আবার চ্যাম্পিয়নের মেজাজ। শুক্রবার সতীর্থদের নিয়ে কোহালি। -শঙ্কর নাগ দাস
ভারত: ৪৫৫
ইংল্যান্ড: ১০৩-৫
কখন যে দুই আম্পায়ার নেমে পড়েছেন নতুন ইনিংস শুরু করাতে, বুঝতেই পারেননি অনিল কুম্বলে আর তাঁর তিন স্পিনার!
এক মনে কুম্বলে প্র্যাকটিস দিয়ে যাচ্ছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন, রবীন্দ্র জাডেজা, জয়ন্ত যাদবকে। তাঁরাও মন দিয়ে ঝালিয়ে নিচ্ছিলেন যে যাঁর স্কিল। একটু পরেই যে ইংল্যান্ড ব্যাটিং বধে নামতে হবে।
ছবিটা প্রতীকী মনে হতে পারে। বিরাটের ডাবল হান্ড্রেড হয়নি। তার শোধ তুলব স্পিন দিয়ে, আক্ষেপের ক্ষতে প্রলেপ দেব রবিচন্দ্রন অশ্বিন মন্ত্রে। দিলও ভারত। দিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। সঙ্গে কোহালির নতুন ফাটকা জয়ন্ত যাদব। দিনের শেষে ড্রেসিংরুম অভিমুখী ভারত অধিনায়কের মুখে যে হাসিটা দেখা গেল, তা যেন একটু দূরের রামকৃষ্ণ বিচের মতো প্রাণোচ্ছ্বল। কে বলবে, কয়েক ঘণ্টা আগেই এক স্বপ্নের উড়ান ধরার আশা জাগিয়েও ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি?
অ্যালিস্টার কুকরা ব্যাট করতে নামার আগে আম্পায়ারদের নামতে দেখে কুম্বলে দৌড় মারলেন প্যাভিলিয়নের দিকে। যাওয়ার সময় ভারতের চিফ কোচ কী যেন বলে গেলেন অশ্বিনদের। সাফল্যের মন্ত্রটা আর একবার মনে করিয়ে দিলেন কি? কে জানে।
যদিও সেই মন্ত্র অবশ্য তার একটু আগেই মনে করিয়ে দিয়ে গিয়েছেন মইন আলি নামক শত্রু শিবিরের এক জন! আজ সকালে যিনি ভারতের হৃদয় ভেঙে কোহালিকে ১৬৭-তে আটকে দিয়ে অশ্বিনদের জন্য যেন আগাম খুশির বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন, এ বার তোমাদের সময়ও আসছে। বাইশ গজে ঘূর্ণি ধরছে!
আর সেই ঘূর্ণির ঝড় তুলে ইংল্যান্ডের দফারফা শুরু করে দিল ভারত। টিম কোহালির সাড়ে চারশোর উপর রানের জবাবে দিনের শেষে ইংল্যান্ড কোণঠাসা। একশো পেরোতেই অর্ধেক ইনিংস খতম। কুক, রুট, হামিদ, মইন, প্যাভিলিয়নে ফেরত চলে যাওয়ার পরে ভরসা বলতে স্টোকস, বেয়ারস্টো, ব্রডরা। ভারত যে এই টেস্টে হারছে না আর ইংল্যান্ডের যে জয়ের মুখ দেখার সম্ভাবনা ক্ষীণ— বিশাখাপত্তনমের প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় দিনই তার ইঙ্গিত দিয়ে রাখল। আর সে ক্ষেত্রে তো আর একটা সম্ভাব্য রেজাল্টই বাকি থাকে। ভারতের জয়। সিরিজে এগিয়ে যাওয়া।
ইংল্যান্ড ইনিংসের শুরুতে মহম্মদ শামির তীব্র গতির বল অ্যালিস্টার কুকের স্টাম্প দু’টুকরো করে দেওয়াটা ছিল মারাত্মক। যে ডেলিভারিতে ছিল ধ্বংসের ভয়ঙ্কর ইঙ্গিত। ভেঙে যাওয়া স্টাম্পের একটা টুকরো তো শর্ট থার্ডম্যানের দিকে ছিটকে গিয়েছিল। শামির হাত থেকে বেরোনো আগুন-গোলার তীব্রতা কতটা ছিল, তা বোঝার জন্য এইটুকু তথ্যই যথেষ্ট।
অশ্বিন ব্যাট হাতে দলকে হাফসেঞ্চুরি দেওয়ার পর বল হাতে জো রুট আর বেন ডাকেটকে ফিরিয়ে কোহালির ভারতকে জয়ের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে দিলেন এ দিনই। আর আনকোরা জয়ন্ত যাদব! যিনি তাঁর প্রথম টেস্ট উইকেট পেলেন ডিআরএসের সাহায্যে। আম্পায়ার কুমার ধর্মসেনা মইন আলির যে এলবিডব্লিউর আবেদন নাকচ করে দিয়েছিলেন, তা ডিআরএস ফিরিয়ে দেওয়ার পর কোহালির সে কী বিরাট উল্লাস! ড্রেসিংরুমে ফেরা মইনের দিকে তাকিয়ে শূন্যে মুঠো ছুড়ে ভারত অধিনায়কের আস্ফালন দেখে মনে হচ্ছিল টেস্ট ম্যাচটা যেন জেতাই হয়ে গিয়েছে! তবে জয় যে দেখতে পাচ্ছেন, তা ভারত অধিনায়কের শরীরের ভাষায় স্পষ্ট। ডিআরএস-টা অবশ্য ঋদ্ধিমান সাহার উদ্যোগে নেওয়া ভারতের। উইকেটকিপার ঋদ্ধিই বিরাটকে বলেন, এই নট আউটের সিদ্ধান্তটাকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত। তাঁর পরামর্শেই রেফারেল নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কোহালি। টিম কোহালির খুঁটিনাটিতেও এখন যে কতটা গুরুত্বপূর্ণহয়ে উঠেছেন বাংলার ঋদ্ধিমান, বোঝা যায়।
তা ছাড়া জয়ন্ত যাদব নামটা এই টেস্টে বিরাটের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। জয়ন্ত এ দিন কোহালিকে সেই চ্যালেঞ্জও জিতিয়ে দেন। মইনকে আউট করলেন। তার আগে ন’নম্বরে ব্যাট করতে নেমে অমূল্য ৩৫ রান দিয়ে দলকে ৪০০-র গণ্ডি পার করালেন। আর শেষে ডিপ স্কোয়ার লেগ থেকে ঋদ্ধির গ্লাভসে অসাধারণ একটা থ্রো পাঠিয়ে তরুণ ইংরেজ ওপেনার হাসিব হামিদকে রান আউট করতে সাহায্য করলেন।
হামিদকে রান আউট করার ঘটনাটা তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো! জয়ন্তর থ্রো যখন গ্লাভস-বন্দি করেন ঋদ্ধি, তখন স্টাম্প তাঁর পিছনে। ঋদ্ধি আর ঘুরে বল স্টাম্পের দিকে ছোড়ার ঝুঁকি না নিয়ে বলটাকে ব্যাক-ফ্লিক করে স্টাম্পে লাগিয়ে দেন। বিকেলে টিভি বক্স থেকে বেরিয়ে কিরণ মোরে বলছিলেন, ‘‘যে ভাবে শরীরের ব্যালান্স রেখে বলটা পিছন দিকে ছুড়ে রান আউট করল সাহা, যে কেউ এটা করতে পারত না। তার জন্য অসম্ভব ফিটনেস চাই। সত্যি, অসাধারণ!’’
সকালের ছবিটা কিন্তু ছিল একেবারে অন্য রকম! মইন আলির ফুল লেংথ বল ফ্রন্টফুটে এসে ড্রাইভ করতে গিয়েছিলেন বিরাট। বল তাঁর ব্যাটের কানায় লেগে সোজা স্লিপে স্টোকসের হাতে জমা পড়ে। ভারত অধিনায়ক তখন ১৬৭-তে। ঠিক তার আগের বলে প্রায় একই ভাবে অশ্বিনের ব্যাটের কানা লেগে বল গিয়েছিল সেই স্টোকসের কাছেই। কিন্তু পরক্ষণেই যে প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ পেয়ে যাবেন, তা কি ভেবেছিলেন স্টোকস? আকস্মিক ক্যাচের সুযোগ এ বার আর ছাড়লেন না তিনি। স্টেডিয়ামের হাজার দশেক দর্শকের ‘কো..হা..লি, কো...হা...লি’ শব্দব্রহ্মকে নিশ্চুপ করে দিয়ে।
যা হয়নি, হয়নি। যা হয়েছে, তা-ও তো বড় কম নয়। দু’শো না হোক, ১৬৭ রানের ঝকঝকে ইনিংস তো পাওয়া গিয়েছে। এখন শুধু শেষেরটা হোক। কোহালির বেদিতে এ বার ইংরেজ-উপকূলে আরও সজোর আছড়ে পড়ুক অশ্বিনের ঘূর্ণি, মোহালির ফ্লাইট ভারত ধরুক টেস্টটা জিতে, সিরিজে এগিয়ে।
ক্যাপ্টেনের ইনিংসের প্রতি টিমের শ্রেষ্ঠ সম্মান প্রদর্শন তো তখনই হবে।
স্কোর:
ভারত প্রথম ইনিংস (আগের দিন ৩১৭-৪): কোহালি ক স্টোকস বো মইন ১৬৭, অশ্বিন ক বেয়ারস্টো বো স্টোকস ৫৮, ঋদ্ধিমান এলবিডব্লিউ মইন ৩, জাডেজা এলবিডব্লিউ মইন ০, জয়ন্ত ক অ্যান্ডারসন বো রশিদ ৩৫, উমেশ ক মইন বো রশিদ ১৩, শামি ন.আ. ৭, অতিরিক্ত ১০, মোট ৪৫৫। পতন: ৬, ২২, ২৪৮, ৩১৬, ৩৫১, ৩৬৩, ৩৬৩, ৪২৭, ৪৪০। বোলিং: অ্যান্ডারসন ২০-৩-৬২-৩, ব্রড ১৬-২-৪৯-১, স্টোকস ২০-৪-৭৩-১, আনসারি ১২-১-৪৫-০, রশিদ ৩৪.৪-২-১১০-২, মইন ২৫-১-৯৮-৩, রুট ২-০-৯-০।
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস: কুক বো শামি ২, হামিদ রান আউট ১৩, রুট ক উমেশ বো অশ্বিন ৫৩, ডাকেট বো অশ্বিন ৫, মইন এলবিডব্লিউ জয়ন্ত ১, স্টোকস ন.আ. ১২, বেয়ারস্টো ন.আ. ১২, অতিরিক্ত ৫, মোট ১০৩-৫। পতন: ৪, ৫১, ৭২, ৭৯, ৮০। বোলিং: শামি ৮-২-১৫-১, উমেশ ৬-১-১৪-০, জাডেজা ১৫-৩-৩৮-০, অশ্বিন ১৩-৫-২০-২, জয়ন্ত ৭-৩-১১-১।