সার্ধশতবর্ষের সেরার তাজে পঞ্চপাণ্ডবের ব্যতিক্রমী সন্ধ্যা

অজিত ওয়াড়েকরের আমলে ইডেন গ্যালারি নিয়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে একটা চুটকি বহুল প্রচলিত ছিল। ইডেনে টিকিট কেটে নাকি ম্যাচ দেখতে আসে পঁচিশ হাজার, পঁচিশ হাজার যায় ‘কমপ্লিমেন্টারি’, পরের পঁচিশ পুলিশ আর শেষের পঁচিশ স্রেফ ‘উইদাউট টিকিট’! ব্যস, সবশুদ্ধু এক লক্ষ! বিষেণ সিংহ বেদী ইডেনে নিজের অভিষেক টেস্টের নামকরণও করেছেন। ‘ব্যাপটিজম বাই ফায়ার!’ কারণ আর কিছুই না, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে নেমেই তাঁকে দেখতে হয়েছিল টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে পুলিশ, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে গ্যালারিতে।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০২:০২
Share:

সিএবি-র মঞ্চে ডালমিয়ার সঙ্গে ক্রিকেট তারকারা। রয়েছেন সৌরভ, হোল্ডিং, চন্দ্রশেখর, বেদী, বেঙ্গসরকর, ওয়াড়েকর ও প্রসন্ন। ছবি: উত্‌পল সরকার

অজিত ওয়াড়েকরের আমলে ইডেন গ্যালারি নিয়ে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে একটা চুটকি বহুল প্রচলিত ছিল। ইডেনে টিকিট কেটে নাকি ম্যাচ দেখতে আসে পঁচিশ হাজার, পঁচিশ হাজার যায় ‘কমপ্লিমেন্টারি’, পরের পঁচিশ পুলিশ আর শেষের পঁচিশ স্রেফ ‘উইদাউট টিকিট’! ব্যস, সবশুদ্ধু এক লক্ষ!

Advertisement

বিষেণ সিংহ বেদী ইডেনে নিজের অভিষেক টেস্টের নামকরণও করেছেন। ‘ব্যাপটিজম বাই ফায়ার!’ কারণ আর কিছুই না, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে নেমেই তাঁকে দেখতে হয়েছিল টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে পুলিশ, দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে গ্যালারিতে।

বেঙ্গালুরু-নিবাসী এরাপল্লি প্রসন্ন কর্নাটকী সমাজকে নাকি মাঝেমধ্যেই একটা পরামর্শ দেন। আদর-আপ্যায়ন কী, আতিথেয়তাই বা কাকে বলে, বন্ধুদের শিখতে বলেন কলকাতার থেকে। কাঠখোট্টা ‘কসমোপলিটান’ বলে নিয়মিত কটাক্ষ করেন নিজের শহরকে। জীবন নাকি একমাত্র কলকাতাতেই পাওয়া যায়, ইডেনে পাওয়া যায়।

Advertisement

‘লর্ড অব দ্য লর্ডস’কে ইডেনে নামার আগে দু’টো ব্যাপার বলে দেওয়া হয়েছিল ড্রেসিংরুম থেকে। রান করতেই হবে, অজুহাত চলবে না। আর দেখতে হবে ফিল্ডিংটাও যাতে উচ্চমার্গের হয়। নইলে উচ্চমার্গের কিছু শব্দগুচ্ছ গ্যালারি থেকে পরের পর এমন উড়ে আসবে যে, সামলানো কঠিন হবে। ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার এত দিন পরেও দিলীপ বেঙ্গসরকরকে দেখলে আন্দাজ পাওয়া যায়, ইডেনে নামার সময় কতটা টেনশনাক্রান্ত থাকতেন। মঞ্চে তো বটেই, মঞ্চ থেকে নেমেও বলছিলেন, “আমি কিন্তু সে দিন নেমে ডোবাইনি। সেঞ্চুরি করেছিলাম। পরে ক্যাপ্টেন হিসেবেও করেছি। ’৮৭-র ক্যাপ্টেন হিসেবে সেঞ্চুরিটা সেরা। আর হ্যাঁ, ফিল্ডিংয়ের জন্যও কখনও ইডেনের গালাগাল খেতে হয়নি আমাকে!”

ইডেনে ক্রিকেটের সার্ধশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে একে একে বেশ কয়েকটা অনুষ্ঠান করে ফেলল সিএবি। চান্দু বোরডে এসেছেন, ভারতীয় ক্রিকেটের পূর্বতন ‘প্রিন্স’ সেলিম দুরানির আভিজাত্য দেখেছে বাংলা। কিন্তু প্রভাবে ও ব্যপ্তিতে নিঃসন্দেহে সেরার তাজ দিতে হবে মঙ্গলবারের সান্ধ্য উত্‌সবকে। ভারত-পাকিস্তানের রজতজয়ন্তী বর্ষ ছেড়ে দিলে এত তারকা সমাগম আর কবে দেখেছে ইডেন?

নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। আর কবে এমন বিরল মুহূর্তের রঙিন রামধনু সৃষ্টি হয়েছে সিএবি-অনুষ্ঠানকে ঘিরে, সেটা নিয়েও অনিশ্চিত থেকে যেতে হবে। উপলক্ষ ছিল, ইডেনের উপর ফার্স্ট ডে কভার এবং দু’টো ডাকটিকিট প্রকাশ। যার একটায় সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়ার ছবিও আছে। সেই উপলক্ষ ঘিরে ভারতীয় স্পিনের স্বর্ণযুগের তিন প্রতিভূকে এক মঞ্চে, এক সঙ্গে উঠে আসতে দেখল ইডেন। দেখল, ইংল্যান্ডে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ী ভারত অধিনায়কের সঙ্গে ইংল্যান্ডে দেশের সর্বকালের অন্যতম দাপুটে ব্যাটসম্যানকে। শুধু তাই? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিদায়ী ভাষণে বেশ খোশমেজাজেই হাততালি দিতে দেখা গেল বিষেণ সিংহ বেদীকে। ওয়াড়েকর আবার শোনালেন মাইক গ্যাটিংকে এক বার ‘প্রন কারি’ খাইয়ে ম্যাচে বোল্ড করার তাঁর অপচেষ্টার গল্প! তখন তিনি ইন্ডিয়ার ক্রিকেট ম্যানেজার। এরাপল্লি প্রসন্ন স্বর্ণযুগের ত্রয়ীর সাফল্যের রহস্য নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে খুব সহজ একটা উত্তর দিলেন, “উইকেট!”


ডাকটিকিটে জগমোহন ডালমিয়া।

বেদী স্বভাবসিদ্ধ মেজাজেই আবির্ভূত হয়েছেন। মঞ্চে বক্তৃতা দিতে উঠেই এমন একটা কথা বলে বসেছেন যা শুনে উপস্থিত সাংবাদিকদের হাসি চওড়া হল। কিছুই না, প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক বুঝতে পারেন না দেশের সবচেয়ে উত্তেজক ক্রিকেট-সেন্টার হওয়ার সত্ত্বেও ভারতীয় ক্রিকেটের ‘মস্তিষ্ক’ কেন কলকাতা নয়। আরও বুঝতে পারেন না যে, বোর্ডের জন্ম যখন নয়াদিল্লির রোশনারা ক্লাবে, তখন সেটা কী ভাবে ‘হাইজ্যাক’ হয়ে তামিলনাড়ু চলে গেল! অনুষ্ঠান শেষেও দু’একটা উড়ে এল। চলতি ভারত-শ্রীলঙ্কা সিরিজ নিয়ে, “ধুস, এটা আবার সিরিজ নাকি? শ্রীলঙ্কা তো আগেই শুয়ে পড়েছে,” মুরলীধরনকে সিএবির কোচ করে আনা নিয়ে তির্যক হাসিতে, “সিএবিকে ঈশ্বর রক্ষা করুন,” বলে গেলেও সেগুলো অনুষ্ঠান-সংক্রান্ত ছিল না, তালও তাই কাটেনি। বরং মুহুর্মুহু হাসি আর হাততালির সমুদ্রগর্জন মঙ্গলবার সন্ধেয় শুনেছে ইডেন। সেটা প্রসন্নর গর্বিত ভাবে ‘টাইগারের পর আমিই কিন্তু এ শহরের দ্বিতীয় জামাই’ বলে যাওয়াতেই হোক কিংবা মঞ্চে উঠে সৌরভের কুণ্ঠাভরে, “সরি, আসতে একটু দেরি হল। রুজি-রোজগারে ব্যস্ত ছিলাম,” শুনে। ওয়াড়েকর ‘ইডেনে ক্রিকেটের দেড়শো বছর’ শব্দবন্ধ শুনে তাঁর আবার দু’টো ঘটনার কথা মনে পড়ল। প্রথমটা, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দশ রানে জেতা। স্মৃতি বৈরিতা করায় সালটা মনে করতে পারলেন না। দ্বিতীয়টা পারলেন, হিরো কাপ ফাইনাল। আজহারের থেকে কিশোর তেন্ডুলকরের বল চেয়ে নেওয়া।

দেখলে শুধু একটা ব্যাপার নিয়েই খচখচ করবে। ভারতীয় ক্রিকেটের ‘পঞ্চপাণ্ডব’কে নিয়ে এমন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হল, বুধবার সকালে স্পিন ত্রয়ীকে নিয়ে আবার টক শো, বিকেল পাঁচটায় শহরে অপসারিত বোর্ড প্রেসিডেন্ট নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনের আবির্ভাব, আসন্ন বোর্ড নির্বাচন নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় কর্তাদের সঙ্গে সম্ভাব্য বৈঠক জাঁকজমক, উত্তেজনার যা বহর, তাতে কেন্দ্রে দুর্ধর্ষ একটা ম্যাচ থাকলে আবহকে প্রাসঙ্গিক মনে হত।

দুর্ভাগ্য ইডেনের, বৃহস্পতিবারের ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচটাকেই তো সবচেয়ে জোলো মনে হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন