প্রথমে স্তম্ভিত। ধীরে-ধীরে রক্তশূন্য। সব শেষে তড়িৎস্পৃষ্ট!
ভদ্রলোক স্কাই স্পোর্টস সাংবাদিক এবং উপরের পুরোটাই তাঁর মুখের ধারা-বিবরণ। এতক্ষণ রাজকোট প্রেসবক্স লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে দিব্যি সিগারেট টানছিলেন। ন্যূনতম ধারণা ছিল না সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে ফের কী তুলকালাম ঘটিয়েছে বোর্ড। জানতেনও না, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে শুরু হতে টেস্ট সিরিজকে কী ভাবে এক ঝটকায় চরম অনিশ্চয়তার চাদরে ঢেকে দিয়েছে ভারতীয় বোর্ড। বলে দিয়েছে, ফতোয়া তুলে লোঢা কমিশন ম্যাচ আয়োজনের টাকা দিলে সিরিজ হবে, নইলে নয়।
দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ ভারতীয় মিডিয়াকুলের কাছ থেকে খবরটা পেয়ে স্কাই স্পোর্টস সাংবাদিক হাতের সিগারেটটা আর শেষ করলেন না। বরং দেখা গেল, উদভ্রান্ত ভাবে ফোন ঘোরাতে শুরু করে দিয়েছেন। স্বাভাবিক, অতীব স্বাভাবিক। ক্রু টিম চলে এসেছে। নাসের হুসেনের মতো ভাষ্যকাররা চব্বিশ ঘণ্টা আগে থেকে স্টেডিয়ামে ঘুরপাক খাচ্ছেন। এই অবস্থায় সিরিজ বাতিল মানে তো অসীম ক্ষতি। কোটি-কোটি টাকা জলে! সবচেয়ে যেটা টেনশনের, শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে পারে বিন্দুমাত্র আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে না। বলারই কেউ নেই।
ভারতীয় টিম প্র্যাকটিস করে বেরিয়ে গিয়েছে। টিম কোহালি অদৃশ্য।
ইংল্যান্ড নির্ধারিত সূচির পর একঘণ্টা অতিক্রান্ত। সময় এগোচ্ছে, জল্পনা বাড়ছে, প্রশ্ন উঠছে ইংল্যান্ড আদৌ সব শুনে-টুনে আসবে তো?
সৌরাষ্ট্র ক্রিকেট সংস্থা মহাকর্তা নিরঞ্জন শাহের কাছে একটার পর একটা ফোন যাচ্ছে আর অবিশ্রান্ত ভাবে তিনি জনে-জনে একটাই কথা বলে যাচ্ছেন। খবর নেই। কোনও খবর নেই।
ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের বছরের চুরাশি বছরের ইতিহাসে এ জিনিস অভূতপূর্ব। যেখানে আকাশ-আবহাওয়া সব ঠিকঠাক থেকেও অনিশ্চয়তায় ঢাকা পড়ছে ম্যাচ, বিকেল চারটে বেজে যাচ্ছে (তার কাছাকাছি সময়ই সুপ্রিম কোর্ট ম্যাচ আয়োজনের টাকা দিতে বলল) আকস্মিক দুর্যোগ সরিয়ে প্রতিশোধের কাহিনিতে ঢুকে পড়তে।
এক নয়। একজোড়া প্রতিশোধ। যা মঙ্গলবারের রাজকোটের একমাত্র কাহিনি হওয়া উচিত ছিল।
ভারত এবং ভারত অধিনায়ক।
হালফিলে ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজ নিয়ে চর্চা উঠলে বারবার একটা কথা চতুর্দিকে উঠে আসছে। ইংল্যান্ড-৩: ভারত-০। বিচার্য শেষ তিনটে সিরিজ। দু’বার বিলেতে, একবার নিজ দেশে। ভারতের রেজাল্ট শুধু অপরিবর্তিত। হার, হার এবং শুধু হার। ঘটনা হল, শুধু ভারত নয়। ভারতীয় টেস্ট অধিনায়কও এই অপমানের সঙ্গে সমান জড়িয়ে। আজ পর্যন্ত ৪৮ টেস্ট খেলে কোহালির সেঞ্চুরি তেরো, ব্যাটিং গড় ৪৫.৫৬। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেটা শুধু অবিশ্বাস্য ২০.১২! সেঞ্চুরি? ন’টা ম্যাচে মোটে এক! আসলে গত ইংল্যান্ড সফর দুঃস্বপ্ন গিয়েছিল কোহালির। অফস্টাম্পের বাইরের ডেলিভারিতে আউট হচ্ছিলেন বারবার। জেফ্রি বয়কট নিজের কলামে দু’দিন আগেও ইংরেজ বোলারদের আকারে-ইঙ্গিতে পরামর্শ দিয়েছেন, সেই দুঃস্বপ্ন ফিরিয়ে আনতে। বয়কট চাঁচাছোলাঅফ-অনে বিরাটের রান আটকে দাও। চক্রব্যূহে বন্দি করে ফেলো। ভুল করতে বাধ্য করো। বিরাট আউট হলে ভারতও ধরাশায়ী হবে।
বয়কটের উত্তরসূরিরা ভাগ্যিস এ দিন ভারতীয় প্র্যাকটিসের সময় মাঠে ছিলেন না। নইলে ভারত অধিনায়কের উত্তর নামক নক-আউট পাঞ্চে তাঁরা আগাম ধরাশায়ী হতে পারতেন। এমনিতেও রাজকোট বাইশ গজের যা নির্যাস, তাতে নানাবিধ ‘পাঞ্চের’ বন্দোবস্ত সেখানে থাকছে। না, দুরন্ত ঘূর্ণি নয়। কিন্তু শোনা গেল, ঘুরবে। সময়ে ভালই ঘুরবে। অ্যালিস্টার কুকদের দেখা গেল, অনুশীলনের সিংহভাগটা স্পিন বোলিং খেলার পিছনে খরচ করতে। নতুন কিছু নয়। ভারত সফররত সব সাহেব টিমই করে। গত টেস্ট সিরিজে নিউজিল্যান্ড করেছে। এখন ইংল্যান্ড করছে। তফাতের মধ্যে, নিউজিল্যান্ড শুধু অশ্বিন-জাডেজা খেলেছে। কুকদের সামনে সেখানে আবার অমিত মিশ্রকে ছেড়ে দেওয়ার রক্তচক্ষুও থাকছে।
আসল ‘রক্তচক্ষু’ যদিও মিশ্র নন। ভারত অধিনায়ক স্বয়ং। বিরাটের সাংবাদিক সম্মেলনে মাঝেমধ্যে আশ্চর্য সব প্রশ্ন হয়। এ দিনও হল। একজন দুম করে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ক্যাপ্টেন, রাজকোট টেস্ট চলবে কত দিন? পুরো পাঁচ যাবে? শুনে বিরাট বললে বটে যে তিনি বক্সিং লড়ছেন না, বাউটের সংখ্যাও তাই বলতে পারবেন না। কিন্তু ঘটনা হল, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তাঁকে মাইক টাইসনের সমগোত্রীয়ই মনে হয়েছে! বিরাটকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, গত ইংল্যান্ড সফরে তাঁর খারাপ ফর্ম নিয়ে। শুনে ভারত অধিনায়ক তির্যক ভাবে বললেন যে, ইংল্যান্ডকে তিনি আলাদা ধন্যবাদ দিতে চান! ব্যাটসম্যান বিরাটের কোথায় কোথায় উন্নতি প্রয়োজন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। পরে কেউ একটা আবার জিজ্ঞেস করলেন, ইংল্যান্ড বারবার নিজেদের ‘আন্ডারডগ’ বলছে। ভারতকে এগিয়ে রাখছে। সত্যিই ইংল্যান্ড ‘আন্ডারডগ’? উত্তর দ্রুত ছিটকে এল “কোনও কোনও টিম চেষ্টা করে সিরিজ শুরুর আগে নিজেদের লো প্রোফাইলে রাখতে। তার পর চমক দিতে চায়। অতীতে ও সব আমরা অনেক দেখেছি। আমরা জানি, আমাদের কী করতে হবে!”
জবাব, একে জবাব বলে? তবে আলির ঘুঁষি কী?
নাহ্, জবাব-টবাব নয়। এ পরিষ্কার আপারকাট অ্যান্ড নক আউট!