Ishan Kishan

জোড়া মিল, আদর্শ ধোনির মতোই ঈশান কিষাণের রাজকীয় উত্থান

একটা সময় নিয়মিত খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত পেতেন না দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচের নায়ক।

Advertisement

সব্যসাচী বাগচী

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২১ ১৭:২৯
Share:

আদর্শ 'মাহি ভাই'কে সামনে রেখে এগোতে চাইছেন ঈশান।

ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক রাত ১টা। উত্তম মজুমদারের মুঠো ফোনটা বেজে ওঠে। স্ক্রিনে চোখ যেতেই ভেসে উঠল ‘ঈশান বেটা’। ছাত্র অভিষেক ম্যাচেই সাফল্য পেয়েছে। ফলে ওঁর ব্যাটিং নিয়ে আলোচনা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে সেটা হয়নি। বরং ফোনের দুই প্রান্ত থেকে দুজনেই অঝোরে কাঁদছিলেন। কারণ প্রশিক্ষক উত্তম মজুমদারের সদ্য প্রয়াত বাবার সঙ্গে যে ঈশান কিষাণের দাদু-নাতির সম্পর্ক ছিল। গত ৪ মার্চ দুরারোগ্য কান্সারে প্রয়াত হয়েছেন বিমল কান্তি মজুমদার।

Advertisement

নয়ডা থেকে আনন্দবাজার ডিজিটালকে উত্তম বলছিলেন, “ওর যখন ৫ বছর বয়স তখন আমার কাছে এসেছিল। তাই আমরা এক প্রকার বাপ-ছেলে হয়ে গিয়েছি। আমার বাবাও ঈশানকে খুব ভালবাসতেন। মারা যাওয়ার আগে প্রায় একমাস বাবা কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। কিন্তু সৈয়দ মুস্তাক আলি খেলার সময় ঈশান একবার ভিডিয়ো কল করতেই বাবার মুখে একগাল হাসি। সেই অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রায় ১৫ মিনিট কথা বলে বাবা ওকে আশীর্বাদ করেন। আর দেখুন ছেলেটার এমন সাফল্য ওর দাদু দেখে যেতে পারলেন না। তবে ঈশান কিন্তু আমার বাবাকে যোগ্য সম্মান দিল। এটাই বড় প্রাপ্তি।”

একটা সময় উত্তম ময়দানের টাউন, ইয়ংবেঙ্গলের মত ক্লাবে দাপিয়ে খেলেছেন। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সঙ্গে বিহার রঞ্জি দলেও ছিলেন। তবে পরিবারের চাপে খেলা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। এখন আর তিনি সেটা নিয়ে আক্ষেপ করেন না। কারণ তিনি যে ঈশানের মত এক প্রতিভাকে তুলে ধরেছেন। বললেন, “আমি তখন পাটনাতে একটা অ্যাকাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। একদিন ওর বাবা প্রণব পাণ্ডে ঈশানকে নিয়ে এল। সাধারণত ৫ বছরের ছেলেদের আমরা বেশি চাপ দিতাম না। কিন্তু ঈশান ছিল অন্য রকম। সেটা দুই দিন পরেই বুঝতে পারি। বয়সে অনেক বড় ছেলেদের বলকে অনায়াসে সামলাতে পারত। তাই রোজ অনুশীলনের শেষে ওকে ২০০ থেকে ৩০০ বল নক ডাউন করাতাম।”

Advertisement

এ ভাবেই একটা সময় প্রয়াত বিমল কান্তি মজুমদারের আশীর্বাদ নিতেন ঈশান।

সেই সময় ছেলেদের বুঝে নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে ম্যাচ খেলাতেন উত্তম। এমনই একদিন অনূর্ধ্ব-১৪ দলের ছেলেদের ম্যাচে ঈশানকে মাঠে নামিয়ে দেন তাঁর প্রশিক্ষক। আর সেখানেই ঘটল বিপত্তি। বললেন, “ঈশান কতটা ভয়ডরহীন মেজাজে খেলতে পারে সে দিন টের পেয়েছিলাম। ১৪ বছরের একটা ছেলের জোরালো বাউন্সারে ও চোট পেয়েছিল। হেলমেটের গ্রিয়ার ভেদ করে বল সজোরে নাকে লাগে। সেটা দেখার পর ওর বাবা-মা প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু গলগল করে রক্ত বেরোলেও মাঠ ছাড়েনি। যে ছেলে মাত্র ৫ বছর বয়সে এমন যন্ত্রণা সহ্য করেও ব্যাট করতে পারে, সে যে অভিষেকে খোলা মনে ব্যাট চালাবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাই আমার কাছে ঈশানের এই ইনিংস মোটেও অবিশ্বাস্য নয়।”

সংসারে অভাব ছিল না। কিন্তু পটনা শহরে ক্রিকেট পরিকাঠামো সেই সময় তেমন ভাল ছিল না। তাছাড়া তখন বিহার ক্রিকেট সংস্থা বিসিসিইয়ের অনুমোদন পায়নি। ফলে লেখাপড়ার চাপ থাকলেও স্রেফ ক্রিকেটের টানে জন্মভূমি ছেড়ে ঈশান চলে আসেন ধোনির শহর রাঁচিতে। তখন ওঁর বয়স ১২। তবে সেখানে আসার পর শুরু হল অন্য লড়াই। ঝাড়খণ্ড রঞ্জি দলে খেলার জন্য মেকন কলোনির কাছে একজনের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। যদিও সেখানে নিয়মিত খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত পেতেন না দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচের নায়ক।

পটনা থেকে প্রণব পাণ্ডে বলছিলেন, “রাঁচিতে থাকার সময় ঈশান অনেক রাত কেক, বিস্কুট, চানাচুর, ঠাণ্ডা পানীয় খেয়ে কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কোনও দিন সেই ব্যাপারে মুখ খোলেনি। যদি আমরা ওকে ফের পাটনা নিয়ে চলে যাই সেই ভয়ে। তবে একদিকে ভালই হয়েছে। সেই সময় কষ্ট করেছে বলেই তো মনের জোর বেড়েছে। ওর ছয়গুলো দেখলে মনে হয় বিপক্ষের বোলার নয়, ঈশান যেন আমার সেই আত্মীয়র দিকে ব্যাট ঘোরাচ্ছে!”

ছোটবেলার প্রশিক্ষক উত্তম মজুমদারের সঙ্গে ঝাড়খণ্ড অধিনায়ক।

মাত্র ১৫ বছরে ধোনির রাজ্য দলের হয়ে অভিষেক। এরপর রাহুল দ্রাবিড়ের প্রশিক্ষণে ২০১৬ সালের বিশ্বকাপ অভিযানে অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের অধিনায়ক হয়ে যাওয়া। সব কিছুই দারুণ এগোচ্ছিল। কিন্তু দল বাংলাদেশ উড়ে যাওয়ার আগের দিন পটনার জনবহুল রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে এক রিক্সা চালককে ধাক্কা দেন ঈশান। এরপর কয়েক জনের সঙ্গে হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়েন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারও করে। প্রণব পাণ্ডে সেই ঘটনার জন্য আজও দুঃখিত। কোনও রাখঢাক না করেই বলছেন, “সেই ঘটনার পর ঈশান অনেক শান্ত হয়েছে। কম বয়সে সাফল্য পেয়ে যাওয়ায় হয়তো অহং বোধ বেড়ে গিয়েছিল। তাই সেই দুর্ঘটনা ছিল ঈশানের কাছে চরম শিক্ষা।”

ধোনি ও ঈশান, রাঁচির দুই কৃতীর মধ্যে বেশ মিল। ২০০৫ সালের কথা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধোনিকে তিন নম্বরে নামিয়ে দেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বাকিটা ইতিহাস। ১৬ বছর পর ঈশান কিষাণকে তাঁর অভিষেক ম্যাচেই ওপেন করিয়ে দিলেন বিরাট কোহলী। এ বার নতুন ইতিহাস রচিত হল। দুই মায়ের মধ্যেও রয়েছে একটি মিল। ধোনির মা দেবিকা দেবী ছেলের খেলা দেখেন না। সেই সময় ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেন। ঈশানের মা সুচিত্রা সিংহ সেই একই সংস্কারে বিশ্বাসী।

এই মিলগুলোকে সঙ্গে নিয়েই আরও পথচলার স্বপ্ন দেখছেন ঈশান কিষাণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন