ডার্বির আগের ম্যাচে বাগান গ্যালারিতে ‘মোবাইল দীপাবলি’। ডার্বির আকাশে কিন্তু আশঙ্কার অমাবস্যা! ছবি-শঙ্কর নাগ দাস
বাঙালির চিরকালীন ফুটবল-যুদ্ধের রেশ এ বার গড়াল লালবাজার পর্যন্ত! মরসুমের প্রথম ডার্বির বল গড়ানোর আগেই ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের বিরুদ্ধে এফআইআর করল মোহনবাগান। যার জেরে জমে উঠেছে ডার্বি নাটক।
গোটা ঘটনার নেপথ্যে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নিজেকে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক বলে দাবি করে এক ব্যক্তির পোস্ট। যে হুমকি-পোস্ট নিয়ে ময়দান তোলপাড়। কল্যাণী স্টেডিয়ামে ডার্বির নিরাপত্তা নিয়েও নতুন করে উঠল প্রশ্ন। দীপেন কর্মকার নামে ওই ‘ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের’ বাগানকে হুমকি দেওয়ার পর সবুজমেরুন অর্থসচিব সোজা দ্বারস্থ হন পুলিশের। করা হয় এফআইআর। বাগানের তরফে পুরো ঘটনা জানানো হয় আইএফএকেও।
ময়দানের একটা অংশের আবার জল্পনা, নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে আইএফএকে পাল্টা চাপে রাখার কৌশলও হতে পারে এটা। কারণ, এ দিন বাগানের ম্যাচ শেষ হতেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে পোস্ট হওয়া ইস্টবেঙ্গল সমর্থকের বক্তব্যের প্রিন্ট আউট প্রকাশ পায় ময়দানে। যেটা এ দিন ঘরের মাঠে ম্যাচ জেতার পরে সাংবাদিকদের মধ্যে বিলোন বাগানের দুই অন্যতম শীর্ষকর্তা অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত ও সহ-সচিব সৃঞ্জয় বসু। যে প্রিন্ট আউটে কল্যাণীর ডার্বিতে কলঙ্কিত ১৯৮০-র ১৬ অগস্টের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার হুমকি তো রয়েছেই। সঙ্গে রয়েছে মোহনবাগানের এই দুই কর্তার উদ্দেশ্যে অকথ্য গালিগালাজ।
যদিও এর সঙ্গে ডার্বি খেলা বা না খেলা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি বাগান কর্তারা। অর্থসচিব দেবাশিস দত্তকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তা হলে এই চিঠিই কি মোহনবাগানের ডার্বি না খেলার একটা বড় কারণ হয়ে উঠতে পারে? জবাবে দেবাশিস বলেন, ‘‘ডার্বি খেলা নিয়ে কোনও মন্তব্য করিনি। চিঠির বিষয়টা পড়লেই বুঝতে পারবেন এটা কতটা গুরুতর বিষয়। কল্যাণীতে এমনিতেই অস্থায়ী গ্যালারি তৈরি হচ্ছে। সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার এই ধরনের পোস্টে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতেই পারে। তাই বিষয়টা পুলিশ এবং আইএফএ সচিব উভয়কেই বিস্তারিত জানিয়েছি।’’
রাতে ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া চলে ক্লাবের অন্যতম শীর্ষকর্তা দেবব্রত সরকার বলেন, ‘‘এই পোস্টের সঙ্গে ক্লাবের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে যে এই ঘৃণ্য কাজ করেছে তাকে কোনও মতেই সমর্থন করা যায় না। আমরাও তার শাস্তি চাই। তবে সঙ্গে এটাও তদন্ত করে দেখতে হবে কেউ কোনও ঘৃণ্য চক্রান্ত করে এই ধরনের পোস্ট করছে কি না।’’ রাতে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) বিশাল গর্গের কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, ‘‘মোহনবাগানের অভিযোগ পেয়েছি। পুরো ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছি।’’
ময়দানে কান পাতলে আরও একটা ধারণার কথা শোনা যাচ্ছে এখন। সেটা হল, তাদের ভেস্তে যাওয়া টালিগঞ্জ অগ্রগামী ম্যাচ সাত দিনের মধ্যে করতে হবে বলে মোহনবাগান যে চিঠি আইএফএ-র কাছে পাঠিয়ে ডার্বি পিছনোর কথা বলছে তাতে পেরেন্ট বডি জল ঢেলে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছে। আইএফএ-র কাছে বাগানের যুক্তি নস্যাৎ করার জন্য এমন এক অস্ত্র নাকি আছে যা বাগানের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া কঠিন।
কী সেই অস্ত্র? মোহনবাগান কলকাতা লিগের যে নিয়মের কথা তুলে ধরে বলছে, সাত দিনের মধ্যে রিপ্লে ম্যাচ করতে হবে, সেটার মধ্যে ফাঁক আছে। সেই ‘অ্যাপেন্ডিক্স কে’-র ‘এইট-সি’ নিয়মে দু’টি শব্দ রয়েছে ‘মে বি’। অর্থাৎ নিয়মে ম্যাচটি সাত দিনের মধ্যে হতেও পারে, আবার না-ও হতে পারে। করতেই হবে এ রকম কথা লেখা নেই। সে ক্ষেত্রে কিন্তু বাগানের যুক্তি না খাটার সম্ভাবনা আছে। আইএফএর কাছে এ রকম একটা হাতে গরম উদাহরণও রয়েছে।
গত মরসুমেই কলকাতা লিগে মোহনবাগান-এরিয়ান ম্যাচ বৃষ্টির জন্য ভেস্তে গিয়েছিল। সেই ম্যাচও রিপ্লে হয়। তবে দশ দিন পরে। বাগান সেই রিপ্লে খেলেওছিল। শুধু তাই নয়, ভেস্তে যাওয়া ম্যাচের রিপ্লে খেলার আগে খেলেছিল পুলিশ এসি ম্যাচ। তার পর ডার্বিও খেলে ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে। ঠিক এ বার যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেটাই ছিল গত বার। এবং বাগান লিগ সাব কমিটির সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, গত বার যদি একই অবস্থায় বাগান কর্তারা মেনে নেন, তা হলে এ বার কেন নয়?
তবে ভেস্তে যাওয়া ম্যাচ এবং ডার্বির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে সংঘাতের রাস্তায় যেতে রাজি নয় আইএফএ। সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায় শুক্রবার বলেন, ‘‘লিগ সাব কমিটিতে যা ঠিক হবে, সেটাই জানিয়ে দেব মোহনবাগানকে।’’
বাগানও আগের চেয়ে অনেকটা নরম এই মুহূর্তে। লিগের সূচি অনুযায়ী পর পর ম্যাচ খেলার দাবি থেকে সরে এসে তারা শুক্রবার ইউনাইটেড ম্যাচ খেলেছে। অবাক করার মতো ব্যাপার, এ বিষয়ে বাগান কর্তারা তাঁদের পরিচিত উত্তেজনা দেখাচ্ছেন না। বরং ধীরে চলো নীতি নিয়েছেন। অর্থসচিব দেবাশিস দত্ত বললেন, ‘‘লিগ সাব কমিটির সভায় কী হয় আগে দেখি, তার পর এই নিয়ে ভাবা যাবে।’’
ডার্বির পর আইএসএলের জন্য ফুটবলার ছেড়ে দিতে হবে ইস্টবেঙ্গলকে। পাশাপাশি তারা টানা সাত বার কলকাতা লিগ জয়ের রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে। স্বভাবতই ৭ সেপ্টেম্বরের পর লাল-হলুদ শিবির ডার্বি খেলতে রাজি নয়। ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, মোহনবাগান আসলে এই সুবিধেটাই নিতে চাইছে। কিন্তু আইএফএ তাতে জল ঢেলে দিতে চাইছে যুক্তি দিয়ে।
৭ সেপ্টেম্বর ডার্বি না হলে আইএফএ-ও সমস্যায় পড়বে। তাদের সম্প্রচার চুক্তি রয়েছে। প্রশাসনিক সব কাজ শেষ। টিকিট ছাপাও হয়ে গিয়েছে। কল্যাণী স্টেডিয়ামে ডার্বির জন্য অস্থায়ী গ্যালারি তৈরি হয়ে গিয়েছে। এত আয়োজনের পর ডার্বির তারিখ বদল করা কঠিন। সেখানে মোহনবাগানের সমস্যা নেই। কারণ বাগানের এই টিমে সে অর্থে আইএসএলের কোনও প্লেয়ার নেই। তাই পরে ডার্বি হলেও সমস্যায় পড়তে হবে না তাদের।