মারাদোনার বিশ্বকাপ থাকলে মেসির আছে বার্সেলোনা

তা হলে কি এই তত্ত্বেই সিলমোহর পড়ে গেল, পেলে-মারাদোনা নন মেসি? আবার মেসি তো পেলে-মারাদোনাও! বিশ্বকাপ— পেলে ৩, মারাদোনা ১, মেসি ০। কোপা— পেলে ০, মারাদোনা ০, মেসি ০। দেশজ জার্সিতে তিন লাতিন আমেরিকান ফুটবল ঈশ্বরেরই সর্বোত্তম সাফল্য-মঞ্চ দু’টো। বিশ্বকাপ আর কোপা।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৬ ০৩:৫২
Share:

তা হলে কি এই তত্ত্বেই সিলমোহর পড়ে গেল, পেলে-মারাদোনা নন মেসি?

Advertisement

আবার মেসি তো পেলে-মারাদোনাও!

বিশ্বকাপ— পেলে ৩, মারাদোনা ১, মেসি ০।

Advertisement

কোপা— পেলে ০, মারাদোনা ০, মেসি ০।

দেশজ জার্সিতে তিন লাতিন আমেরিকান ফুটবল ঈশ্বরেরই সর্বোত্তম সাফল্য-মঞ্চ দু’টো। বিশ্বকাপ আর কোপা।

লাতিন আমেরিকান কাপ পেলে-মারাদোনা-মেসি তিন কিংবদন্তিকেই কেরিয়ারে ফাঁকি দিয়েছে।

আর বিশ্বকাপ যদি বিবেচ্য হয়, সে তো মেসির ক্লাব সতীর্থদেরও আছে। ইনিয়েস্তা, পিকে, বুস্কেতস, জাভি— এলএম টেনের বার্সা টিমমেটদের ট্রফি ক্যাবিনেটে বিশ্বকাপের যে রেপ্লিকা জ্বলজ্বল করে, পাঁচ বারের ব্যালন ডি’অরের শো-কেসে তা নেই।

তাতে কি প্রমাণ হয়ে যাবে জাভি-ইনিয়েস্তাও নন মেসি?

ব্যালান্স শিটের অন্য দিকে বার্সেলোনার মেসির ক্যাবিনেটে আটটা লা লিগা, চারটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। যে পরিসংখ্যান যেন ‘মেসি দেশের চেয়ে বেশি ক্লাবের’ স্লোগানকে আরও উচ্চকিত করে তুলছে। দেশ বনাম ক্লাব দ্বৈরথকে আরও বেশি উস্কানি দিচ্ছে।

কিন্তু চার দশক আগের পেলে আর তিন দশক আগের মারাদোনার পৃথিবী আর গুগল-হোয়াটসঅ্যাপের বর্তমান যুগের মধ্যে দূরত্ব ফুটবল মাঠের সেন্টার লাইন থেকে গোল পোস্টের দূরত্বের কয়েকশো গুণ।

টেনিস, গল্ফ, বাস্কেটবলের মতো অন্য ‘গ্লোবাল স্পোর্টে’ তফাতটা তো আরও স্পষ্ট। আরও ব্যাপক। নিষ্ঠুরও।

আসলে আর্জেন্তিনার শেষ তিনটে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে তীরে এসে তরী ডোবা মেসির দেশজ দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস জোগাচ্ছে।

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালে জার্মানির কাছে হার। ২০১৫ কোপা ফাইনালে চিলির কাছে হার। ২৬ জুন, ২০১৬ শতবর্ষের কোপা ফাইনালেও হার সেই চিলির কাছে! তিন বছরে তিন বার। দেশের হয়ে বড় কোনও ট্রফি আর হাতের মাঝে শেষ মুহূর্তে ফাঁক থেকে গেল ফুটবল রাজপুত্রের! তারও আগে ২০০৭ কোপা ফাইনাল হার। ২০০৮ অলিম্পিক্স সোনা আর তার আগে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ মেসির দেশজ কেরিয়ারে দু’টো মাত্র সাফল্য হয়ে থেকে গেল। ফুটবল-সৌরজগতে মেসি নামক উজ্জ্বল নক্ষত্রের ক্ষেত্রে যা মামুলি সাফল্য।

