পাঁচ অধিনায়ককে গড়াপেটার প্রস্তাব, জেনেছে আইসিসি

দীর্ঘদিন ধরে নজরে রাখো। তার পর বেছে নাও ‘সফট টার্গেট।’ মানে যাকে বলে সহজ শিকার।নজর রাখতে হবে জাতীয় দলের অধিনায়কদের ওপর। কারণ একবার অধিনায়কদের হাত করতে পারলেই কাজ সহজ হয়ে যাবে।বিশ্ব জুড়ে এখন নানা টি-টোয়েন্টি, টি-টেন লিগ গজিয়ে উঠেছে। জাল ফেলতে হবে এখানে। তার পর শিকার উঠতে আর কত সময়ই বা লাগবে।

Advertisement

কৌশিক দাশ

দুবাই শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৪৪
Share:

নজরদারী: গড়াপেটা আটকাতে কড়া পদক্ষেপ রিচার্ডসনের। এএফপি

দীর্ঘদিন ধরে নজরে রাখো। তার পর বেছে নাও ‘সফট টার্গেট।’ মানে যাকে বলে সহজ শিকার।নজর রাখতে হবে জাতীয় দলের অধিনায়কদের ওপর। কারণ একবার অধিনায়কদের হাত করতে পারলেই কাজ সহজ হয়ে যাবে।বিশ্ব জুড়ে এখন নানা টি-টোয়েন্টি, টি-টেন লিগ গজিয়ে উঠেছে। জাল ফেলতে হবে এখানে। তার পর শিকার উঠতে আর কত সময়ই বা লাগবে।

Advertisement

এই হল ক্রিকেট জুয়াড়িদের ‘মোডাস অপারেন্ডি’। সোজা ভাষায় কাজ করার পদ্ধতি। ক্রিকেটের দুনিয়ায় এ ভাবেই জাল বিছিয়ে চলেছে তারা। ক্রিকেট থেকে ম্যাচ গড়াপেটার কালো ছায়া অনেকটাই সরে গিয়েছে ভাবলে ভীষণ ভুল হবে। একটা রাস্তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দেখে জুয়াড়ি এবং অন্ধকার জগতের লোকজন বেছে নিচ্ছে অন্য কোনও রাস্তা। কিন্তু লক্ষ্য একই। ক্রিকেট ম্যাচকে নিজেদের নির্দেশে চালাব। কখন কী হবে, আগে থেকে ঠিক করে দেব। এবং, লুটে নেব কোটি কোটি টাকা।

স্বাগত ক্রিকেট জুয়ার অন্ধকার দুনিয়ায়। যেখানে ব্যাট-বলের লড়াইয়ের ভাগ্য ঠিক করে দিচ্ছে মাঠের বাইরে বসে থাকা কোনও অবয়বহীন লোক।

Advertisement

চমকে দেওয়া এই সব তথ্য উঠে এসেছে গত এক বছর ধরে চলা আইসিসি-র তদন্তে। যার মধ্যে সব চেয়ে বড় চমক হল, গত এক বছরে পাঁচ জন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অধিনায়ককে ম্যাচ গড়াপেটার প্রস্তাব দিয়েছিল জুয়াড়িরা। যার মধ্যে চার অধিনায়ক টেস্ট খেলিয়ে দেশের। এক জন শুধু অ্যাসোসিয়েট দেশের। সোমবার দুবাইয়ে আইসিসির সদর দফতর থেকে পাওয়া গেল এ সব তথ্য।

ব্রিটিশ পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এই কর্তা অ্যালেক্স মার্শাল গত বছর দায়িত্ব নিয়েছিলেন আইসিসির দুর্নীতি দমন শাখার। এই এক বছরে তাঁর চালানো তদন্তেই উঠে এসেছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ঘটনা হল, এই সব তথ্য উদঘাটন হলেও আইসিসি কিন্তু নিজেদের থেকে এখনও কোনও ম্যাচ গড়াপেটার ঘটনা ধরতে পারেনি। প্রচারমাধ্যমের নানা গোপন ক্যামেরা অভিযান থেকে যে সব ঘটনা উঠে এসেছে, তারই তদন্ত চালিয়েছে। আইসিসি এও জানায়নি, যারা প্রস্তাব পেয়েও মুখ খোলেননি, তাঁদের কী ভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: পাকিস্তানকে ভিতু ভিতু দেখাচ্ছে, মত আক্রমের

কেন জুয়াড়িরা অধিনায়কদের বিশেষ করে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে? আইসিসির কাছে একটা ব্যাখ্যা আছে। জুয়াড়িরা ভাল মতোই জানে, এক জন অধিনায়ককে হাত করতে পারা মানে দলের অনেক খবর হাতে চলে আসা। যেমন, দল কী হবে। টস করলে ব্যাট নেওয়া হবে না বল। ব্যাটিং অর্ডার বা বোলিং পরিবর্তন করার ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করা যায়। সব চেয়ে সুবিধার হল, এগারো জন ক্রিকেটারকে ধরার চেয়ে এক জন অধিনায়ককে ধরতে পারলে জুয়াড়িদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়।

তাই এখন ফিক্সারদের কাজটাই হল, অধিনায়কদের ওপর নজর রেখে খুঁজে বার করা কাকে টোপ দেওয়া যায়। অধিনায়কদের নাম না বললেও গত বছর পাক অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ সরকারি বিবৃতি দিয়েছেন, শ্রীলঙ্কা সিরিজে তাঁর কাছে জুয়াড়িদের প্রস্তাব এসেছিল এবং তিনি সেটা আইসিসিকে জানিয়ে দেন। একই সঙ্গে

আরও একটা কথা জানা যাচ্ছে আইসিসি দফতর থেকে। জুয়াড়িদের এখন বিশেষ করে নজর পড়েছে বিশ্বের চার দিকে গজিয়ে ওঠা নানা টি-টোয়েন্টি, টি-টেন লিগের ওপরে। যেখানে ম্যাচ গড়াপেটা হওয়ার আশঙ্কা একটু বেশিই থাকে। আইসিসি চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার ডেভিড রিচার্ডসন বলেছেন, ‘‘আমরা টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর ওপর জোর দিচ্ছি। চার দিকে এখন প্রচুর টি-টোয়েন্টি লিগ হচ্ছে। যেখানে আমরা নজর রাখছি। এর ফলে অ্যালেক্সের কাজটা আরও

বেড়ে গেল।’’

এরই মধ্যে আবার আফগানিস্তানের মহম্মদ শেহজাদের কাছে আফগানিস্তান প্রিমিয়ার লিগে গড়াপেটা করার প্রস্তাব এসেছিল। তা নিয়ে এ দিন সরকারি রিপোর্ট হয়েছে।

আইসিসি-র তদন্তে আরও অনেক তথ্য উঠে এসেছে। যেমন, ক্রিকেট জুয়াড়ি এবং ফিক্সারদের মধ্যে অনেকেই ভারতীয়। এদের কাজটা চলে পুরো বিশ্বজুড়ে। এর মধ্যে কিছু দিন আগেই এক চ্যানেলের গোপন ক্যামেরা অভিযানে উঠে এসেছে অনিল মুনওয়ারের নাম। যাঁকে এখন খুঁজে চলেছে আইসিসি। কিন্তু এখনও কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। আইসিসি কর্তাদের ধারণা, ওই নামটা সম্ভবত ভুঁয়ো। মুনওয়ারের ছবিও দেখানো হয়েছে। আবেদন করা হয়েছে, এই চেহারার লোকের হদিশ পেলে দুর্নীতি দমন শাখাকে জানাতে।

মার্শাল এবং রিচার্ডসন জানাচ্ছেন, গত এক বছরে আইসিসি ৩২টা ঘটনার তদন্ত করে দেখেছে। দেখা গিয়েছে, আটটি ঘটনায় ক্রিকেটারদের নাম উঠে এসেছে। তিনটি ক্ষেত্রে শাস্তি পেয়েছেন ক্রিকেটাররা। আইসিসি কোনও নাম জানায়নি। কিন্তু এই প্রসঙ্গে একটা ছোট্ট তথ্য দেওয়াই যায়। গত বছরই পাকিস্তান সুপার লিগে স্পট ফিক্সিং কাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে দশ বছরের জন্য নির্বাসিত হয়েছেন সে দেশের প্রাক্তন ওপেনার নাসির জামশেদ।

আইসিসি কর্তারা আরও জানাচ্ছেন, যখনই কোনও ম্যাচে এক তরফা খেলা হয়, বিশেষ করে রবিবারের ভারত-পাকিস্তানের মতো ম্যাচ হলে, তখনই গড়াপেটার অভিযোগ জানিয়ে ফোন আসতে শুরু করে। রিচার্ডসন বলছেন, ‘‘উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ হাতে না পেলে অবশ্যই আমরা কিছু করি না।’’

তবে অভিযোগকারীদের নিরুৎসাহও করতে চায় না আইসিসি। যে কারণে নতুন একটি ‘মোবাইল অ্যাপ’ তারা আনছে, যেখানে ক্রিকেট নিয়ে কোনও সন্দেহজনক ঘটনা দেখলে সাধারণ মানুষ অভিযোগ জানাতে পারবেন। অভিযোগকারীদের নাম অবশ্যই গোপন রাখা হবে।

ঘটনা হল, আইসিসি নানা ভাবে দেখাতে চাইছে দুর্নীতি দমনের জন্য লড়ছে তারা। কিন্তু অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। যে সব উত্তর না পাওয়া গেলে ছবিটা কখনও পরিষ্কার হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন