কমনওয়েলথে পদক জিতে বাবাকে পরাবেন সনিয়া

প্রতিবার স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ শে‌ষ হচ্ছে আর তিনি গুণে চলেছেন, ‘‘১২, ১৩, ১৪...!’’ ১৯ বারের মাথায় তরুণী দাঁড়িয়ে পড়তেই এবারে বাবার কড়া ধমক খেতে হল।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৮ ০৩:৫৬
Share:

নজরে: বাংলা থেকে কমনওয়েলথ গেমসে যাচ্ছেন সনিয়া। নিজস্ব চিত্র

নভেম্বরের কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম। দুপুর রোদে দৌড়ে মাঠ প্রদক্ষিণ করে চলেছেন এক তরুণী। একপাশে বাঁশি হাতে দাঁড়ানো এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি। তিনি তরুণীর বাবা। প্রতিবার স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ শে‌ষ হচ্ছে আর তিনি গুণে চলেছেন, ‘‘১২, ১৩, ১৪...!’’ ১৯ বারের মাথায় তরুণী দাঁড়িয়ে পড়তেই এবারে বাবার কড়া ধমক খেতে হল।

Advertisement

কলকাতার চারুচন্দ্র কলেজের পড়ুয়া সনিয়া বৈশ্য কমনওয়েলথ গেমস-এ এবার ভারতের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছেন। ৪ এপ্রিল থেকে গেমস শুরু হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্ট-এ। সেখানে ৪x৪০০ মিটার রিলে দলে ভারতীয় দলে বাংলার প্রতিনিধি সনিয়া।

রায়গঞ্জের মেয়ে এই মুহূর্তে ভারতীয় দলের হয়ে অনুশীলন করছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখান থেকেই ফোনে জানালেন, পদক জেতার জন্য কঠোর অনুশীলেন ডুবে রয়েছেন তিনি। টেলিফোনে অস্ট্রেলিয়া থেকে বললেন, ‘‘বাবা এখানে থাকলে খুব ভাল হতো। বাবাই আমার সব চেয়ে বড় কোচ এবং সমালোচক!’’ যোগ করছেন, ‘‘এত দূর এসে খালি হাতে ফিরতে চাই না। পদক জিততেই হবে। বাবা অনেক পরিশ্রম করেছেন আমার জন্য। পদক জিতলে বাড়ি ফিরে তা বাবার গলাতেই পরিয়ে দেব।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: সৌম্যজিতের দাবি ‘ফাঁসানো হচ্ছে’, গোপন জবানবন্দি তরুণীর

রায়গঞ্জের বাড়িতে বসে মেয়ের কথা শুনে সনিয়ার বাবা বরেন্দ্রকুমার বৈশ্য বললেন, ‘‘প্রথমে ভেবেছিলাম মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। পরে দেখলাম ও দারুণ দৌড়য়। নিজে এক সময় জেলা স্তরে ফুটবল খেলেছি। তাই মেয়েকে খেলার মাঠে নিয়ে গিয়েছিলাম। দেশের হয়ে আজ ও প্রতিনিধিত্ব করছে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে। মেয়েকে বলে দিয়েছি, অস্ট্রেলিয়া থেকে পদক নিয়েই ফিরবি তুই।’’ পেশায় নির্মাণকর্মী বরেন্দ্রকুমার। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘সামান্য রোজগারেও মেয়ে যখনই দেশের মধ্যে কোথাও গিয়েছে, আমি সেখানে গিয়েছি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় আর যাওয়া হল না।’’ ধরে আসে বরেন্দ্রকুমারের গলা।

বরেন্দ্রকুমার নিজে জেলাস্তরে ফুটবল খেলেছেন। তাঁর স্বপ্ন, অভাবের মধ্যেও মেয়েকে ভারতের হয়ে এশিয়ান গেমস, অলিম্পিক্সে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখা। জানালেন, ছোটবেলা থেকেই দৌড়ে আগ্রহ সনিয়ার। স্কুলের প্রতিযোগিতায় প্রথম সোনা জয়। তারপর থেকে স্কুলের যে কোনও খেলায় দিদি তানিয়া বৈশ্যের সঙ্গে সনিয়াও নাম দিতেন। প্রথম বার সকলের নজরে পড়েন মহীশূরে জুনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে। বরেন্দ্র বলছেন, ‘‘চেন্নাইয়ের জাতীয় ওপেন অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিনশিপ, সিনিয়র জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ— সব প্রতিযোগিতাতেই দারুণ ফল করতে শুরু করে সনিয়া। তার পরেই ডাক আসে জাতীয় শিবির থেকে।’’

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় সাফল্য, চলতি বছরে জাকার্তায় আমন্ত্রণমূলক এশিয়ান গেমসে। সেখানে ৪০০ মিটার দৌড়ে সোনা জয়ের পর ২২তম ফেডারেশন কাপেও প্রথম ছয়ের মধ্যে ছিলেন সনিয়া। গত ১২ মার্চ মেয়েকে অস্ট্রেলিয়ার বিমানে তুলে দিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা শুনিয়ে সনিয়ার মা মমতা বললেন, ‘‘আমরা সবাই প্রার্থনা করছি, সনিয়া যেন দেশকে পদক দিতে পারে। তা হলেই মূল্য পাবে আমার মেয়েকে নিয়ে স্বামীর পরিশ্রম।’’

অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে পড়াশোনাও সমান তালে চালিয়ে যাচ্ছেন সনিয়া। তাঁর মা জানালেন, স্কুলের পাঠ চুকিয়ে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের প্রস্তুতি নিতে কিছু দিন শিলিগুড়িতে ছিলেন সনিয়া। সেই সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামে মেয়েকে অনুশীলন করাতেন তাঁর বাবা। পরে সনিয়া কলকাতায় এসে পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হন চারুচন্দ্র কলেজে। এখন আর মেয়েকে ডাক্তার হওয়ার জন্য বলেন না মমতাদেবী। বললেন, ‘‘ওর খেলা আমি দেখেছি। প্রথমে মেয়ে হিসাবে ভয় লাগত। পারবে তো? এখন জানি, দৌড় ওঁর জীবন। পারবেই। পারতেই হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন