শাবাশ: ডাবল সেঞ্চুরি করে ফিরছেন অধিনায়ক মনোজ, কুর্নিশ মেন্টর ‘ফাইটার’ লালের। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
রঞ্জি ট্রফির মরসুম শুরু হওয়ার আগে তাঁর নিজেরই রাজ্য ক্রিকেট সংস্থার কর্তারা ফতোয়া জারি করে দিয়েছিলেন। উড়ে এসেছিল এমন শাসানিও যে, পারফর্ম না করতে পারলে বাদ দিতেও দ্বিধা করা হবে না অধিনায়ককে। বাংলার ক্রিকেটে যা কার্যত নজিরবিহীন।
তাঁর অপরাধ? রঞ্জি ট্রফির প্রথম ম্যাচে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে দল বেছে নেওয়ার ঘটনায় অপমানিত হয়ে অধিনায়কত্ব ছাড়তে চেয়েছিলেন। কর্তাদের ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ লুফে নিয়ে পাল্টা জবাব তাঁদের দিকে ফিরিয়ে দিলেন মনোজ তিওয়ারি। মঙ্গলবার মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে রঞ্জি ম্যাচের দ্বিতীয় দিনে ২৭৯ বলে ২০১ রান করে বুঝিয়ে দিলেন, এখনও বাংলার ব্যাটিংয়ের প্রধান স্তম্ভ তিনিই।
আর ছেলের এই প্রত্যুত্তর দেওয়া ক্লাব হাউসে বসে দেখলেন মনোজের মা বীণা দেবী। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পঞ্চম ডাবল সেঞ্চুরিহল এ দিন। কিন্তু মায়ের সামনে প্রথম বার দ্বিশতরান করলেন। ছেলে ডাবল সেঞ্চুরি করে গ্যালারির দিকে ব্যাট তুললেন। তার পরে ড্রেসিংরুমের দিকে। তার পরে ক্লাব হাউসের ভিআইপি বক্সের দিকে। যেখানে বসে ছিলেন মা।
২০টি চার ও চারটি ছক্কা দিয়ে তাঁর ইনিংসকে সাজালেন মনোজ। স্টেপ আউট করে মারা প্রত্যেকটি ছক্কা যেন গিয়ে পড়ছিল সমালোচকদের তাঁবুতে। মধ্যপ্রদেশের বোলাররা তাঁর দিকে ছুটে আসার অনেক আগে নিজের সংস্থার কর্তারাই যে বাউন্সার দিতে শুরু করেছিলেন! বাংলার ক্রিকেটে অনেক সময়েই ড্রেসিংরুমে অন্তর্কলহের খবর রটেছে। কিন্তু একপেশে ভাবে সংস্থার কর্তারা অধিনায়ককে এ ভাবে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
অথচ, ঘটনা হচ্ছে, নির্বাচক কমিটিতে নাক গলানো বা নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে মন্তব্য করা থেকে কর্তাদেরই দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে লোঢা কমিটির সুপারিশে। সিএবি কর্তারা সংস্কারকে স্বাগত জানানোর মানসিকতা এখনও দেখাতে পারেননি। যোগ্যতামান পেরোচ্ছেন না এমন কয়েক জন প্রাক্তন ক্রিকেটারদের তাঁরা নির্বাচকের পদ পাইয়ে দিয়ে বসে আছেন। সিনিয়র এবং জুনিয়র নির্বাচক কমিটি মিলিয়ে আট জনের মধ্যে চার জনই যোগ্যতামানে আটকে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে কর্তাদের মুখ থেকে সাফাই গাওয়ার মতো একটা উত্তরই নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে যে, নতুন গঠনতন্ত্র তো এখনও কার্যকর হয়নি। যখন হবে, তখন দেখা যাবে।
কিন্তু পাল্টা প্রশ্ন উঠছে, তাঁরা কেন এগিয়ে এসে সংস্কারকে মেনে নিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সংস্থা পরিচালনা শুরু করছেন না? আনন্দবাজারে এ নিয়ে লেখালেখি হওয়ার পরেও কর্তারা উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে নারাজ। যোগ্যতামান পূরণ না করা নির্বাচকেরা এখনও তাঁদের পদে বহাল।
এ সবের প্রিজমে মনোজের মঙ্গলবারের ইনিংসকে দেখে মনে হবে, শুধুই একটা ইনিংস নয়। নিজেরই সংস্থায় বিরূপ হয়ে পড়া কর্তাদের গায়ে আছড়ে পড়া পাল্টা চাবুকের ঘা। সেই কারণে সেঞ্চুরির পরে আগ্রাসী উৎসবও করতে দেখা গেল বাংলার অধিনায়ককে। মিহির হিরওয়ানিকে কভার ড্রাইভে চার মেরে সেঞ্চুরি পূরণ করার পরে ক্লাব হাউসের দিকে অসির ভঙ্গিতে ব্যাট তুলে দেখিয়ে সম্ভবত বোঝাতে চাইলেন, তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার হাতের এই ব্যাটই সমস্ত জবাব দেবে। ডাবল সেঞ্চুরি করার পরে অবশ্য অনেক শান্ত, সংযত প্রতিক্রিয়া দেখা গেল তাঁর।
মনে রাখার মতো যে ভাবে এক দিয়ে উইকেট পড়তে থাকলেও শেষের দিকে বাংলার ইনিংসকে টেনে গেলেন, সেটাও। প্রত্যেক ওভারে বাউন্ডারি মেরে রান এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আর পঞ্চম বা শেষ বলে খুচরো রান নিয়ে পরের ওভারটা খেলার জন্য অন্য দিকে চলে যাচ্ছিলেন। ও ভাবেই খেলে ডাবল সেঞ্চুরি সম্পূর্ণ করলেন।
অশোক ডিন্ডা (৯) আউট হওয়ার সময়েও মনোজের রান ছিল ২৫০ বলে ১৬৬। সেটা ছিল নবম উইকেট। তার পর থেকে টি-টোয়েন্টি ভঙ্গিমায় ব্যাট করতে শুরু করেন মনোজ। ২৯ বলে করেন ৩৫ রান। মারেন তিনটি চার ও দু’টি বড় ছক্কা। একটি সোজা গিয়ে আছড়ে পড়ে সাইট স্ক্রিনের উপর। দ্বিতীয়টি লং-অনের উপর দিয়ে আছড়ে পড়ে গ্যালারিতে। ঈশান পোড়েলের সঙ্গে ৩৬ রানের জুটি গড়লেও মনোজেরই তার মধ্যে অবদান ৩৫ রান। দিনের শেষে মনোজ অবশ্য বলে গেলেন, ‘‘ঈশান সঙ্গ না দিলে হয়তো ডাবল সেঞ্চুরি করাই হত না।’’ দ্বিতীয় দিন চা-বিরতির এক ঘণ্টা পরে ৫১০-৯ তুলে ডিক্লেয়ার করে বাংলা। দিনের শেষে মধ্যপ্রদেশ বিনা উইকেটে ১৫। মনোজের দুরন্ত ব্যাটিংয়ের পরেও তৃতীয় দিন সকালে উইকেট তোলার উপরে নির্ভর করবে বাংলার ভাগ্য।
তবে বাংলার ড্রেসিংরুমে মেন্টর হিসেবে অরুণ লালের প্রবেশ যে গোটা দলের মনোভাব অনেক বদলে দিয়েছে, সেটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। মনোজকেও তিনি বুঝিয়েছেন, তুমি ডাবল সেঞ্চুরি করার ব্যাটসম্যান। তার কম করলে চলবে না। তাঁকে বুঝিয়েছেন, কী ভাবে ইনিংস গড়ে তুলতে হবে। ‘‘দিনের শুরুটা বোলারকে দাও। দিনের শেষে নায়ক হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে এসো,’’ বলেছিলেন অরুণ। মেন্টরের পরামর্শ বিফল হতে দেননি অধিনায়ক! আজ বুধবার ৩৩ বছরে পা রাখছেন মনোজ। ডাবল সেঞ্চুরির সঙ্গে যদি দলকে জয়ের রাস্তায় নিয়ে যেতে পারেন, তা হলে সেটা হবে সবচেয়ে বড় উপহার।