বিশ্বাস হারিও না, নিজেকে বোঝান শামি

যত সহজে বললেন, পরিস্থিতি ততটা সহজ মোটেও ছিল না। উইকেটে তখন মহম্মদ নবি। আফগানিস্তানের অলরাউন্ডার ব্যাট করতে পারেন।

Advertisement

সুমিত ঘোষ

সাউদাম্পটন শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ০৪:৩২
Share:

মধ্যমণি: শামিকে অভিনন্দন চহাল-কোহালির। শনিবার। এএফপি

শেষ ওভার যখন বল করতে যাচ্ছেন, তাঁর হাতে ১৬ রান। কী চলছিল তাঁর মনে? ম্যাচ জেতার আনন্দে তখনও ভারতীয় সমর্থকেরা উল্লাস করে যাচ্ছেন। হ্যাটট্রিকের নায়ককে মাঠে যতই ভারতকে জিতিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে দেখা যাক, এখন একেবারে শান্ত। বরাবরের মতোই যেন সেই নির্লিপ্ত মহম্মদ শামি। বলে দিলেন, ‘‘বিশেষ কিছু না। হাতে বল আছে। ১৬ রান পেয়েছি টিমকে জেতানোর জন্য। একটাই কথা ভাবছিলাম। নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে ওভারটা করতে হবে।’’ শেষ ওভারে স্নায়ুর চাপ ধরে রাখাটাই যেন আসল চ্যালেঞ্জ ছিল, মানছেন শামি।

Advertisement

যত সহজে বললেন, পরিস্থিতি ততটা সহজ মোটেও ছিল না। উইকেটে তখন মহম্মদ নবি। আফগানিস্তানের অলরাউন্ডার ব্যাট করতে পারেন। আইপিএল-সহ বিশ্বের নানা টি-টোয়েন্টি লিগে শেষের দিকে নেমে সংক্ষিপ্ত, ঝোড়ো ইনিংস খেলে ম্যাচ জেতানোর অভিজ্ঞতা আছে নবির। এখানে শামির প্রথম বলেই চার মেরে দিয়েছিলেন। তখন কী ভাবছিলেন? শামির জবাব, ‘‘এটাই চেষ্টা করছিলাম যে, ওকে নন-স্ট্রাইকার প্রান্তে আনতে হবে। নবিকে স্ট্রাইক থেকে সরানোর চেষ্টা করছিলাম। আর তার জন্য ইয়র্কারই অস্ত্র ছিল।’’ প্রথম বলটাও ইয়র্কারই করতে গিয়েছিলেন কিন্তু ভুল জায়গায় পড়েছিল বলে নবি চার মেরে দেন। দ্বিতীয় বলটা ঠিক জায়গায় পড়েছিল। মিডউইকেট ফিল্ডারের হাতে যায় নবির শট। একটি রান হতে পারত দেখে দৌড়ননি নবি। স্ট্রাইক ধরে রাখেন নিজের কাছে। ‘‘আমি নিজের প্রতি বিশ্বাস হারাইনি। প্রথম চারটা খাওয়ার পরেও নিজেকে বলেছি, বাকি রান তোলা সহজ হবে না ওদের পক্ষে। ওই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, মনের জোরটা না হারানো,’’ বলছিলেন শামি।

তাঁকে বলা হল, চেতন শর্মার পরে আপনি দ্বিতীয় ভারতীয় বোলার যিনি বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করলেন। কেমন অনুভূতি হচ্ছে? শামির জবাব, ‘‘আমি খুবই খুশি। বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক খুবই বিরল একটা কৃতিত্ব। সব স্বপ্নের সেরা স্বপ্নের মতো। আমি সেই বিরল কৃতিত্ব অর্জন করতে পেরেছি বলে আল্লার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’’ এই সময় কিছুটা যেন আবেগে গলা ধরে এল তাঁর। বলে ফেললেন, ‘‘অনুভূতিটা ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারব না।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: জিতলেও আফগানরা বিরাটদের যে ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল​

গত এক বছরে কী ব্যক্তিগত জীবনে, কী ক্রিকেট মাঠে— চরম অশান্তির মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। ফিটনেস পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে ভারতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন। স্ত্রী হাসিন জাহান মারাত্মক অভিযোগ তুলে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন। কলকাতা পুলিশের দল উত্তর প্রদেশের বাড়িতে হানা দিয়েছে তাঁকে খুঁজতে। মেয়েকে দেখতে চেয়েছেন কিন্তু কাছে পাননি। শেষ পর্যন্ত আইনি পদক্ষেপের দ্বারস্থ হওয়ার কথা ভেবেছেন মেয়েকে কাছে পাওয়ার জন্য। তার মধ্যেই বারবার ভেবেছেন, কেন তাঁর জীবনে এমন প্রলয় নেমে এল? জীবনের কঠিনতম অধ্যায়ে তার পরেই নিজের মনকে শক্ত করে নিয়েছেন শামি। ঠিক করেছেন, লড়াই চালাবেন। ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে হবে তাঁকে। এক বার আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘জীবনে দু’টো সেবাই আমি করতে চাই। ক্রিকেট আর মেয়ের সেবা।’’ বারবার তাঁকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। বাড়িতে জিম বসিয়ে ফিটনেসে অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়েছেন। তার পরে ওয়ান ডে কেরিয়ার শেষ হতে হতে বাঁচিয়ে তুলেছেন। বিশ্বকাপের দৌড়ে এক বছর আগেও তিনি ছিলেন না। অস্ট্রেলিয়া, নিউজ়িল্যান্ডে নিজেকে প্রমাণ করে বিশ্বকাপ দলে জায়গা করে নিয়েছেন। তার পরেও ইংল্যান্ডে এসে বসে থাকতে হচ্ছিল রিজার্ভ বেঞ্চে। ভুবনেশ্বর কুমারের চোট না লাগলে হয়তো এখানেও খেলার সুযোগ পেতেন না। তাই যতই নির্বিকার থাকার চেষ্টা করুন, সাউদাম্পটনের ম্যাচ জেতানো হ্যাটট্রিক আবেগের ছোঁয়া দিয়েই গেল। ‘‘বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিকের অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না,’’ আবার বললেন তিনি।

কঠিন সময় যে শেষই হতে চায় না, তা প্রভাব ফেলে শামির উপরেও। লুকোতে পারলেন না নিজের মনের কথা। ‘‘বিশ্বের সব জায়গায় আমি সফল হয়েছি। তার পরেও যখন বিশ্বকাপের প্রথম একাদশে জায়গা হয় না, তখন তো হতাশা আসেই। কিন্তু এ সব নিয়ে ভেবে কী হবে? নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। নিজের স্কিল নিয়ে কাজ করতে হবে। আরও উন্নতি করে যেতে হবে এবং সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে,’’ বলে দ্রুত যোগ করছেন তিনি, ‘‘সুযোগ পেলেই তাকে কাজে লাগাও আর নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দাও।’’

বিশ্বকাপের পঞ্চম ম্যাচে এসে পাওয়া সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারলেন কলকাতা ময়দানে ফাস্ট বোলিংয়ের নবাব হয়ে ওঠা শামি? বোঝা গেল তাঁর অধিনায়কের কথা থেকেই। ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসে কোহালি বলে গেলেন, ‘‘সব চেয়ে বেশি বল মুভ করাচ্ছিল শামিই। দুর্দান্ত বল করেছে।’’ জীবনের সেরা জয়গুলোর একটা হিসেবে সাউদাম্পটনের কথা বলে গেলেন কোহালি। ‘‘সব কিছু আমাদের পক্ষে যায়নি। তবু যে ম্যাচটা জিতে বেরোতে পারলাম, সেই কারণেই এই জয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’ আফগানিস্তানের হতভাগ্য অধিনায়ক গুলবদিন নইব বলে গেলেন, যশপ্রীত বুমরার তিনটে ওভারই পার্থক্য গড়ে দিয়ে গেল। ‘‘আমাদের কারও ব্যাট থেকে ৭০-৮০ দরকার ছিল। ৩০-৪০ দিয়ে হল না। কিন্তু বুমরাকে কৃতিত্ব দিতে হবে। যে ভাবে শেষ তিনটে ওভার ও করল, অসাধারণ।’’

ম্যাচের পরে যে ভাবে তেরঙ্গা পতাকা হাতে দর্শকেরাও আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের হাততালি দিচ্ছিলেন, তা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার। ভারত জিতেছে ঠিকই কিন্তু আফগানিস্তানও হারেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন