এক সময়ে যে বাংলার মাটি ছিল ফুটবলার তৈরির সেরা কারখানা, তারাই এখন জাতীয় স্তরে ধুঁকছে। বয়সভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে সিনিয়র জাতীয় দল, মেয়েদের বিভিন্ন বয়সের জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছে বাংলার মুখ।
ফুটবলের জাতীয় মানচিত্রে বাংলার অবস্থা নিয়ে খোঁজ করতে নেমে আনন্দবাজারের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়ঙ্কর সব তথ্য। যেমন দেশের সিনিয়র দলের জন্য প্রাথমিক ভাবে ডাক পাওয়া ৪৩ জনের মধ্যে মাত্র চার জন বাংলার। এই চার জন হলেন নারায়ণ দাস, শুভাশিস বসু, প্রীতম কোটাল এবং প্রণয় হালদার। ৪৩জনে চার জন মানে দশ শতাংশ প্রতিনিধিত্বও নেই বাংলার। অথচ এ রাজ্য থেকে একটা সময়ে পঞ্চাশ বা ষাট শতাংশেরও বেশি ফুটবলার জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন।
জুনিয়র বিভাগে অবস্থা আরও শোচনীয়। ভুবনেশ্বরে অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় শিবিরের জন্য ডাক পাওয়া ফুটবলারদের তালিকায় চোখ রেখে দেখা যাচ্ছে, ৩৫ জনের মধ্যে মাত্র এক জন বাংলার— শুভ পাল। বাঙালির প্রিয় খেলা ফুটবলের এখন কী অবস্থা, তালিকায় জ্বলজ্বল করতে থাকা আর একটি তথ্য থেকে পরিষ্কার। ওড়িশা বা সিকিম থেকে বাংলার চেয়ে বেশি ফুটবলার ডাক পেয়েছে অনূর্ধ্ব-১৫ শিবিরে। এমনকি, ঝাড়খণ্ড থেকে পর্যন্ত দু’জন খুদে ফুটবলার রয়েছে। যে ঝাড়খণ্ডের নাম খেলাধুলোর দুনিয়ায় মহেন্দ্র সিংহ ধোনির দৌলতে ক্রিকেটেই বেশি শোনা যায়।
জুনিয়র স্তরে বাংলার দুর্দশার ছবি এখানেই শেষ হচ্ছে না। এ বছরেই হওয়া অনূর্ধ্ব-১৮ এএফসি চ্যাম্পিয়নশিপের খেলোয়াড় তালিকা খুঁটিয়ে দেখলে আঁতকে উঠতে হবে। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্যি যে, সেখানে ২৩ জন ফুটবলারের মধ্যে এক জনও বাংলা থেকে নেই! ক্রোয়েশিয়া সফরের জন্য অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলে পরিস্থিতি তা-ও কিছুটা মুখরক্ষা করার মতো। ২৩ জনের মধ্যে চার জন বাংলার।
শান্তি মল্লিক, কুন্তলা ঘোষদস্তিদারেরা এক সময় এ রাজ্য থেকে ভারতীয় মহিলা ফুটবলে রাজ করেছেন। এখন মহিলা ফুটবলেও অন্ধকার। এ বছরের অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতীয় মহিলা দলে ২৩ জনের মধ্যে এক জন মাত্র বাংলার। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ প্রতিযোগিতায় ২৩ জনের মধ্যে বাংলার কেউ নেই-ই! অনূর্ধ্ব-১৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও ২৩ জনের মধ্যে বাংলা থেকে কোনও মেয়ে নেই। কোটিফ কাপে ২০ জনের মহিলা দলে মাত্র এক জন বাংলা থেকে। ব্রিকস গেমস ২০১৮-তে ২০ জনের ভারতীয় মহিলা দলে বাংলার প্রতিনিধি সেই এক জন।
প্রশ্ন উঠছে, বাংলার ফুটবল কর্তারা কি আদৌ খবর রাখেন এই দুর্দশার? আইএফএ কী উত্তর দেবে এই অধঃপতনের? আইএফএ সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘অন্য রাজ্যের ফুটবলাররাও উঠে আসছে। তা ছাড়া জাতীয় শিবিরে কারা ডাক পাবে, তা আই লিগ দেখে ঠিক হয়। সেখানে বাংলার ক্লাব দু’টি। সেখানেও বাংলার ফুটবলার কম। আগে সন্তোষ ট্রফি দেখে নতুন প্রতিভাদের তুলে আনা হত। এখন তো সন্তোষ ট্রফিতে কোনও স্পটারই আসেন না। তাই বাংলার প্রতিভা জাতীয় শিবিরে কম ডাক পাচ্ছে।’’ যদিও প্রশ্ন থেকেই যায়, বাংলা থেকে প্রতিভাদের নজরে আনার জন্য তাঁরাই বা কী করছেন?
দায় এড়াতে পারে না কলকাতার দুই বড় ক্লাব, ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানও। একটা সময় এই দুই ক্লাব থেকে সারা ভারতে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন প্রতিভাবান ফুটবলারেরা। এখন দুই ক্লাবই বিদেশি এনে সস্তায় বাজিমাত করার রাস্তায় গিয়ে সন্তুষ্ট। আই লিগ চালু হয়েছে ২০০৭-০৮ সালে। এটা নিয়ে ১২তম বর্ষ। এর মধ্যে মোহনবাগান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এক বার, ইস্টবেঙ্গল কখনও খেতাব জেতেনি। ফেডারেশনের টেকনিক্যাল কমিটির কর্তা এবং কিংবদন্তি ফুটবলার শ্যাম থাপা আঙুল তুলেছেন আইএফএ-র দিকে। তাঁর কথায়, ‘‘আইএফএ দায় এড়াতে পারে না। পরিকাঠামো নেই। অ্যাকাডেমি নেই। পরিকল্পনাই বা কোথায়! উত্তর-পূর্ব ভারতের ক্লাবগুলো যুব ফুটবলার তুলে আনার কাজ করছে নিষ্ঠার সঙ্গে। তাই পিছিয়ে পড়ছে বাংলা, অন্যরা এগোচ্ছে।’’ গত পাঁচ বছর ধরে জাতীয় স্তরে বাংলার ফুটবল দলের পারফরম্যান্সও আহামরি কিছু নয়। সন্তোষ ট্রফিতে পাঁচ বছরে মাত্র এক বার চ্যাম্পিয়ন। সাব-জুনিয়রে এক বার চ্যাম্পিয়ন। জুনিয়রে সেরা পারফরম্যান্স ফাইনালে খেলে হার।
পিকে, চুনী, বলরামদের নিয়ে এক সময় আলোড়িত হত গোটা দেশ। এমনকি, এশিয়া বা বিশ্বের ফুটবল মহলও। তাঁদেরই চোখের সামনে দেশের ফুটবল মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে বাংলা।