বিদায় রুনিদেরও। ইউরোয় আইসল্যান্ড ম্যাচে হারের পর। ছবি: এএফপি
ক্ল্যাপ, ক্ল্যাপ বুম।
ক্ল্যাপ, ক্ল্যাপ বুম।
এরোপ্লেনের মতো দু’হাত ছড়িয়ে পাগলের মতো জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে ছুটে যাচ্ছে যে ছেলেটা, সে বছরে বারোটা মাস মাছ ধরে। ওটাই জীবন, ওটাই জীবিকা। দেশ থেকে প্যারিসের ফ্লাইট ভাড়া, বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের বিল মেটাতে মেটাতে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অর্ধেক ফাঁকা, কয়েকশো ইউরোর টিকিট কেটে আবার মাঠে যাওয়া ওর সামর্থ্যে কুলোয়নি। চিৎকার করে-করে গলার স্বরলিপিও বিলুপ্তপ্রায়, ফ্যাঁসফ্যাঁসে বাতাস ছাড়া কিছু বেরোচ্ছে না এখন।
তবু ছেলেটা চেঁচিয়ে যাচ্ছে। গ্লাসের পর গ্লাস তরল গায়ে ঢেলে কনকনে ঠান্ডাতেও নিজেকে বিয়ার-স্নান করাচ্ছে। “ওহ্ মাই গড...গড...ইসল্যান্ড..ইসল্যান্ড,” কণ্ঠস্বর বিদীর্ণ করা যে আওয়াজ মধ্যরাতে আছড়ে পড়ে, তা অপ্রকৃতিস্থ। অতিপ্রাকৃতিক।
‘আর ইউ আইসল্যান্ডিক এনাফ?’ মধ্যরাতের আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোনে অতিকায় এক প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছে কেউ। কাছে গিয়ে দেখা গেল, উনি এক উত্তেজিত টিভি ক্রু। পেশার ধর্ম ভুলে, স্বাভাবিকতার লৌহবর্ম ছুড়ে, ফুটবল-উষ্ণতার হাত ধরেছেন। প্রবল ডাকাডাকি করে সমর্থকদের জড়ো করছেন ওই প্ল্যাকার্ডের নীচে। কিছুই না, ছবি তুলবেন। আগে ইতিহাসের সঙ্গে নিজের ছবি, তার পর টিভি ক্যামেরায় ইতিহাসের ছবি!
আরে, ওঁরা কারা? গায়ে তো ফ্রান্স, জার্মানি, বেলজিয়াম, স্পেনের পতাকা ঝুলছে! কিন্তু গালে? কব্জিতে? নীল-সাদা, শুধু নীল-সাদা। জেইমি ভার্ডি সহজতম সুযোগ নষ্ট করলে ওঁরাও শিহরিত হচ্ছেন! বরফ-দেশের বিখ্যাত গুডজনসেনের শট অল্পের জন্য বাইরে চলে গেলে ওঁদের আস্ফালনেও মিশে থাকছে তীব্র হতাশা। ফ্যান জোনকে নিজেদের মালিকানা করে ফেলা ইংরেজদের থেকে ওঁরা বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে, রূপকথার দেশের জনাকয়েক সমর্থকের সঙ্গে।
সবাই কি আইসল্যান্ডের জন্য আজ এখানে? সবাই কি আইসল্যান্ড সমর্থক? তত্ত্বে পূর্ণ সমর্থন দেওয়া মিথ্যাচার হবে। জার্মান যুবক কোল এসেছেন ইংল্যান্ডের প্রতি অন্তহীন ঘৃণা নিয়ে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে খেলবে, তিনি সেই দেশের সমর্থক। কিন্তু ফরাসি যুবক লুকা? প্রেমিকাকে নিয়ে যিনি বছর দু’য়েক আগে আইসল্যান্ড ঘুরতে গিয়েছিলেন? বিশ্বভ্রাতৃত্বের অনন্য ছোঁয়া পাওয়া যায় তাঁর মুখচোখের মুগ্ধতায়, কথাবার্তায়। “করব না সমর্থন? এত ছোট দেশ, কিন্তু কত সুন্দর খেলে।”
ঠিকই। এত ছোট দেশ, কিন্তু কত সুন্দর খেলে!
রাতে মেট্রো ধরার জন্য হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল, চার ইংরেজ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় হেঁটে চলেছেন সাঁ দে মার্স রাজপথ দিয়ে। যত বার হেঁচকি উঠছে, তত বার মুখ থেকে অকথ্য গালাগাল ছিটকে আসছে। “ভাব, এদের দেশ আমাদের ডার্বির চেয়েও ছোট রে। আর তাদের কাছেই হেরে গেলাম। ছ্যাঃ!” ইংল্যান্ড বা ওয়েলসের খেলা পড়লে সমর্থকদের খুব চেনা একটা গান গাইতে শোনা যায়— ‘ডোন্ট টেক মি হোম, প্লিজ ডোন্ট টেক মি হোম’। অতীব দুঃখে, যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ তিরে ছিন্নভিন্ন ইংরেজদের তৈরি তার প্যারডি কী দাঁড়াল, সেটা আর লেখা গেল না।
একে হার, তার উপর ফরাসি পুলিশের মার। গত রাতেও হেরে গিয়ে ঝামেলা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছে, এবং দৈত্যাকৃতি ফরাসি কৃষ্ণাঙ্গদের হাতে মার খেয়ে মাঠের মতো মাঠের বাইরেও শেষ পর্যন্ত পলায়ন ছাড়া গতি ছিল না। মঙ্গলবার সকালে বিলেতের কাগজগুলো দেখলে মন আরও বিক্ষিপ্ত, আরও বিক্ষুব্ধ হবে। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ লিখেছে, জঘন্য হারে ইংল্যান্ড ইউরোর বাইরে। ‘দ্য টাইমস’ আবার তিন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে লিখিয়েছে এই অভাবনীয় হার নিয়ে।
কিন্তু ব্রিটিশ ফুটবল— তার কী হবে? টিম ম্যানেজার রয় হজসন গত রাতেই ইস্তফা দিয়েছেন। ওয়েন রুনি-ও মেসির মতো জাতীয় জার্সি থেকে অবসর-গ্রহে ঢুকে পড়বেন কি না, সেটা একটা জ্বলন্ত প্রশ্ন। হজসন তাঁকে স্ট্রাইকার থেকে মিডফিল্ডারে নামিয়ে এনেছিলেন। পরবর্তী কোচ ডিফেন্সে পাঠিয়ে দেবেন কি না, কে জানে!
সোমবার রাতে একটা পেনাল্টি মারা ছাড়া কিছু করতেও পারেননি ইংরেজ অধিনায়ক। ইংরেজ সমর্থকরা এর পর বিয়ারের বোতল ভাঙবেন না তো আর কবে ভাঙবেন? সত্যি, হারেও যে কত বৈচিত্র দেখাবে ইংল্যান্ড! কখনও জার্মানির কাছে চার গোল খায়, কখনও এমন এক গোলকিপারের কাছে বারবার আটকে যায় যিনি পেশায় ফিল্ম পরিচালক! আইসল্যান্ড গোলকিপার হান্স পল হলডরসনের কথা হচ্ছে। ইংল্যান্ডের কোচ হজসন এই ইউরোর সবচেয়ে দামী মগজ। অথচ তাঁকেই কি না হারতে হল এমন এক জনের কাছে, যিনি পেশায় দন্তচিকিৎসক। তিনি— আইসল্যান্ড কোচ হেইমির হ্যালগ্রিমসন!
অদ্ভুত সব কাহিনি ইউরোর এই রোম্যান্টিক টিমটায়। গোটা আইসল্যান্ডে যত লোক, তার চেয়ে এ বারের ইপিএল চ্যাম্পিয়ন লেস্টার সিটিতে বেশি লোক থাকে! গোটা দেশের জনসংখ্যা মাত্র তিন লক্ষ তিরিশ হাজার। বারো মাসের মধ্যে ন’মাস এমন হাড় হিম করা ঠান্ডা যে, বাড়ি থেকে বেরনো প্রায় দুঃসাধ্য। আইসল্যান্ডের জীবন থেকে ফুটবল, সব নিয়েই ওয়াকিবহাল মার্গারেট নামে এক বৃদ্ধাকে পাওয়া গেল। ইউরো দেখতে এসেছেন। শোনা গেল, বরফ-দেশের প্রত্যেক বাড়ির নীচে অফুরান গরম জল জমিয়ে রাখা হয়। নইলে তো শীতে জমে মারা যেতে হবে! ও দেশে নাকি জীবিকা নির্ধারণের তিনটে উপায় আছে। মাছ ধরা। ট্যুরিজম। আর ব্যাঙ্কিং। ব্যস! খোলা ফুটবল মাঠ— প্রকৃতির অত্যাচারে সেটাও পাওয়া যায় বছরে তিন মাস। বাকি সময় ইন্ডোর স্টেডিয়াম। এত প্রতিবন্ধকতা, তবু ইউরোপের সমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে ইউরোর মাঠে লড়ছে কী ভাবে আইসল্যান্ড?
“প্রকৃতিই শিখিয়েছে। লড়াই আমাদের ছোট থেকে মজ্জাগত,” বলছিলেন মার্গারেট। একটু থেমে ফের বললেন, “তা বলে ভাববেন না আমরা গরিব। আমাদের দেশে কিন্তু বেকার খুব কম।” স্কুল-কলেজ নাকি প্রচুর। পড়তে টাকা-পয়সাও লাগে না। আরও একটা জিনিস আছে, ফুটবল এবং গুডজনসেন। একটা সময় হ্যান্ডবলই ছিল ও দেশের প্রধান খেলা। কিন্তু গুডজনসেন বার্সেলোনা-চেলসি খেলে ফেলায়, শৈত্যপ্রদেশের মন ঘুরতে থাকে ফুটবলের দিকে।
গুডজনসেনের একটা অদ্ভুত ইতিহাসও আছে। তিনি ও তাঁর বাবা একই সঙ্গে আইসল্যান্ড টিমের হয়ে খেলেছিলেন! শোনা গেল আমাদের দেশে যেমন সিনেমায় অমিতাভ বচ্চন, আইসল্যান্ড ফুটবলে তেমন গুডজনসেন। খুদে ফুটবলারদের যিনি অনুপ্রেরণা। ওখানকার বাবা-মায়েরা নাকি বাচ্চাদের ফুটবল-ক্লাসে নিয়ে যান, গুডজনসেনকে দেখিয়ে। মনে পড়ে গেল, কলকাতা থেকে প্রসেনজিৎ আইসল্যান্ডে গিয়ে ‘হনুমান ডট কম’ ছবির শ্যুটিং করেছিলেন। ফোন করতেই বললেন, ‘‘আমি গিয়ে ওখানে ফুটবলের চর্চা দেখেছিলাম। ইন্ডোরে ফুটবল। কিন্তু সেই দেশটা যে আজ এতটা সফল হবে, ভাবিনি। অসম্ভব নিষ্ঠা না থাকলে এ হয় না।’’
তবে? এ রকম দেশকে ভাল না বেসে পারা যায়? এমন দেশকে আদর না করে থাকা সম্ভব? ফরাসি-জার্মান-বেলজিয়ান-স্প্যানিশদের এক রাতের জন্য আইসল্যান্ডবাসী হয়ে যাওয়া তাই আশ্চর্য করে না। পর্তুগাল পারেনি, ইংল্যান্ড পারল না, এ বার ফ্রান্স। পারবে? হবে? মার্গারেটরা অত উচ্চাশা করেন না।
কিন্তু হলে? পারলে?
ক্ল্যাপ, ক্ল্যাপ বুম!