বিধ্বংসী: ইংল্যান্ডের কিটন জেনিংসকে আউট করার পরে বুমরা। ছবি: এপি।
প্রশ্ন: যশপ্রীত বুমরাকে খুঁজে বার করার কাহিনিটা শুনতে চাই।
জন রাইট: ওকে আমি প্রথম দেখি ভারতের একটা ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে। আমদাবাদে খেলা হচ্ছিল। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের হয়ে নতুন প্রতিভা খুঁজতে করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, একটা ছেলে অস্বাভাবিক বোলিং অ্যাকশনে দারুণ ইয়র্কার করছে। বেশ দ্রুতগতিতে বল করছে। অনেকগুলো ইয়র্কার করল। বিশেষ করে একটা বলের কথা এখনও আমার মনে আছে। পিচে তৈরি ক্ষতের উপরে পড়ে বলটা পার্থিব পটেলের মাথার উপর দিয়ে চার বাই রান হয়ে গেল। আমরা এর-ওর মুখ চাওয়াচায়ি করলাম। একটাই কথা বেরিয়ে এসেছিল, ‘ওয়াও, দ্যাট লুকস ভেরি ভেরি ইন্টারেস্টিং’!
প্র: আপনি তখন আইপিএলে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কোচ?
রাইট: সে বারই আমি মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে যোগ দিলাম। ২০১৩ সাল। সেই আমদাবাদ যাত্রার আগে আমরা ঠিক করেছিলাম, দু’সপ্তাহ পরেই মুম্বইতে ট্রায়াল ক্যাম্প করব। সেখান থেকে নতুন ছেলেদের নেওয়া হবে। তার আগে ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হচ্ছে বলে আমরা কিছু ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলাম। যদি সেখানে নতুন কোনও মুখ খুঁজে পাওয়া যায়।
প্র: ইয়র্কার করতে থাকা ছেলেটাকে দেখার পরে কী ঘটল?
রাইট: ম্যাচের শেষে আমি পার্থিবের সঙ্গে কথা বলতে যাই। পার্থিবকে আমি চিনতাম। ভারতীয় দলের কোচ থাকার সময়ে পার্থিব খেলেছে। ওর উপরে আমার আস্থা ছিল। ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এই ছেলেটা কে? পার্থিব বলল, ওর নাম যশপ্রীত বুমরা। তখন ওর বয়স ১৮ বা ১৯ হবে। পার্থিব আমাকে বুমরার সম্পর্কে দারুণ সার্টিফিকেট দিল। বলল, ও দারুণ প্রতিভাবান।
প্র: তার পর?
রাইট: আমার সঙ্গে রাহুল সঙ্ঘবি ছিল (মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের সহকারী কোচ)। রাহুলকে আমি তখনই বলি, এই ছেলেটাকে সই করাতে পারি আমরা। রাহুল একমত হল এবং তৎক্ষণাৎ যোগাযোগ করল মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে। সে দিনই সন্ধেবেলায় মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে সই করানো হল যশপ্রীত বুমরাকে।
প্র: সেই সন্ধেতেই! এ রকম তো ফুটবলে শোনা যায়। লিয়োনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোদের ক্ষেত্রে হয়েছে। এ রকম স্কাউটিং কাহিনি ভারতীয় ক্রিকেটেও আছে?
রাইট (হাসি): হ্যাঁ, আছে। আমরা দেরি করিনি। কেউ খুঁজে পাওয়ার আগে আমরা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম, এই নতুন বিস্ময় প্রতিভা যেন মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের ঘরে থাকে। তখনও সব ক্রিকেটারকে নিলাম থেকে কেনার নিয়ম আসেনি আইপিএলে। নতুন মুখদের এ ভাবেই নিলামের বাইরে থেকে সই করানো যেত। সে বছরই আইপিএলে বুমরা প্রথম ম্যাচেই খেলেছিল। বেঙ্গালুরুতে প্রথম ম্যাচে ওর প্রথম শিকার ছিল কে জানেন তো? বিরাট কোহালি!
প্র: আপনি ইংল্যান্ডে। বুমরাও ইংল্যান্ডে। কথা হয়েছে ওঁর সঙ্গে?
রাইট: গত কালই (বুধবার) কথা হল। আমিই ফোন করেছিলাম। বললাম, দারুণ বোলিং করছ। চালিয়ে যাও, আরও সফল হও। ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে সাফল্যের জন্য অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছিলাম।
প্র: শুনে বুমরা কী বললেন?
রাইট: খুব খুশি হয়েছিল ফোন পেয়ে। বার বার বলতে থাকল, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে আমরা দারুণ সময় কাটিয়েছি। সেই সময়ে ওকে শুধু সাদা বলের বোলারই বলা হত। কিন্তু এখন লাল বলে টেস্ট ক্রিকেটেও দারুণ সফল বুমরা। খুব ভাল একটা ছেলে তার পরিশ্রমের সুফল পাচ্ছে। আমি খুব খুশি
প্র: প্রথম সেই দেখার দিনে ফিরে যাই আর এক বার। সব চেয়ে বেশি করে বুমরার কোন ব্যাপারটা আপনাকে আকৃষ্ট করেছিল?
রাইট: প্রথম চোখে পড়েছিল ওর অন্য রকম বোলিং অ্যাকশন। এবং বলের গতি। ১৮ বছরের ছেলের হাতে ও রকম পেস আমি তখনও খুব একটা দেখিনি ভারতে। সব মিলিয়ে বার বার মনে হচ্ছিল যেন অন্য রকম, বিরল এক বোলারকে দেখছি। যাকে চট করে কেউ ধরতে পারবে না।
প্র: পাঁচ বছর পরে সেই একই অবস্থা। ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানরাও কেউ বুমরাকে ধরতে পারছেন না!
রাইট: একটা কাহিনি শোনাই। ২০১৩-তে বুমরাকে আমদাবাদ থেকে নিয়ে আসার পরে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের প্রথম প্র্যাক্টিস সেশন। সেখানে সকলেই ছিল। সচিনও এসেছিল। আমার মনে আছে, নেটে ব্যাট করার পরে সচিন এসে আমাকে বলেছিল, বুমরাকে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে! আমি ভাবলাম, নট ব্যাড। বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানের যদি বুঝতে সমস্যা হয়, তা হলে সেটা আমাদের জন্য ভাল সঙ্কেত।
প্র: এখনকার বুমরা সম্পর্কে কী বলবেন? কতটা পরিবর্তন দেখছেন?
রাইট: এখন অনেক শক্তিশালী, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী বোলার হয়ে উঠেছে। এই সিরিজে ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট ওকে সঠিক লাইন-লেংথে বল করাচ্ছে। পিচে যদি ক্ষত তৈরি হয়, তা হলে কিন্তু ও খেলার অসাধ্য হয়ে উঠতে পারে।
প্র: ইতিহাস পাল্টে দিয়ে ভারতীয় বোলিং আক্রমণের স্পিন থেকে গতি-নির্ভর হয়ে ওঠা নিয়ে কী বলবেন?
রাইট: অসাধারণ! সব চেয়ে চোখে পড়ার মতো হচ্ছে, বেঞ্চ স্ট্রেংথ। প্রথম দলে চার জন এক্সপ্রেস গতির বোলার তো রয়েইছে। সঙ্গে রিজার্ভ বেঞ্চে অপেক্ষা করছে আরও চার-পাঁচ জন।
প্র: আপনার সময় থেকে কতটা পাল্টেছে ভারতীয় দল?
রাইট: আমার সময়ে দুই স্পিনার ছিল কুম্বলে আর হরভজন। দু’জনেই খুব ভাল স্পিনার। তবে আমাদের সময়েও পেস আক্রমণ খারাপ ছিল না। শ্রীনাথ, জাহির, নেহরা আর আগরকর। এর মধ্যে শ্রীনাথ আর আগরকর বেশ জোরেই বল করত। জাহির আর নেহরা মূলত সুইং বোলার ছিল কিন্তু দু’জনেরই ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা ছিল।
প্র: পেস বোলিংয়ে কোথায় পার্থক্য চোখে পড়ছে?
রাইট: আমার মনে হয়, ফিটনেস এবং শক্তি বাড়ানোর যে ট্রেনিং এখন ভারতীয় ক্রিকেট সিস্টেমে এসে গিয়েছে, তাতেই অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ফাস্ট বোলার হতে গেলে শক্তিশালী এবং ফিট হতে হবে। এখন ঘরোয়া ক্রিকেটের সব দলে ‘স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং’ ব্যাপারটা এসে গিয়েছে। ভারতের সব রাজ্য দলে এখন একাধিক ফাস্ট বোলার দেখা যাবে। আমি কোচ থাকার সময়ে শেষের দিকে জিমে যাওয়ার প্রথা শুরু হয়। কেউ যেত, কেউ যেত না। কিন্তু জিম এখন ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
প্র: এই সিরিজ নিয়ে আপনার পূর্বাভাস কী?
রাইট: ট্রেন্ট ব্রিজে দারুণ জিতেছে ভারত। খুব লড়াকু জয়। ভারতীয় দলের কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে, মানুষ এই লড়াইটা দেখতে চায়। ট্রেন্ট ব্রিজে সেই লড়াইটা দেখিয়েছে ভারত। আমি চাই, চতুর্থ টেস্টটাও ভারত জিতুক আর ওভালে ফয়সালার টেস্ট হোক। আহা, কী দারুণ সিরিজ হবে! তা হলে আমিও যেতে চাই ওভালে!