ফুটবলে তো তবু ক্লাব বনাম দেশ প্রশ্নের মধ্যেও দু’টোই টিমগেম। আমি বনাম আমরা নয়। আমরা বনাম আমরা। তাতে বিভিন্ন ফুটবল ঘরানার তারকা সতীর্থদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় নিজস্ব শৈলি আরও আকর্ষণীয় আর কার্যকরী হয়ে দাঁড়ায়। বার্সেলোনায় ইনিয়েস্তা-নেইমার-সুয়ারেজের পাশে খেলা মেসির যা হয়। যেটা আর্জেন্তিনা দলে দি’মারিয়া, ইগুয়াইন, আগেরোর সঙ্গে খেলে হয় না। কিন্তু দিনের শেষে দু’টোই এগারো জনের সম্মিলীত প্রয়াস। স্কিল। প্রতিভা। মেসি তার মধ্যে এক্স ফ্যাক্টর, এই যা।

টেনিসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩২ বার ডেভিস কাপ (যাকে টেনিসের বিশ্বকাপ বলা হয়ে থাকে) চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পিট সাম্প্রাসের ১৪টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম। সুইৎজারল্যান্ড ক’বার ডেভিস কাপ জিতেছে দশ জনের মধ্যে সাড়ে ন’জন টেনিসপ্রেমী বলতে পারবে না। কিন্তু সবচেয়ে বেশি গ্র্যান্ড স্ল্যাম কার, দশে দশ জনই জানে রজার ফেডেরার।

গল্ফের রাইডার কাপ হল এক রকম বিশ্বকাপ। প্রায় একশো বছরের পুরনো। দু’বছর অন্তর আমেরিকা বনাম ইউরোপে হয়। আগে হত আমেরিকা বনাম ব্রিটেনে। রাইডার কাপ মার্কিন দল ৪০ বার জিতেছে বলে গল্ফ দুনিয়া বেশি হইহই করে? না, দুই মার্কিন কিংবদন্তি গল্ফার জ্যাক নিকলাস আর টাইগার উডসের মেজরে অসাধারণ সাফল্য ঘিরে চর্চা বেশি? বেশি মুগ্ধতা! ৪০ রাইডার খেতাবের চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্ব নিকলাসের ৬ মাস্টার্স, ৫ পিজিএ-সহ ১৮ মেজর। বা উ়ডসের ৪ মাস্টার্স, ৪ পিজিএ সমেত ১৪ মেজর।

ফুটবলের (ফিফা) পরেই বিশ্বে যে খেলাটার গর্ভনিং বডিতে সদস্য দেশের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, সেই বাস্কেটবলেও তো এক ছবি। দেশের রূপকথা-সাফল্যের চেয়েও পেশাদার ক্লাবের সফল বাস্কেটবলারদের দ্যুতি অনেক বেশি। বাস্কেটবলের বিশ্বকাপে সবার সেরা যুক্তরাষ্ট্রের ৫ সোনা-সহ মোট পদক এক ডজন। দুইয়ে সাবেক যুগোস্লাভিয়া। ৫ সোনা, ৩ রুপো, ২ ব্রোঞ্জ। কিন্তু বছরভর যত রমরমা এনবিএ-র বস্টন সেলটিক্স, লস অ্যাঞ্জেলিস লেকার্স, শিকাগো বুলস নিয়ে। সেলটিক্সের বিল রাসেল-স্যাম জোন্স, লেকার্সের কোবে ব্রায়ান্ট, শিকাগো বুলসের মাইকেল জর্ডান— বাস্কেটবলের এক-একজন আইকন।

ভারতের ‘ধর্ম’ ক্রিকেটও কি এই তত্ত্বের খুব দূরে? বিরাট কোহালি যে দেশের হয়ে ১৬ টেস্ট জিতেছেন, সেখানে তাঁর ব্যাটিং গড় ৪০। রান ৯৬০। যে ৯৯ ওয়ান ডে জিতিয়েছেন তাতে রান ৪৯৯৫। গড় ৬৭.৫০। কিন্তু এর চেয়ে ক্রিকেটমহলে বেশি আলোড়ন তুলেছে আইপিএল নাইনে বিরাট-ঝড়। আরসিবি-তে কোহালির ১৬ ম্যাচে ৯৭৩ রান, দেড়শোর উপর স্ট্রাইক রেট, ৮৩ বাউন্ডারি আর ৩৮ ছক্কার রেশ এখনও কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকায়।

বিরাট কোহালি যদি সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে কথায় কথায় তুলনীয় হন, তা হলে লিও মেসির নাম পেলে-মারাদোনার সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণে দোষ কোথায়?

মেসির আর্জেন্তিনা না থাক, বার্সেলোনা তো আছে! থাকলও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন