মিডিয়া বাসে গুলি, নিরাপত্তা নিয়ে এখন নতুন উদ্বেগ রিওয়

সামরিক নিরাপত্তার ‘নিশ্ছিদ্র’ ঘেরাটোপ ভেদ করে অলিম্পিক্সের চার দিনের মাথায় গুলি চলল রিওয়! আর প্রথম আক্রমণটাই হল সাংবাদিকদের বাসের উপর। ভাঙল জানালা। তবে এটা জঙ্গি হানা না ড্রাগ মাফিয়াদের কাজ, সেটা নিয়ে ধন্ধ রয়েছে।

Advertisement

রতন চক্রবর্তী

রিও দে জেনেইরো শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৬ ০৪:২৪
Share:

গুলিতে ভেঙে গিয়েছে কাঁচ

সামরিক নিরাপত্তার ‘নিশ্ছিদ্র’ ঘেরাটোপ ভেদ করে অলিম্পিক্সের চার দিনের মাথায় গুলি চলল রিওয়!

Advertisement

আর প্রথম আক্রমণটাই হল সাংবাদিকদের বাসের উপর। ভাঙল জানালা। তবে এটা জঙ্গি হানা না ড্রাগ মাফিয়াদের কাজ, সেটা নিয়ে ধন্ধ রয়েছে। বাস্তব যা-ই হোক, ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ চলার সময় এই ঘটনায় আতঙ্ক যেমন ছড়িয়েছে, তেমনি অস্বস্তি বেড়েছে ব্রাজিলের অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট মাইকেল টেমারের প্রশাসনের। চরম অপ্রস্তুত রিও গেমসের সংগঠকরাও। যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন, গুলিই চলেছে না অন্য কিছু, সেটা তদন্ত করা হচ্ছে। আক্রান্ত সাংবাদিকরা অবশ্য একশো ভাগ নিশ্চিত, গুলিই চলেছিল।

মঙ্গলবার যখন হামলা হয় স্থানীয় সময়ে তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছে। ডিওডোরো বাস্কেটবল সেন্টার থেকে বারো জন সাংবাদিককে নিয়ে বাসটি ফিরছিল মিডিয়া সেন্টারে। বাসের সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, ব্রাজিলের কুখ্যাত বস্তি এলাকা এবং মাদক-মাফিয়ার স্বর্গ বলে পরিচিত গড ফাভেলার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গুলি চলতে শুরু করে। জায়গাটা পাহাড়ি। ফলে আক্রমণকারীদের পক্ষে আড়াল থেকে গুলি করা সহজ ছিল। গুলিতে একটি জানালার কাচ ফুটো হয়ে যায়, ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ে অন্য একটি জানালা। ছিটকে আসা কাচের টুকরোয় আহত হন তিন জন। তবে গুলি চলছে বুঝতে পেরে সিট ছেড়ে বাসের ভিতর মাটিতে বসে পড়েছিলেন সাংবাদিকরা। তাতে আরও বড় বিপদ এড়ানো যায়। তবে ড্রাইভার নাকি প্রথমটায় কিছু বুঝতে পারেননি। হইচই শুনে বাস থামিয়ে দিয়েছিলেন। আতঙ্কিত সাংবাদিকরা চিৎকার করেতে থাকেন, ‘‘গাড়ি থামিও না, চালিয়ে যাও।’’ বিপদ বুঝে ড্রাইভার বাসটি চালিয়ে কিছু দূর এগিয়ে যান। তার পর বাস থামিয়ে পুলিশে খবর দেন। পুলিশের এসকর্ট গাড়ি এসে বাদবাকি রাস্তা পাহারা দিতে দিতে বাস ফিরিয়ে আনে মিডিয়া সেন্টারে।

Advertisement

ভারতীয় সাংবাদিকেরা সেই সময় মিডিয়া সেন্টারেই ছিলেন। স্থানীয় সময় রাত ন’টা নাগাদ বক্সিং রিংয়ে ভারতের বিকাশ কৃষাণ যাদবের জয় দেখে তাঁরা সবে ফিরেছেন। যখন মিডিয়া সেন্টারে ঢোকে আক্রান্ত বাসটি। সঙ্গে সঙ্গে হইচই পড়ে যায়। গুলি চলেছে শুনে ছুটে যান সবাই। গিয়ে দেখা যায় বাসের দরজার ঠিক উল্টো দিকে, অর্থাৎ ডান দিকের একটি জানালার কাচে ফুটো, যার চারপাশের কাচ পুরো ফেটে গিয়েছে। ভেঙেছে অন্য একটি জানালার অনেকটা অংশ। চোট লেগেছে তিন জনের। এক জনের ভ্রূ-র নীচে কেটেছে। অন্য জনের হাতে কব্জির কাছে চোট। বাসের ভিতরেও বিছিয়ে পড়ে কাচের টুকরো।

নিজেদের অভিজ্ঞতা শোনাতে গিয়ে তখনও থরথরিয়ে কাঁপছেন আর্জেন্তিনীয় সাংবাদিক গাস্টন সেইঞ্জ। ভয়ার্ত গলায় বললেন, ‘‘মরেই যেতাম আজ!’’ তাঁকে ঘিরে অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদের ভিড়। গাস্টন জোর দিয়ে বলছিলেন, ‘‘আমরা গুলির শব্দই পেয়েছিলাম। আক্রমণ হয়েছে বুঝে সবাই মাটিতে শুয়ে পড়ি। ভেবেছিলাম আরও গুলি চলবে। হয়তো চলেওছে। বাসটা দ্রুতগতিতে যাচ্ছিল বলে লাগেনি।’’

এই ঘটনায় বিশ্বমঞ্চে ব্রাজিলের গায়ে কালির ছিটে লাগবে, সম্ভবত এই ভয়ে রিও গেমসের সংগঠকরা গুলি চলেছে বলে এখনও মানতে নারাজ। তাঁদের পক্ষে মারিও আন্দ্রেজা লিখিত বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ‘‘আমরা তদন্ত করে দেখছি গুলি চলেছে কি না।’’ অনেকে মনে করছেন, যা হয়েছে সেটা হাল্কা করে দেখানোর চেষ্টায় এমন তত্ত্ব খাড়া করা হতে পারে যে গুলি নয়, আসলে ঢিল ছোড়া হয়েছিল বাসে।

জঙ্গি হানার আর অলিম্পিক্স বিরোধী বিক্ষোভের ভয়ে এমনিতেই রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্র রিওর রাস্তাঘাট। সর্বত্র সেনা। যাঁরা পর্তুগিজের বাইরে বিদেশি ভাষা বোঝেন না। রাস্তায় টহল সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক আর অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত নানা সেনা যানের। এ দিকে, নিরাপত্তার কড়াকড়িতে প্রাণ ওষ্ঠাগত দর্শক, সাংবাদিকদের। যে কোনও কেন্দ্রের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে আটকে দেওয়া হচ্ছে গাড়ি। চেক পোস্ট পেরিয়ে বাকিটা হাঁটতে হচ্ছে। গত আটটি অলিম্পিক্স কভার করে আসা সাংবাদিক বা কর্তারা মনে করতে পারছেন না এর আগে কোথাও সেনা প্রহরার এমন বাড়াবাড়ি আর দেখেছিলেন কি না। বেজিংয়েও সেনা ছিল। কিন্তু রিওর মতো হয়রানির শিকার হননি কেউ।

এ দিকে, অলিম্পিক্স বিরোধী বিক্ষোভের ঢেউ সামলানোর মরিয়া চেষ্টায় টেমার প্রশাসন নতুন ফতোয়া জারি করেছিল— অলিম্পিক্স কেন্দ্রের আশেপাশে বিক্ষোভ হচ্ছে দেখলেই গ্রেফতার করা হবে। বিক্ষোভকারীরা যার বিরুদ্ধে আদলতে যান। তাতে এখানকার ফেডারেল কোর্ট প্রশাসনের বিরুদ্ধেই রায় দিয়েছে। বলেছে, ‘‘মানুষের কথা বলার অধিকার কেউ কেড়ে নিতে পারে না। বর্ণবিদ্বেষ বাদে যে কোনও বক্তব্য লেখা টি শার্ট পরে মাঠে ঢোকা যাবে। দেওয়া যাবে স্লোগানও।’’ ব্রাজিলে মাঝেমধ্যেই পাহাড়ি ঝড় আছড়ে পড়ে। গতিবেগ ঘণ্টায় সত্তর-আশি কিলোমিটার। শোঁ শোঁ আওয়াজ। অলিম্পিক্স বিরোধী বিক্ষোভও যেন সেই ঝড়ের মতোই বইছে।

এমনিতে ঝড় ব্যাপারটা এখানকার লোকেদের গা-সওয়া। কিন্তু আদালতের রায়ে অপ্রত্যাশিত ধাক্কা লেগেছে টেমার প্রশাসনের গায়ে। ফেডারেল কোর্ট রায়ে বলেছে, ‘‘বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করলে বড় টাকা জরিমানা হবে সরকারের’’ এতে বিক্ষোভ যে আরও ছড়াবে বলাই যায়। শোনা যাচ্ছে আজ বুধবার থেকে নাকি হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নামবেন। এ দিকে, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটির নিয়মানুযায়ী স্টেডিয়ামে কোনও রকম বিক্ষোভ বা স্লোগান নিষিদ্ধ। সেটা হলে কড়া ব্যবস্থা নিতে পারে কমিটি। এমনকী বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে অলিম্পিক্সই। এই অবস্থায় প্রশাসন কি করে সেটা দেখার।

গুলিকে না হয় ইট বলে চালানো গেল জোর করে। কিন্তু বিক্ষোভ আর অলিম্পিক্স কমিটির নিয়ম, বিপরীত মেরুর এই দুই ঝড় কীভাবে একসঙ্গে সামলাবেন টেমার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন