প্রধান বিচারপতি কী রায় দেবেন ৩ জানুয়ারি? কী ঝুলছে অনুরাগদের ভাগ্যে?
ভারতীয় ক্রিকেটের প্রশাসনিক ইতিহাস এ বার থেকে কি দু’টো ভিন্ন মোড়ে চিরকালের জন্য ভাগ হয়ে গেল? প্রাক ৩ জানুয়ারি ২০১৭। আর উত্তর।
বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির উপস্থিতিতে তিন সদস্যের বেঞ্চে ক্রিকেট বোর্ডের উপর যেমন চূড়ান্ত অনাস্থা প্রকাশ পেল, তাতে ক্রিকেট মহলের মনে হচ্ছে ভবিতব্য নিশ্চিত ভাবে সে দিকে।
প্রধান বিচারপতি টিএস ঠাকুর অবসর নিচ্ছেন নতুন বছরের ৪ জানুয়ারি। বোর্ড কর্তারা জুলজুল চোখে বহু দিন থেকে ক্যালেন্ডারের এই দিনটার দিকে তাকিয়ে। তাঁদের ধারণা ওই অবধি কাটিয়ে দিতে পারলে ঠাকুরের চরমপন্থী অবস্থান থেকে তাঁরা স্বাধীন হয়ে যাবেন। পরিস্থিতি আবার তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
অথচ ঠাকুর এ দিন যা জানালেন, তাতে নিস্তার নেই। তিনি কি না কর্মজীবনের শেষ দিনে মহা আলোচিত ক্রিকেট মামলার রায় দিয়ে যাবেন। বৃহস্পতিবার রাতে বোর্ডের আইনি মাথা বললেন, ‘‘আমরা এখনও আশা ছাড়িনি। হ্যাঁ, বিচারপতিরা আজ অনেক কড়া কড়া কথা বলেছেন। কিন্তু রায় তো হয়নি। সেটা তো এত কড়া নাও হতে পারে।’’
ক্রিকেট মহলের বড় অংশ অবশ্য বিষ্যুদবারের আদালত কক্ষের টালমাটালের পর বোর্ডের যাবতীয় আশা ছেড়ে দিয়েছে। ধরেই নিচ্ছে নতুন বছরের তৃতীয় দিন থেকে বোর্ডে প্রশাসক নিয়োগ করে দেবে আদালত। মানে ৩ জানুয়ারি থেকে সম্পুর্ণ গুরুত্বহীন হয়ে পড়বেন প্রেসিডেন্ট অনুরাগ ঠাকুর ও সচিব অজয় শিরকে। আদৌ তাঁদের অস্তিত্ব থাকবে কি না সন্দেহ।
আদালতে বোর্ডের পক্ষে এ দিন আবেগপূর্ণ সওয়াল করেন কপিল সিব্বল। বলেন, ‘‘দেশে ক্রিকেট সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনা এত বছর ধরে বোর্ড সদস্যরাই করেছেন। লোঢা কমিটির সুপারিশ নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে অনেক আলোচনা করেছি। তিন-চতুর্থাংশ মেম্বার এর বিরোধী। এর পর আমাদের সংবিধান অনুযায়ী কী করে আমরা গরিষ্ঠ সদস্যদের বিরুদ্ধে যেতে পারি?’’ এই যুক্তি শুনে প্রচণ্ড রেগে যান প্রধান বিচারপতি। বলেন, ‘‘রাখুন তো মশাই আপনার সংবিধান আর থ্রি-ফোর্থ মেজরিটি। ওখানে প্রত্যেকটা লোক কায়েমি স্বার্থ নিয়ে বসে আছে। তারা কী ভাবল, কী এসে যায়?’’
সবচেয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয় প্রেসিডেন্ট অনুরাগ ঠাকুরকে নিয়ে আলোচনা শুরু হলে। অনুরাগ এর আগে আদালতকে হলফনামায় জানিয়েছিলেন, আইসিসি প্রেসিডেন্টকে তিনি কোনও চিঠি লেখেননি। মৌখিক অনুরোধ করেছিলেন যে, লোঢার সুপারিশ ভারতে কার্যকর করতে গেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডামাডোল দেখা দেবে, এই মর্মে যেন আইসিসি প্রেসিডেন্ট তাঁকে একটা চিঠি দেন।
আদালতে প্রমাণ হয়ে যায় যে মৌখিক নয়, এ রকম একটা চিঠি সত্যি শশাঙ্ক মনোহরকে লিখেছিলেন অনুরাগ। প্রধান বিচারপতি এ দিন কড়া সুরে বলেন, ‘‘মিস্টার সিব্বল, সর্বোচ্চ আদালতের কাছে শপথ নিয়ে এ রকম মিথ্যে বলার শাস্তি জেলবাস জানেন তো?’’ সিব্বল দু’মিনিট চুপ করে যান। তার পর বলেন, ‘‘আমার মক্কেল ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্টের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি স্যার।’’
বিচারপতির এই পর্যবেক্ষণ নিয়ে অবশ্য দিনভর ক্রিকেট মহলে তুমুল চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ক্রিকেট আইনজীবী মহলে কেউ কেউ বলতে থাকেন, সিব্বল যতই দুঃখ প্রকাশ করুন, অবিলম্বে লিখিত এফিডেভিট করে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত অনুরাগের। নইলে পরিস্থিতি সত্যিই হাজতবাসে গড়াবে।
ক্রিকেট মহলে দিনভর পোস্ট মর্টেমও চলে যে কোথায় গিয়ে বোর্ড ভুল করল? এ দিন দিল্লি থেকে বিচারপতি মুকুল মুদগল বলছিলেন, ‘‘এখনও তো রায় হয়নি। এখনই লোকে সব কিছু ধরে নিচ্ছে কেন? আমরা কেন থার্ড জানুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করছি না?’’
কিন্তু মুদগলের চিন্তার শরিক প্রায় নেই বললেই হয়। গড়পড়তা অংশ ধরে নিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনের চালচিত্র আমূল বদলে যেতে বসেছে। প্রশাসকেরাই বোর্ড নিযুক্ত সিইও বা ম্যানেজারদের সঙ্গে মিশে ক্রিকেট চালাবে। অপেশাদার কর্তাদের আশি বছর ধরে ছড়ি ঘোরানোর ইতিহাস এ বার শেষ অধ্যায়ে ঢুকে গেছে। হয়তো বা শেষ পাতায়।
বাউন্সারের মুখে অনুরাগ
• শপথ নিয়ে হলফনামায় মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ার অভিযোগে বোর্ড প্রেসিডেন্ট অনুরাগ ঠাকুরের হাজতবাসের আশঙ্কা।
• আদালতের কাছে লিখিত ভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা না চাইলে অনুরাগের বাঁচা মুশকিল।
• জানুয়ারির পরে বোর্ড প্রশাসনে গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারেন অনুরাগ, অজয় শিরকে-সহ শীর্ষস্থানীয় বোর্ডকর্তারা।
প্রশাসক হিসেবে লোঢা কমিটির পছন্দের নামগুলোর মধ্যে ছিলেন মোহিন্দর অমরনাথ। বিসিসিআই তাঁর নামে আপত্তি করেছে। তাই এ বার আদালত বিসিসিআই-কেই বলেছে তাদের পছন্দের কিছু নাম ভাবি প্রশাসক হিসেবে সুপারিশ করতে। রাজ্য ক্রিকেট মহলের অনন্ত কৌতূহল সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নাম কি সেই তালিকায় থাকবে?
বাংলার আরও একজনের কথা বোর্ডের এই মহাসঙ্কটে মনে পড়ছিল অনেকের। তিনি জগমোহন ডালমিয়া আজ বেঁচে থাকলে লোঢার বাউন্সার এবং তার পর ঠাকুরের গুঁতো কী ভাবে সামলাতেন?
ডালমিয়ার এক সহযোগী বলছিলেন, ‘‘এমন পরিস্থিতিই তৈরি হত না। এরা ঔদ্ধত্য দেখাতে গিয়ে কোর্টকে চটিয়ে দিয়েছে। মারাত্মক ট্যাকটিক্যাল ভুল। জগুদা ফর্মে থাকলে আগেই বিনয়ী হয়ে বেশ কিছু দাবি মেনে নিতেন। আদালত নরম-সরম হয়ে পড়ত।’’
স্বপ্নের ক্রিকেট ম্যাচের মতো এরও কোনও সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। তর্কের বিষয়। সেই তর্ককে উড়িয়ে দিয়েই যে বোর্ডের পুরনো কাঠামো ইতিহাস হয়ে যেতে চলেছে, তা নিয়ে ভাবার কোনও অবকাশ নেই। ইতিহাস বদলাচ্ছেই।