টাইব্রেকার-টোটকা দিয়েছিল, তবু পারিনি হারাতে

কোয়ম্বত্তূরের সেই স্মৃতি কোনও দিন ভুলব না। যত দূর মনে পড়ছে, সেটা ১৯৭৮-৭৯ হবে। ফেড কাপের ম্যাচ ছিল। সম্ভবত সেমিফাইনাল। আইটিআই-এর সঙ্গে খেলা ছিল মোহনবাগানের।

Advertisement

ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৫৪
Share:

মোহনবাগান মাঠে প্রয়াত শিবাজি বন্দ্যোপাধ্যায়কে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন গৌতম সরকার, চুনি গোস্বামী, সঞ্জয় মাঝি, সুব্রত ভট্টাচার্য, শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়-রা। সোমবার।-সুদীপ্ত ভৌমিক

কোয়ম্বত্তূরের সেই স্মৃতি কোনও দিন ভুলব না। যত দূর মনে পড়ছে, সেটা ১৯৭৮-৭৯ হবে। ফেড কাপের ম্যাচ ছিল। সম্ভবত সেমিফাইনাল। আইটিআই-এর সঙ্গে খেলা ছিল মোহনবাগানের।

Advertisement

টাইব্রেকারের পর সাডেন ডেথ। কিক মারা চলছেই। শেষ আর হচ্ছে না। গ্যালারিতে ইস্টবেঙ্গলের অন্য ফুটবলারদের সঙ্গে বসে আছি আমি। একটা করে বল মারা চলছে আর আমাদের মধ্যে বাজি ধরা চলছে। এটা গোল হবে, এটা সেভ হবে। কিন্তু গোল হয়েই যাচ্ছে। আমি প্রথম থেকেই বলে আসছিলাম, যদি একটা বল সেভ হয়, সেটা করবে শিবাজিদা (বন্দ্যোপাধ্যায়)। হলও ঠিক তাই। শিবাজিদার একটা সেভেই ফাইনালে চলে গেল মোহনবাগান।

শিবাজিদার সঙ্গে আমি এক বছরই ক্লাব টিমে একসঙ্গে খেলেছি। সেই ১৯৭৫ সালে। আমি, প্রশান্ত মিত্র আর শিবাজিদা— তিন জন ছিলাম মোহনবাগানের সে বারের গোলকিপার। আমি ছিলাম জুনিয়র। তবুও প্রশান্তদা চোট পেলে বা অসুস্থ হলে আমাকে নামানো হতো। কিন্তু তাতেও শিবাজিদাকে কখনও রাগ করতে দেখিনি। কখনও ক্ষোভ জানাতে দেখিনি। সব সময় উৎসাহ দিত ভাল খেলার।

Advertisement

গোলকিপার জীবনে বাকি সময় আমি শিবাজিদার বিপক্ষ টিমে খেলেছি। এবং, আমার লিখতে বাধা নেই, সবসময়ই ডার্বি ম্যাচে উল্টোদিকের গোলে দাঁড়িয়ে আমার মনে হতো ওকে টপকে গোল করা কঠিন। কারণ যে গোলটা মনে হতো আটকানো সম্ভব নয়, সেটাই কোথা থেকে এসে লম্বা হাত দিয়ে আটকে দিত শিবাজিদা। আর টাইব্রেকার? ওটা আটকানোর জন্য যেন জন্মগত প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিল শিবাজিদা।

কী অনুমান ক্ষমতা! যে শট নিচ্ছে, কী ভাবে চাপে ফেলে তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিতে হয়, সেটা শিবাজিদার চেয়ে ভাল কেউ জানত না। আমাদের সময়ে প্রচুর নক-আউট টুর্নামেন্ট হতো। সেখানে টাইব্রেকার হতো ম্যাচ ড্র থাকলেই। শিবাজিদার বিরুদ্ধে চল্লিশটারও বেশি ম্যাচ খেলেছি। তার অনেকগুলিই টাইব্রেকার বা সাডেন ডেথে গড়িয়েছে। একদিন সল্টলেকের এক আড্ডায় হিসাব করতে বসে দু’জনে দেখেছি, আমার টিমই হেরেছে বেশি। ইস্টবেঙ্গল পেনাল্টি পেলে বা টাইব্রেকার মারলেই আমি চোখ বুজে থাকতাম। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতাম শিবাজিদা যেন গোলটা খায়। বেশিরভাগ সময় সেটা হতো না। আমার টিমের যে শট মারত, তাকে টিপস দিতাম মাটি ঘেঁষে মারো। সেই শটও আটকে দিত শিবাজিদা।

শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন নর্দে।-নিজস্ব চিত্র

বড় ম্যাচের বাইরে আমাদের সম্পর্ক ছিল দাদা-ভাইয়ের মতো। বাংলার সন্তোষ ট্রফিতে শিবাজিদার রুমমেট ছিলাম। কথা বলতে বলতেই জিজ্ঞাসা করতাম, কী ভাবে পেনাল্টিটা সেভ করো? বলত, অনুমানক্ষমতা আর বুদ্ধি করে যে শট মারছে তাকে নিজের সুবিধে মতো দিকে বলটা মারতে বাধ্য করা। এটাই সাফল্যের রসায়ন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, একশো শতাংশ সফল হইনি কখনও। আমি তো পারিইনি, শিবাজিদার মতো টাইব্রেকার-এক্সপার্ট আমি আর কখনওই দেখিনি।

অতনু ভট্টাচার্য থেকে দেবজিৎ মজুমদার সবার কথা মাথায় রেখেই এটা লিখছি। গোলকিপাররা এমনিতে একটু পাগলাটে ধরনের বা ছটফটে হয়। শিবাজিদা কিন্তু ছিল খুব ঠান্ডা মাথার। বলতে পারেন গোলকিপারদের মধ্যে বিরল চরিত্র।

আমার চেয়ে বছর চারেকের বড় ছিল। মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সল্টলেকের বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলাম। এ রকম হাসিখুশি মানুষ কম দেখেছি। প্রায় সারাজীবন বিপক্ষে খেললেও একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। মাঝেমধ্যেই নির্ভেজাল আড্ডা হতো। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সমসাময়িক অনেক ফুটবলারই সতীর্থদের সমালোচনা করে আনন্দ পায়। শিবাজিদাকে কখনও কারও বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলতে শুনিনি। এটা যে কোনও মানুষের দুর্লভ গুণ।

এত তাড়াতাড়ি চলে গেল। কী এমন বয়স হয়েছিল! পঁচাত্তরে ফুটবলার জীবন শুরু করেছিলাম যাঁদের সঙ্গে তাঁদের মধ্যে প্রশান্তদা চলে গিয়েছেন। শিবাজিদাও চলে গেল। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে নিজেকে।

বারবার মনে হচ্ছে যেন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচে রয়েছি। টাইব্রেকার মারছে ইস্টবেঙ্গল। আর চোখ বন্ধ করে দু’হাত বুকের কাছে জড়ো করে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছি, যেন গোল হয়।

এটাও জানি, চোখ খুললেই দেখব, আমার সতীর্থ ব্যর্থ হয়েছে। চিরঘুমের মধ্যেও টাইব্রেকারটা যে ঠিকই বাঁচিয়ে দেবে শিবাজিদা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন