লা মাসিয়ার গ্র্যাজুয়েটদের তালিকায় নাম নেই মেসির

হঠাৎ করে মনে হতে পারে কোনও হাই সিকিউরিটি জোনে ঢুকে পড়েছেন। তিন-চার তলা সমান বিশাল ফেন্সিং। সামনের ভারি লোহার গেটটা খুলবে তখনই, যখন ভিতরে বসে থাকা নিরাপত্তারক্ষী আপনার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সুইচটা টিপবে।

Advertisement

কৌশিক দাশ

বার্সেলোনা শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৬ ০৩:১৬
Share:

—ফাইল চিত্র।

হঠাৎ করে মনে হতে পারে কোনও হাই সিকিউরিটি জোনে ঢুকে পড়েছেন।

Advertisement

তিন-চার তলা সমান বিশাল ফেন্সিং। সামনের ভারি লোহার গেটটা খুলবে তখনই, যখন ভিতরে বসে থাকা নিরাপত্তারক্ষী আপনার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে সুইচটা টিপবে। বিল্ডিংয়ে ঢোকার আগে এ রকম আরও কয়েকটা গেট আছে। লবিতে রয়েছে টিভি মনিটর। যেখানে গোটা পনেরো ফ্রেমে মুহূর্তে মুহূর্তে ধরা পড়ছে কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে।

যদি অন্তত লোহার ফাটকটা পেরিয়ে বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াতে পারেন, তা হলে বুঝবেন আপনি এসে গিয়েছেন ‘সেন্ত্রো দে ফরমাসিও ওরিয়ল তরত’-এ।

Advertisement

স্বাগত। আপনি সত্যিই পৌঁছে গিয়েছেন লা মাসিয়ায়। লিওনেল মেসির ধাত্রীগৃহে।

বার্সেলোনা অ্যাকাডেমিতে পা দিয়ে এত দূর পর্যন্ত যা দেখতে পেলাম, তা অভাবনীয় হলেও অকল্পনীয় নয়। অকল্পনীয় ব্যাপারটা দেখা গেল লা মাসিয়ার ভিতরে ঢুকে।

একটু এগোলেই করিডরের দেওয়ালে ঝুলছে বিশাল একটা বোর্ড। অ্যাকাডেমি তৈরির প্রথম বছর থেকে এখন পর্যন্ত অ্যাকাডেমি ‘গ্র্যাজুয়েট’দের বিশাল এক তালিকা। বছর ধরে ধরে। কে নেই সেখানে— স্প্যানিশ হোক কী বিদেশি, সংখ্যা গুনে শেষ করতে হলে অনেকটা সময়ই চলে যাবে।

নেই শুধু তাঁর নামটা। খুঁজে পাওয়া গেল না অ্যাকাডেমির সবচেয়ে বিখ্যাত ছাত্রের নামই।

লিওনেল মেসির জায়গা হয়নি লা মাসিয়া ‘গ্রাজুয়েট’দের তালিকায়!

মেসির জায়গা হয়নি, কারণ রাজপুত্রের জন্য নিয়ম শিথিল করতে রাজি হয়নি ক্লাব কর্তৃপক্ষ।

নিয়মটা কী?

তোমার নাম তখনই তালিকায় উঠবে, যখন তুমি পুরোদস্তুর অ্যাকাডেমিতে থেকে ট্রেনিং করবে। চব্বিশ ঘণ্টা। আর্জেন্তিনার রোজারিও থেকে মেসি পরিবার বার্সেলোনায় চলে এলেও ছেলেকে কখনও ঘরছাড়া করেননি মেসির বাবা-মা। ২০০০ সাল থেকে ছোট্ট লিও তাই বাবা-মার সঙ্গেই আসত অ্যাকাডেমিতে। ট্রেনিং শেষ হলে ফিরে যেত কাছের অ্যাপার্টমেন্টে। অ্যাকাডেমি হোস্টেলে কোনও দিন থাকা হয়নি মেসির।

লা মাসিয়া ঘুরিয়ে দেখানোর দায়িত্ব যিনি নিয়েছিলেন, বার্সেলোনার সেই প্রেস অফিসার বলছিলেন, ‘‘নিয়ম, নিয়মই। মেসি যদি এখানে চব্বিশ ঘণ্টা থেকে ট্রেনিং করত, তা হলে ওই বোর্ডে মেসির নামটাও থাকত।’’

তবে মেসির স্মৃতি জড়িয়ে আছে বিভিন্ন ফটো ফ্রেমে। কোথাও ব্যালন ডি’অর হাতে, কোথাও খুদে ছাত্র হয়ে খাওয়ার টেবলে বসে। তবে এর বেশি কিছু নয়। কারণ মেসি-ইনিয়েস্তা-পিকেরা যেখান থেকে উঠে এসেছেন, এটা সেই বিল্ডিং নয়। কাম্প ন্যু-র কাছে সেই পুরনো লা মাসিয়া বিল্ডিং এখন বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ২০১১ থেকে অ্যাকাডেমি চলে এসেছে বার্সেলোনার ট্রেনিং গ্রাউন্ডে। যা এখন টিটো ভিলানোভা কাম্প। শোনা গেল, জাদুঘর-টর নয়, কোনও কর্পোরেট অফিস হয়ে যেতে পারে ফুটবল ইতিহাসের মহার্ঘ্য সেই সৌধ।

লা মাসিয়ায় নিয়ম আরও আছে। নিয়মের জালেই অ্যাকাডেমি যেন ফোর্ট নক্স। কিন্তু কেন এত নিরাপত্তা আর কড়াকড়ি?

আসলে বার্সেলোনা জানাতে দিতে চায় না, তারা কী হিরে-মানিক তুলে আনছে। গোটা বিশ্বের আড়ালে, মিডিয়াকে অন্ধকারে রেখে চলছে ফুটবলার তৈরির সাধনা। এখানে কে কী করছে, কোন ফুটবলারকে কী ট্রেনিং করানো হচ্ছে, কার জন্য কী ডায়েট চার্ট, ফিজিক্যাল রুটিন— তা পুরোপুরি গোপন রাখছে বার্সা। নিজেদের মেডিক্যাল সেন্টার আছে। সেখানেই খুদে শিক্ষার্থীদের জরিপ করা হয় প্রথমে। দেখা হয়, কার শরীর কোন খেলার উপযুক্ত। তার পরে অবশ্যই স্কিল। এবং দাঁড়িপাল্লায় ফেলে মাপার পর খুদেদের ঠেলে দেওয়া হয় এক-একটা ডিসিপ্লিনে।

এবং বার্সেলোনা অ্যাকাডেমি শুধু ফুটবলেই আটকে নেই। রয়েছে আরও পাঁচটা বিভাগ— হ্যান্ডবল, বাস্কেটবল, রোলার হকি, ফুটসল এবং মেয়েদের ফুটবল। বার্সেলোনা আটকে নেই শুধু প্রথাগত কোচিংয়েও। তারা বিশ্বাস করে, খেলার পাশাপাশি পরিপূর্ণ মানুষ তৈরির কাজটাও অ্যাকাডেমির। যেখান থেকে জন্ম ‘৩৬০ ডিগ্রি কোচিং’ ধারণার। শুধু ফুটবলার বা বাস্কেটবলার বা হ্যান্ডবলার তৈরি করেই থেমে যাবে না ক্লাব। তার শিক্ষার দায়িত্বটাও অ্যাকাডেমি নেবে। কথাটা যে এতটুকু বাড়িয়ে বলা হচ্ছে না, বোঝা গেল একটু পরে। খুদে বাস্কেটবলারদের প্র্যাকটিস দেখে বেরিয়েই চোখে পড়ল একটা ঘর। জনাকুড়ি ছাত্র নিয়ে ক্লাস চলছে। স্বাভাবিক ভাবেই মনে হতে পারে হয়তো কোচের স্ট্র্যাটেজি ব্রিফিং বা কাউন্সেলিং চলছে। কাচের দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি মারতে ভুলটা ভাঙল। কোচ কোথায়, এ তো রীতিমতো রাশভারি মাস্টারমশাই। আর ভিতরে চলছে অঙ্কের ক্লাস!

‘৩৬০ ডিগ্রি কোচিং’-এর আর একটা দিক আছে। সেটা হল, ফুটবলার জীবন ফুরিয়ে গেলেই অ্যাকাডেমির সঙ্গে প্লেয়ারের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে না। ইনিয়েস্তা যদি অবসর নেন আর কয়েক বছর পরে, তা হলে কিন্তু তাঁকে অন্য ভূমিকায় দেখা যেতেই পারে লা মাসিয়ায়। হয় কোচ, নয় কনসাল্ট্যান্ট, নয়তো অন্য কোনও দায়িত্বে। কারণ এক জন লা মাসিয়া গ্র্যাজুয়েটের জন্ম থেকে মৃত্যু— পুরো সময়টাই পাশে থাকতে চায় ক্লাব।

লা মাসিয়ায় আরও একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখা গেল। সকালে এখানে প্র্যাকটিস হয় না, কারণ বাচ্চাদের স্কুলে যেতে হয়। স্থানীয় সময় তখন সন্ধে সাতটা পার হয়ে গিয়েছে। দূরের পাহারের কোলে সূর্য ডুবেছে। কিন্তু অন্তত একটা প্রজন্মের ট্রেনিং না দেখে অ্যাকাডেমি ছাড়ার প্রশ্ন ছিল না।

একটু পরেই দেখা গেল, এক ঝাঁক খুদে ফুটবলার নেমে পড়ল ট্রেনিংয়ে। বাচ্চাগুলোকে দেখতে দেখতে সঙ্গে থাকা অ্যাকাডেমির লোকজনকে বাধ্য হয়ে প্রশ্নটা করতেই হল। তা যতই এ রকম কোনও প্রশ্ন করা যাবে না মুচলেকা দিয়ে আসি না কেন।

এই মূহূর্তে আপনাদের সবচেয়ে প্রতিভাবান ফুটবলার কে? যার নাম ভবিষ্যতে উচ্চারণ হতে পারে মেসি-ইনিয়েস্তাদের সঙ্গে?

মিনিটখানেক ইতস্তত করে সঙ্গে থাকা অ্যাকাডেমি অফিশিয়াল হাতটা তুলে ধরলেন ট্রেনিং গ্রাউন্ডের দিকে।

‘‘ওই ছেলেটাকে দেখুন। কোঁকড়া চুলের ছেলেটা। নাম জাবি (উচ্চারণটা শোনাল চাবি) সিমন্স। মিডফিল্ডার। নেদারল্যান্ডসের ছেলে। বছর বারো বয়স। আর ছ’টা বছর সময় দিন। তার পর ফুটবল দুনিয়ার কাছে ওকে আর চিনিয়ে দিতে হবে না।’’ জানা গেল, মায়ামিতে লা লিগা প্রমিস টুর্নামেন্টে খেলার পর এই সিমন্সকে ট্র্যাক করছে চেলসি। যার জন্য লা মাসিয়া আরওই তাকে আগলে আগলে রাখছে।

ফুটবল দুনিয়া তাকে চিনবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। এইটুকু এখনই বলে দেওয়া যায়, একটা জায়গায় ছেলেটা টেক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাবে লিওনেল মেসিকেও।

লা মাসিয়া গ্র্যাজুয়েট লিস্টে জাবি সিমন্স নামটা থাকবেই!

‘‘ওই ছেলেটাকে দেখুন। কোঁকড়া চুলের ছেলেটা। নাম জাবি (উচ্চারণটা শোনাল চাবি) সিমন্স। মিডফিল্ডার। নেদারল্যান্ডসের ছেলে। বছর বারো বয়স। আর ছ’টা বছর সময় দিন। তার পর ফুটবল দুনিয়ার কাছে ওকে আর চিনিয়ে দিতে হবে না।’’ জানা গেল, মায়ামিতে লা লিগা প্রমিস টুর্নামেন্টে খেলার পর এই সিমন্সকে ট্র্যাক করছে চেলসি। যার জন্য লা মাসিয়া আরওই তাকে আগলে আগলে রাখছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন