রূপকথার নায়ক স্থানীয় প্রতিভারা

বছর দশেক আগে স্টেডিয়াম তো দূরের কথা ফুটবল খেলার উপযুক্ত মাঠই ছিল না আইজলে। অসম রাইফেলস-এর ব্যারাকে মাঠ থাকলেও সেখানে সাধারণের প্রবেশ ছিল নিষেধ। পাহাড়ের কোলে পাথুরে জমিতেই চলত খেলা। আর এখন— আইজল এফসি-ই ভারতীয় ফুটবলের শাসক।

Advertisement

শুভজিৎ মজুমদার

আইজল শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০৩:৩৫
Share:

বছর দশেক আগে স্টেডিয়াম তো দূরের কথা ফুটবল খেলার উপযুক্ত মাঠই ছিল না আইজলে। অসম রাইফেলস-এর ব্যারাকে মাঠ থাকলেও সেখানে সাধারণের প্রবেশ ছিল নিষেধ। পাহাড়ের কোলে পাথুরে জমিতেই চলত খেলা। আর এখন— আইজল এফসি-ই ভারতীয় ফুটবলের শাসক।

Advertisement

আইজল এফসি-র রূপকথায় উত্তরণের রহস্যটা কী? মোহনবাগানকে হারিয়ে উচ্ছ্বসিত ক্লাবের মালিক রবার্ট রয়তে বলছিলেন, ‘‘আমরা শুরু থেকেই জোর দিয়েছি ফুটবলার তৈরির ব্যাপারে। মিজোরামে আমাদের মোট ছ’টি অ্যাকাডেমি আছে। ত্রিপুরাতে আছে একটি। মায়ানমারেও একটি অ্যাকাডেমি গড়ার কাজ চলছে। জার্মানির একটি ক্লাবের সঙ্গেও গাঁটছড়া বেঁধেছি। আমরা মনে করি, কাড়িকাড়ি অর্থ ব্যয় করে বাইরে থেকে ফুটবলার এনে সুদূরপ্রসারী ফল পাওয়া যায় না। ফুটবলার গড়তে হবে।’’

মহম্মদ আমনা, আলফ্রেড জারিয়ান, কামো বায়ো, কিংগসলে ওবুমেনিমি, আশুতোষ মেটা, জয়েস রানে, ও অ্যালবিনো গোমেজ— এই সাতজন এ বছর বাইরে থেকে এসেছেন। বাকিরা অধিকাংশই আইজল এফসি অ্যাকাডেমির ফসল। রবার্ট বলছিলেন, ‘‘স্থানীয় ফুটবলারদের ক্লাবের প্রতি দায়বদ্ধতা ও আবেগ অনেক বেশি। ওরাই আমাদের সম্পদ।’’ কোচ খালিদ জামিলও একমত। বললেন, ‘‘আইজলবাসীরা খুব সৎ এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ। সব কিছু ওরা হৃদয় দিয়ে করে। ক্লাবের জন্য ছেলেগুলো প্রাণও বাজি রাখতে পারে। এটাই আমাদের সাফল্যের অন্যতম কারণ।’’

Advertisement

শুক্রবার ছিল খালিদের জন্মদিন। এক দিন পরে মোহনবাগানকে হারিয়ে ফুটবলাররা তাঁকে সেরা ‘বার্থডে গিফ্ট’ দিলেও আশ্চর্যরকম উচ্ছ্বাসহীন আইজল এফসি কোচ। বললেন, ‘‘লাজংয়ের বিরুদ্ধে ম্যাচটা এখনও বাকি।’’ আইজল এফসি-র মালিক মিজোরামের অন্যতম ধনী ব্যক্তি। কিন্তু কখনওই সনি নর্দে বা উইলিস প্লাজা-র মতো তারকাদের নিতে আগ্রহী নন। বললেন, ‘‘টাকা আমি খরচ করব নিজের রাজ্যের ফুটবলারদের তুলে আনার জন্য। কলকাতার ক্লাবগুলোর মতো বিদেশিদের পিছনে কখনওই ছুটব না।’’

আশ্চর্য আইজল এফসি গড়ে ওঠার কাহিনিও। প্রত্যেক বছর মার্চ মাসে দু’শোরও বেশি দল নিয়ে আন্তঃজেলা লিগ হয় মিজোরামে। সেই টুর্নামেন্ট খেলার জন্যই আশির দশকের মাঝামাঝি আইজল এফসি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবার্ট।

আইজল এফসি-র নাটকীয় উত্থানের মতোই গত পাঁচ বছরে আমূল বদলে গিয়েছে মিজোরামের ফুটবল মানচিত্র।

এই মুহূর্তে দুটো লিগ হয়। একটা মিজোরাম প্রিমিয়ার লিগ। অন্যটা আন্তঃজেলা লিগ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দু’টো লিগে টিকিট কেটে খেলা দেখতে আসেন দর্শকরা। মহিলাদের উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য। আইজল এফসি-র অ্যাকাডেমির দায়িত্বে থাকা বাংলার জহর দাস বলছিলেন, ‘‘দু’টো লিগ থেকে অসংখ্য ফুটবলার উঠে আসছে।’’ মিজোরাম ফুটবল ফেডারেশনের সচিব টেটে-র কথায়, ‘‘মিজোরামের ছেলেরা আগে অন্য রাজ্যে চলে যেত। ওদের আটকাতে গেলে ঘরোয়া ফুটবলের উন্নতি করতেই হবে। সেই ভাবনা থেকেই পাঁচ বছর আগে আমরা মিজোরাম প্রিমিয়ার লিগ শুরু করলাম। প্রত্যেক বছর আর্থিক ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও আমরা পিছিয়ে আসিনি।’’

মিজোরামের রাজনীতির সঙ্গেও মিশে আছে ফুটবল। মুখ্যমন্ত্রী লাল থানহাওলা ফুটবলের অন্ধ ভক্ত। এমনকী, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মিজোরাম ন্যাশানল ফ্রন্টের প্রধান পু জোরামথাঙ্গা-ও ফুটবলঅন্ত প্রাণ। টেটে বলছিলেন, ‘‘আইজল এফসি গত মরসুমে ফেডারেশন কাপ ফাইনালে উঠলেও আই লিগ থেকে নেমে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি প্রফুল্ল পটেলকে চিঠি লিখে আইজল এফসি-কে আই লিগ প্রথম ডিভিশনে ফিরিয়ে আনার জন্য আবেদন জানান মুখ্যমন্ত্রী। সমর্থন করেছিলেন বিরোধী নেতাও।’’

আই লিগে আইজল এফসি না ফিরলে হয়তো এই রূপকথা লেখাই হতো না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন