শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। যুবভারতীতে আটলেটিকোর অনুশীলন। যুবভারতীতে ঢুকছেন এটিকে কোচ হাবাস। ছবি: উৎপল সরকার, শঙ্কর নাগ দাস
আন্তোনিও হাবাসকে দেখে কে বলবে, লোকটা এখন কার্যত ‘নেই’ রাজ্যের বাসিন্দা!
গত বার শেষ হার্ডলে যে টিমটার কাছে তীব্র চাপে পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও হঠাৎ-ই এক অবিশ্বাস্য গোলে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিয়েছিল কলকাতা, তাদের সঙ্গেই আবার ম্যাচ।
অথচ কলকাতার স্প্যানিশ কোচের হাতে নেই অন্তত চার-পাঁচটা ব্রহ্মাস্ত্র। মার্কি হেল্ডার পস্টিগা চোটের জন্য এক মাস মাঠের বাইরে। অর্ণব মণ্ডল, রিনো অ্যান্টো, নাতো দেশের হয়ে খেলতে গিয়েছেন। লালকার্ড দেখে বলজিৎ সিংহ গ্যালারিতে। দলের এক নম্বর ডিফেন্ডার জোসেমি হাফ-ফিট। এই অবস্থায় আটলেটিকো দে কলকাতার কর্তারা যখন মুষড়ে আছেন, তখন চ্যাম্পিয়ন কোচ কিন্তু একেবারেই নির্লিপ্ত। সচিন তেন্ডুলকরের টিমের বিরুদ্ধে খেলতে নামার আগে হাবাসের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে, ‘‘আমার টিমে কিন্তু ২৬জন ফুটবলার। কাল হয়তো দেখবেন যারা একটা ম্যাচও খেলেনি, তারাই খেলে দেবে। আমি টিম গেমে বিশ্বাসী। কাউকে পাচ্ছি না বলে কাঁদব, এ রকম লোক নই।’’
দেবীপক্ষ শুরুর সন্ধ্যায় হাবাস যখন স্টেডিয়াম থেকে টিম নিয়ে বেরোচ্ছেন, তখন কেরল ব্লাস্টার্সের টিম বাস যুবভারতীর প্রধান গেটের সামনে। কেরল কোচ পিটার টেলর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুভেচ্ছার করমর্দনের জন্য হাত বাড়ালেন হাবাসের দিকে। কলকাতা কোচ মুখ ঘুরিয়ে এমন একটা ভান করলেন যেন দেখতেই পাননি। পাল্টা হাত তাই এগিয়ে আসেনি কেরল-কোচের দিকে। গলায় সাদা তোয়ালে জড়িয়ে দ্রুত নিজের গাড়িতে উঠে পড়লেন হাবাস। কোচকে লুকিয়ে অবশ্য সেলফি তুলতে দেখা গেল আরাতা-ইশফাকদের। যাঁরা হাবাসকে একটুও চেনেন তাঁরা বুঝতে পারবেন, এই দৃশ্যটা তাঁর কোচ দেখলে আরাতা টিম হোটেলে গিয়ে কী রকম তোপের মুখে পড়তেন! টিমের সঙ্গে থাকা এক কর্তা বলছিলেন, ‘‘হাবাস এমন একটা লোক যিনি জেতার জন্য সব কিছু করতে পারেন।’’
ঘরের মাঠে টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ। শারদ উৎসবের তীব্র আবহের মধ্যেও ম্যাচ নিয়ে আগ্রহ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। তার উপর গ্যালারিতে থাকবেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সচিন তেন্ডুলকর, পেলের মতো সেলিব্রিটিরা। প্রথমে জানা গিয়েছিল সচিন আসছেন না। আটলেটিকো কলকাতার কর্তারা সোমবার রাতে দাবি করলেন, সচিন কলম্বোতে থাকলেও স্পনসরদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে তাঁর জন্য ভিভিআইপি-তে বিশেষ সিট রাখার। তারকাদের উপস্থিতির সঙ্গে ঢাক, বাংলা ব্যান্ড, বাজি, ক্যুইজ— এ সব তো রয়েছেই। বলিউড বা টলিউডের কে কে আসবেন, তা অবশ্য জানেন না কেউই। কিন্তু এ সব নিয়ে সামান্যতম আগ্রহ নেই হাবাসের। যুবভারতীর নতুন ঘাসের মাঠে প্রথমবার অনুশীলনের সময় কলকাতার কোচকে দেখে মনে হচ্ছিল, কোনও স্কুলের রাগী চেহারার কঠোর হেডমাস্টার। সেটপিসের নানা স্ট্র্যাটেজি তৈরির সময় তাঁর ধমকে তটস্থ পুরো টিম। হিউম থেকে বোরহা, ক্লিফোর্ড থেকে মোহনরাজ— কেউই বাদ গেলেন না কড়া চোখের চাহনি থেকে। ভুল হলেই চিৎকার ভেসে আসছিল। অনুশীলন থামিয়ে ধমক চলছিল।
কেরল ৩-৫-২ স্ট্র্যাটেজিতে খেলবে ধরে নিয়েই বোরহাদের ঘণ্টাখানেক অনুশীলন চলল এ দিন। হিউম আর আরাতাকে সামনে রেখে পাল্টা আক্রমণের স্ট্র্যাটেজি থেকে গোল তুলে নেওয়ার অঙ্ক। হাবাসের দাদাগিরি আরও টের পাওয়া গেল সাংবাদিক সম্মেলনে। ‘‘চেন্নাইয়ান, গোয়া এবং কেরল— গত বার তিনটি টিমই ভাল ছিল। দু’টো খেলে ফেললাম। ছেলেরা ভালই খেলেছে। আর একটা খেলব। আমার কোনও চাপ নেই,’’ সটান বলে দিয়েছেন নবিদের কোচ। শরীরী ভাষাতেও হাবাসের আত্মবিশ্বাস চুঁইয়ে পড়ছে। কাঁধ ঝাঁকাচ্ছেন। রেফারিকে ভয় পাচ্ছেন কি না, এই প্রশ্নে হেসে ফেলছেন। বলছেন, ‘‘কী আর বলব, আমার কিছু বলার নেই।’’ চব্বিশ ঘণ্টা আগেই শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির জরিমানার কবলে পড়েছেন। ফলে সতর্ক। রেফারির বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকলেও তাই এ দিন ক্ষোভ উজাড় করে দেননি ঠিক, তবে অন্য একটা ঝামেলায় সম্ভবত জড়াতে চলেছেন তিনি। ম্যাচ কমিশনারের নির্দেশ ছিল, মাঠের দুই প্রান্তের দুই বক্সের মধ্যে অনুশীলন করা যাবে না। কিন্তু রীতিমতো ঝগড়া করে তিরি-ডেঞ্জিলদের সেখানেই কর্নার-ফ্রিকিক অনুশীলন করিয়েছেন তিনি। যা নিয়ম ভঙ্গের পর্যায়ে পড়ে বলে মনে করছেন সংগঠকরা।
কলকাতার মতো কেরলও দু’ম্যাচে চার পয়েন্ট নিয়ে খেলতে এসেছে যুবভারতীতে। কিন্তু গত বার মেহতাব হোসেনদের সেরা অস্ত্র ছিলেন যিনি, সেই ইয়ান হিউমই তো এ বার উল্টো দিকে। পস্টিগার অবর্তমানে তিনিই কলকাতার এক নম্বর ভরসা এখন। পুরনো টিমের বিরুদ্ধে কানাডিয়ান তারকার কোনও স্পেশ্যাল মোটিভেশন আছে কি না, জানতে চাওয়া হয়েছিল টিম বাসে ওঠার আগে। হিউম মচকালেন, কিন্তু ভাঙলেন না। বললেন, ‘‘না, না সে রকম কিছু নেই আমার।’’ কিন্তু পরে তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আসল সত্যি, ‘‘টিমের এই অবস্থা, গোল করাটা তো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সবাইকেই বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে ম্যাচ জিততে হলে।’’
হিউম কত ভয়ঙ্কর হতে পারেন, সেটা জানে পুরো কেরল টিম। চিফ কোচ পিটার টেলর নতুন এসেছেন। সে জন্যই হিউমের প্রসঙ্গ উঠলে তিনি মাইক এগিয়ে দিলেন সহকারি ট্রেভর মর্গ্যানের দিকে। ‘‘কলকাতা যথেষ্ট ভাল দল। ম্যাচটা কঠিন হবে। এই ম্যাচ নিয়ে আমরা আলাদা গেম প্ল্যান তৈরি করছি।’’ ইস্টবেঙ্গলে কোচিং করিয়ে যাওয়া ব্রিটিশ কোচ কখনও বিপক্ষের কোনও ফুটবলারকে আলাদা গুরুত্ব দিতে চান না। হিউমকে নিয়েও সেটা দেননি। তবে সপাট বলে দিয়েছেন, ‘‘এটুকু বলছি, কেরলকে ভাঙা অত সহজ নয়।’’
কলকাতা টিমে যত বঙ্গসন্তান রয়েছেন, তার চেয়ে বেশি বাংলার ফুটবলার রয়েছেন কেরল টিমে। মেহতাব হোসেন, সৌমিক দে, শিল্টন পাল এবং সন্দীপ নন্দী। এটা বাড়তি সুবিধা সচিনের টিমের। তবে কলকাতার মতো তাঁদের মার্কি ফুটবলার স্প্যানিশ কার্লোস মারচেনা চোটের জন্য সম্ভবত আজ খেলতে পারছেন না। তাদেরও দুই ফুটবলার সন্দেশ ঝিঙ্গন, কেভিন লোবোও দেশের হয়ে খেলতে মাস্কটে।
এমনিতে এ বার আইএসএলের ম্যাচ তেমন উঁচু মানের হচ্ছে না। তার উপর যুবভারতীর নতুন ঘাসের মাঠে একদিন অনুশীলনের পর উঠে যাচ্ছে মাটি। হাবাস এখনও তোপ দাগেননি। তবে এ দিন বলেছেন, ‘‘মাঠটা মোটামুটি। শক্ত। জল দিতে হবে।’’
যা পরিস্থিতি তাতে মঙ্গলবার ধুন্ধুমার ব্রিটিশ বনাম স্প্যানিশ কোচের যুদ্ধে বড় ফ্যাক্টর হতে পারে মাঠ।