড্যদের দৌড়! এমএসডি না-দাঁড়ালে ভারতের রান তিনশো পেরোত না। ৩৫ রানটা আসলে পরিস্থিতির বিচারে ৫০।

ধোনি নিয়ে দু’পক্ষের তরজা যেমন চলছিল, চলবে। আপাতত তাঁর দিকে হাওয়া কিছুটা ঝুঁকে থাকার কারণ, ভারতের তোলা ৩১৪-৯ ম্যাচ জেতানোর মতো স্কোর হয়ে দেখা দিল মঙ্গলবার। ২৮ রানে জিতে কোহালিরা সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করলেন। যদি অস্ট্রেলিয়া এক হয়, যদি তাঁরা দুই বা তিন নম্বর হন, তা হলে এই এজবাস্টনেই দ্বিতীয় সেমিফাইনাল খেলার জন্য ফিরে আসতে দেখা যেতে পারে তাঁদের।

Advertisement

এসপার-ওসপার ম্যাচ হেরে কার্যত বিদায়ের পথে বাংলাদেশ। তবে বিনা যুদ্ধে তারা সূচ্যগ্র মেদিনীও ছাড়েনি। হার্দিকের স্লোয়ারে শাকিব-আল-হাসান বোকা বনে যাওয়ার পরে মনে হয়েছিল, নটে গাছটি মুড়োল। কিন্তু সেখান থেকেই অবিশ্বাস্য প্রত্যাঘাতের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছিলেন সাব্বির রহমান এবং মহম্মদ সইফুদ্দিন। দু’জনে মিলে সপ্তম উইকেটে ৬৬ রান যোগ করলেন। পাণ্ড্য থেকে শুরু করে মহম্মদ শামি, প্রত্যেককে তখন পথভ্রষ্ট দেখাচ্ছে আর কলকাতায় সেই সেলিম মালিক ম্যাচের স্মৃতি ফিরে আসার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

এই অবস্থায় এজবাস্টনের ভারতীয় দর্শকেরা হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে উঠলেন। চলতি বিশ্বকাপে তাঁরাই কোহালিদের দ্বাদশ ব্যক্তি। বুম-বুম-বুমরা তখন বোলিংয়ে ফিরে এসেছেন। এজবাস্টনের গ্যালারি গান ধরল তাঁকে নিয়ে। সেই তেরঙ্গা-তরঙ্গে উজ্জীবিত বুমরা ফিরিয়ে দিলেন সাব্বিরকে। এর পরেও সইফুদ্দিন একা লড়ে যাচ্ছিলেন। আট নম্বরে নেমে ৩৮ বলে ৫১ নট আউটের ইনিংস শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত উদ্বেগে রেখেছিল ভারতীয়দের। কিন্তু বুমরা তাঁর ইয়র্কার ব্রহ্মাস্ত্রে অন্য দিক থেকে বাংলাদেশের বাকি ব্যাটসম্যানদের সাবাড় করে দিলেন। এজবাস্টনের গ্যালারিতে ভাংরার সুরে চাপা পড়ে গেল ব্যাঘ্রগর্জন।

একই সঙ্গে এজবাস্টন তৈরি করে দিয়ে গেল ধোনি-উত্তর যুগের রূপরেখা। দেখিয়ে দিল, মহাতারকার উত্তরসূরি তৈরি। তাঁর নাম ঋষভ পন্থ। অগ্রজকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার দিনে অনুজের অবদান ৪১ বলে ৪৮।

ক্রিকেট-বিশ্বে বিরাট আলোড়ন ফেলে দেওয়ার মতো ইনিংস নিশ্চয়ই নয়। বরং এজবাস্টনের এক দিকের ছোট বাউন্ডারির সুবিধে না-তুলে বড় বাউন্ডারির দিকে মারতে গিয়ে আউট হওয়ার মধ্যে বুদ্ধিশুদ্ধির অভাব প্রকট। কিন্তু পরিস্থিতি বিচারে ধোনি যদি ব্যাটিংয়ে এ দিন পাশ মার্কস পান, তা হলে পন্থ পাবেন লেটার। ঠিক সেই সময়টাতেই বাংলাদেশ ম্যাচে ফিরে এসেছিল। কোহালিকে পুল মারায় প্রলুব্ধ করে তুলে নিলেন মুস্তাফিজ়ুর রহমান। দু’বল পরে হার্দিক আউট। মুস্তাফিজ়ুরের সেই ওভারে জোড়া উইকেট-সহ মেডেন গেল। ইনি সেই মুস্তাফিজ়ুর, যাঁকে বাংলাদেশ আদর করে ডাকে মুস্তাফিজ় বলে। যাঁর কাটার বলগুলো প্রথম সিরিজে কিছু বুঝতে না-পেরে বাংলাদেশে গিয়ে সিরিজ হেরেছিলেন ধোনি, কোহালিরা। আর তাঁদের মাথা মুড়িয়ে কার্টুন ছেপে সেখানকার কাগজ পরিহাস করেছিল। মুস্তাফিজ় আজও ভারতকে তাঁর কাটারে রক্তাক্ত করার ব্যবস্থা করেছিলেন। এই নিয়ে তৃতীয় বার পাঁচ উইকেট নিলেন ভারতের বিরুদ্ধে। সেই শারজা যুগের আকিব জাভেদকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ভারতকে পেলেই তেড়েফুঁড়ে ওঠেন।

হার্দিক আউট হতেই গ্যালারি ‘ধোনি...ধোনি’ বলে চেঁচাতে শুরু করে। কে বলবে, এ মাঠেই রবিবার ধিক্কার শুনতে হয়েছে তাঁকে! তার মধ্যেই বাংলাদেশের বোলারদের তীব্র প্রতি-আক্রমণ করলেন পন্থ। সইফুদ্দিনের ওভারে পরপর তিনটে বাউন্ডারি মারলেন। ধোনি আগের দিনের মতোই প্রথম বল খেলতে গিয়ে ছেড়েছেন। স্পিনের বিরুদ্ধে ইদানীং আটকে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ অধিনায়ক মাশরফি বল তুলে দিলেন শাকিবের হাতে। ধোনি ফের আটকে গেলেন।

কিন্তু তিনিও যে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি! সহজে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে যাওয়ার পাত্র নন। আগের দিন ইংল্যান্ডের সঙ্গে তাঁর উদ্ভট ব্যাটিং নিয়ে এত সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যেই একটা ছবি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ক্রিকেট-দুনিয়ায়। আঙুলে বল লাগার পরে তা মুখে নিয়ে চুষে যখন থুতুর মতো বার করলেন, দেখা গেল রক্ত বেরিয়ে এসেছে। ফেটে যাওয়া আঙুল নিয়েই খেলে যান তিনি। ধোনি ক্রিজে নামতেই তাঁর ভক্তেরা কেউ কেউ সেই লাল রক্ত বেরিয়ে আসার আবেগপূর্ণ ছবি তুলে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন, ‘‘তোমার রক্ত আর আমাদের চোখের জলে চলো, নতুন লড়াই শুরু করি।’’ এজবাস্টনকে সত্যিই তখন আর ক্রিকেট মাঠ নয়, জীবনের যুদ্ধক্ষেত্র মনে হতে শুরু করেছে। তার মধ্যেই ধোনি সেই শেষের রাজা হয়েই বাঁচতে চাইলেন। খুব বেশি কিছু করতে পারলেন না। চারটি বাউন্ডারি পেলেন, কোনও ছক্কা নেই। শেষ ওভারে কাজ করল না ‘ফিনিশারের’ রণনীতি। সিঙ্গলস নিতে না-চেয়ে দর্শকদের ফের ধৈর্যহারা করে তুলেছিলেন।

ক্রিকেটীয় দিক থেকে দিনটা ছিল ভারতীয় ওপেনিং জুটির। রোহিত শর্মা এবং কে এল রাহুল প্রথম উইকেটে তুলে দিলেন ১৮০ রান। এবং, অন্যান্য দিনের মতো অতি সাবধানি ভঙ্গি নয়, অনেক বেশি ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে নেমেছিলেন তাঁরা। প্রথম ওভারেই বাংলাদেশের অধিনায়ক মাশরফি মর্তুজাকে পুল মেরে গ্যালারিতে ফেললেন রোহিত। আজ প্রথম দশ ওভারে তাঁরা তুললেন ৬৯।

কিন্তু কী হত যদি ৯ রানের মাথায় রোহিতের সহজ ক্যাচ না-ছাড়তেন তামিম ইকবাল? মিডউইকেটে ওই ক্যাচ ফস্কানোর ছবি দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে যাবে তামিমকে। চলতি বিশ্বকাপে রোহিত মোট পাঁচ বার এ রকম ক্যাচ দিয়ে বেঁচেছেন। তার মধ্যে চারটি সেঞ্চুরি করে ফেললেন। ৯ রানে বেঁচে গিয়ে থামলেন ৯২ বলে ১০৪-এ গিয়ে। রাহুল সমসংখ্যক বল খেলে করলেন ৭৭।

কোনও সন্দেহ নেই, জয়ের ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করে দিয়েছিলেন দুই ওপেনার। বল হাতে বুমরা দেখালেন, কেন বিশ্বের সেরা পেসার বলা হচ্ছে তাঁকে। কিন্তু এজবাস্টনে আবেগের ছবি ধোনি এবং পন্থ। রাঁচীর মতো ছোট্ট শহর থেকে উত্থান ঘটে ওয়াংখেড়েতে ছক্কা মেরে বিশ্বকাপ জেতানোর এমএসডি কাহিনি ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা রূপকথা হয়ে থেকে যাবে। কিন্তু ধোনির নেতৃত্বেই ছ’বছর আগে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার মাঠে দাঁড়িয়ে এটাও দেখা গেল যে, পশ্চিমে হেলে পড়ছে অস্তাচলগামী সূর্য। পূব আকাশ রাঙিয়ে উঠেছে আগামীর সূর্য!

ধোনির এক প্রাক্তন সতীর্থ যা দেখে টুইট করে বসলেন, ‘‘আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত আমরা চার নম্বর ব্যাটসম্যান পেয়ে গিয়েছি। আসুন, আমরা ওকে ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তুলি।’’ ধোনির সঙ্গে জুটি বেঁধে অতীতে বহু ওয়ান ডে জেতানো সেই সতীর্থের নাম? যুবরাজ সিংহ।

সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত হওয়ার আনন্দোৎসবের মধ্যে নজর টেনে নিল আর একটি দৃশ্য। সৌজন্য করমর্দনের সময়ে রোহিতকে তিনি টেনে আনলেন পিছন থেকে। দাঁড় করিয়ে দিলেন কোহালির পিছনে। দলের সহ-অধিনায়ক যে রোহিত! জয়ের হুল্লোড়ের মধ্যেও পারিবারিক শিষ্টাচার থেকে চ্যুত হব কেন? বরাবরের মতো গীতার সেই স্থিতধী পুরুষ। হারের দুঃখে তলিয়ে যাব না, জয়ের আনন্দে উড়ব না। ক্রিকেট চিরদিন থাকবে না, থেকে যাবে এই এমএসডি রূপকথা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন